স্রেফ ক্রিকেট বল নয়, যাবতীয় উপেক্ষাকেই যেন বাইরে পাঠাচ্ছেন সঞ্জু স্যামসন। ছবি টুইটার থেকে নেওয়া।
উপেক্ষা, যন্ত্রণা আর সব উড়িয়ে দিয়ে নিজের উপর রাখা অটল বিশ্বাস!
মঙ্গল-রাতের শারজা ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে করাচ্ছে দিল্লি পুলিশের এক প্রাক্তন কনস্টেবলকে। স্মৃতির পাতা উল্টে উঠে আসছে ছেলের অভিমান ও তা থেকে জন্ম নেওয়া আগুনে প্রতিজ্ঞা। ইনি, অতি অবশ্যই বিশ্বনাথ স্যামসন, সঞ্জুর বাবা। জাতীয় দলে দিনের পর দিন উপেক্ষার সেই দিনগুলোই চোখের সামনে ভাসছে তাঁর। কষ্টের মুহূর্তগুলো যে এখনও জীবন্ত। একেবারে টাটকা!
চেন্নাই সুপার কিংসের বিরুদ্ধে নয় ছক্কায় সাজানো বিস্ফোরক ইনিংসে সঞ্জু স্যামসন অবশ্য ফের মন জিতে নিয়েছেন ক্রিকেটমহলের। সচিন তেন্ডুলকর টুইট করেছেন, “ক্লিন স্ট্রাইকিং! এগুলো সমস্তই একেবারে ক্রিকেটীয় শট। একটাও স্লগ নয়।” সুনীল গাওস্করের মনে হয়েছে, “সব দিক দিয়েই উন্নতি করেছে স্যামসন। ট্যালেন্ট নিয়ে প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু গত কয়েক মাসে ও যে খুব খেটেছে, তা নিজেই বলেছে। জাতীয় দলের হয়ে খেলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, সেটা বোঝাই যাচ্ছে।” ছয় মারার অনায়াস দক্ষতার সঙ্গে গৌতম গম্ভীর আবার মিল খুঁজে পাচ্ছেন রোহিত শর্মার।
স্রেফ প্রশংসা নয়, রীতিমতো উচ্চ প্রশংসা। এবং তার পরও থেকে যাচ্ছে চিরন্তন প্রশ্ন। যা তুলে দিয়েছেন গৌতম গম্ভীরই। টুইট করেছেন, একমাত্র জাতীয় দল ছাড়া সর্বত্রই স্বাগত সঞ্জু!
আর এখানেই আশঙ্কা। ৩২ বলে ৭৪ রানের দু’শোরও বেশি স্ট্রাইক রেটের এই ইনিংস যত সাড়া-জাগানিয়াই হোক, আখেরে কাজে আসবে তো! জাতীয় দলের বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে আলোর রেখা চোখে পড়বে তো!
আরও পড়ুন: একমাত্র জাতীয় দলেই সুযোগ পায় না স্যামসন! টুইট গম্ভীরের
২০১৫ সালের ১৯ জুলাই হারারেতে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অভিষেকের পরের পাঁচ বছরে মোট ম্যাচের সংখ্যা পাঁচও নয়। আটকে আছে চারে। তার মধ্যে দুটোই আবার কয়েক মাস আগে, ফেব্রুয়ারির নিউজিল্যান্ডে। হতাশা আসাই স্বাভাবিক। আর সঞ্জুর বাবার গলায় সেটাই ফুটে উঠল। আনন্দবাজার ডিজিটালকে বললেন, “পাঁচ বছর ধরে খুব কষ্টে রয়েছি। আমাকে মারাত্মক যন্ত্রণা দিয়েছে ওর সুযোগ না পাওয়া। ছেলেটা খুব মেহনত করে। কিন্তু মওকা কিছুতেই মিলছে না ইন্ডিয়ান টিমে।”
২০১২ সালে ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপের দলে এসেছিলেন সঞ্জু। পরের বছরের আইপিএলেও নজর কাড়েন। সাত বছর আগে কেরিয়ারের প্রথম আইপিএলে ১১ ম্যাচে ২৫.৭৫ গড়ে করেন ২০৬ রান। ২০১৪ সালে ১৩ ম্যাচে আসে ৩৩৯ রান। ২০১৫ সালে ১৪ ম্যাচে ২০৪ রান, ২০১৬ সালে ১৪ ম্যাচে ২৯১ রান, ২০১৭ সালে ১৪ ম্যাচে ৩৮৬ রান, ২০১৮ সালে ১৫ ম্যাচে ৪৪১ রান আর গত বারের আইপিএলে ১২ ম্যাচে ৩৪২ রান। গত দু’বারের আইপিএলে গড় থেকেছে তিরিশের বেশি। স্ট্রাইক রেট গত তিনবারে ঘোরাফেরা করেছে ১৪০-এর কাছে। পর পর ১৪৮.৬৯, ১৩৭.৮১ ও ১৪১.৩৯। চুম্বকে, আইপিএলে বরাবরই নিজেকে প্রমাণ করেছেন কেরলের তিরুঅনন্তপুরমে জন্মানো এই ক্রিকেটার।
বিধ্বংসী মেজাজে সঞ্জু। দর্শকের ভূমিকায় ধোনি। ছবি টুইটার থেকে নেওয়া।
আইপিএলের ধারাবাহিকতা প্রচারে আনলেও খুব একটা লাভ হয়নি। বাবার কথায়, “২০১৩ সালে আইপিএলে ও বেস্ট ইয়ং প্লেয়ার ক্রিকেটার হয়েছিল। তখন থেকে আইপিএলে ও রান করে আসছে। কিন্তু ইন্ডিয়ার হয়ে খেলার ঠিকঠাক সুযোগ পাচ্ছে না। যার ফলে ও নিজেও চাপে থাকে। আমরাও কষ্টে থাকছি। আমার ছেলে দেশের হয়ে খেলছে, এটাই দেখতে চাই। শুধু এটাই বলতে পারি যে ওর সুযোগ পাওয়া উচিত।”
ক্রিকেট সাধনায় ঘাম ঝরানোর সেই দিনগুলোতেও বাড়িতে ব্যাট-বল-গ্লাভস নিয়ে খুব বেশি আলোচনা চলে না সচেতন ভাবেই। পাছে, বাকিদের টেনশন বা যন্ত্রণা টের পান সঞ্জু। কিন্তু, সঞ্জু নিজে কেমন থাকেন উপেক্ষা আর অবহেলার সেই দিনগুলোয়? বাবা বললেন, “দেখুন, আমরা এই ব্যাপারে কথাই বলি না। এটা বিশ্বাস করি যে ও ঠিক পরিশ্রমের দাম পাবে। ওর পারফরম্যান্স ঠিক নজরে পড়বে, এই আশা রয়েছে। আর ও নিজেও মানসিক ভাবে শক্তিশালী। ও খুব স্ট্রং। ছোট-খাটো ব্যাপারে বিচলিত হয় না একেবারে।”
জাতীয় দলের হয়ে খেলার স্বপ্ন ভাঙতে দেখা যদিও ছোটখাটো বিষয় নয়। সঞ্জু অবশ্য তখনও ভেঙে পড়েন না। বরং নিজেকে মুড়ে নেন কঠোর সাধনায়। বাবা শোনালেন, “কখনও নিজের টার্গেট থেকে সরে যায় না। খাটাখাটনি করতেই থাকে। বলতে থাকে, ম্যায় আউঙ্গা, ম্যায় আউঙ্গা। আমাকেও এটাই বলতে থাকে যে, পরিশ্রম করে চলছি, দেশের হয়ে ঠিক খেলব।”
না, স্যামসন পরিবারে কারও প্রতি বিন্দুমাত্র অভিমান নেই। ফুটবল খেলতেন সঞ্জুর বাবা, ছিলেন স্ট্রাইকার। গোলের সামনে বাধা দিতে উদ্যত গোলকিপারের ভূমিকায় কোনও নির্বাচককে দেখছেন না তিনি। বললেন, “আমাদের কারও প্রতি অভিযোগ নেই। কাউকে দোষারোপও করছি না। আমি জানি, সুযোগ আসবেই। আর সঞ্জুও তা বিশ্বাস করে মনে-প্রাণে। বলতে থাকে যে ঠিক ইন্ডিয়া খেলব।”
আরও পড়ুন: রাজস্থানের বিরুদ্ধে ধোনির স্ট্র্যাটেজি মানতে পারছেন না অনেকেই
প্রতিযোগিতা চলাকালীন বাবা-ছেলের মধ্যে ফোনালাপ চলে না। মনসংযোগ ব্যাহত করতে না চাওয়া বাবা মেসেজ পাঠান সাধারণত। বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে তা হয়ে ওঠে ভয়েস মেসেজ। চেন্নাইয়ের বিরুদ্ধে ম্যাচের সেরা হওয়ার পর যেমন উচ্ছ্বসিত বাবা থাকতে না পেরে নিজের গলাই রেকর্ড করে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কী বলেছিলেন? “বহৎ আচ্ছা কিয়া, এটুকুই বলতে পেরেছিলাম। এ ভাবেই খেলতে থাকো। ধন্যবাদ, ধন্যবাদ!” আবেগে ছেলেকেও বার কয়েক ‘ধন্যবাদ’ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বাবা!
ক্রিকেটমহলে সঞ্জুর উইকেটকিপিং নিয়ে অনেকেরই সংশয় রয়েছে। কারও কারও মনে হয়, কিপার হিসেবে যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য নন তিনি। আর সেই কারণেই দীনেশ কার্তিক, ঋদ্ধিমান সাহা, ঋষভ পন্থ, লোকেশ রাহুলরা গত কয়েক বছরে অনেক বেশিবার এসেছেন জাতীয় দলে। বাবা অবশ্য ছেলেকে বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যান হিসেবে দেখার অনুরোধ করছেন। তাঁর মতে, “ঋদ্ধিমান, দীনেশ কার্তিক, ঋষভ পন্থরা সবাই বহৎ আচ্ছা। কিন্তু, আমি বলি কী, শুধু ব্যাটসম্যান হিসেবেই দেখা হোক না ওকে। ও তো দুর্দান্ত ফিল্ডারও। অসাধারণ ফিল্ডিং করে। আউটফিল্ডে। কিপার-ব্যাটসম্যানের লড়াইয়ে ওকে কেন ফেলা হচ্ছে জানি না। কার্তিক-ঋদ্ধিরা ওর চেয়ে সিনিয়র। দারুণ পারফর্মারও। ঋষভের পারফরম্যান্স নেই, এটাও আমি বলছি না। ঋষভকে সরিয়ে আমার ছেলেকে সুযোগ দাও, বলতে পারব না। কেউ কেউ সঞ্জুকে বলে ধোনির পরিবর্ত। আমি বলি না, আমার সঞ্জু মোটেই ধোনির বিকল্প নয়। ধোনি মহান ক্রিকেটার। সঞ্জুকে উচিত ছিল ধোনির নেতৃত্বে খেলানো। ও ব্যাটসম্যান হিসেবেই তো দলে আসতে পারে। আর দুর্ধর্ষ ফিল্ডিং করে এটাও তো দেখা গিয়েছে।”
চেন্নাইয়ের বিরুদ্ধে অবশ্য সঞ্জুর উইকেটকিপিংও হয়েছে প্রশংসিত। সুনীল গাওস্করের চোখে স্টাম্পের পিছনে সদা সতর্ক লেগেছে রয়্যালস কিপারকে। লম্বা ইনিংস খেলার পর কিপিং করতে আসা যে সহজ নয়, সেটাও মনে করিয়ে দিয়েছেন কিংবদন্তি প্রাক্তন। লিটল মাস্টারের মতে, সব দিক দিয়েই উন্নতি করেছেন সঞ্জু।
কিন্তু, নীল জার্সিতে বিরাট কোহালির দলের প্রথম এগারোয় আসার পক্ষে তা যথেষ্ট তো!