আজ শুরু অভিযান, আত্মবিশ্বাসী নাইট-অস্ত্র কুলদীপ

আমি তৈরি, চাপটা তো ওয়ার্নারের: কুলদীপ যাদব

শাহরুখ খানের কলকাতা নাইট রাইডার্সের তুরুপের তাস। গত এক বছরে বিরাট কোহালির ভারতীয় দলের সব চেয়ে উন্নতি করা ক্রিকেটার। প্রতিভাসম্পন্ন তরুণ থেকে ম্যাচউইনারে পরিণত। আইপিএলের নতুন মরসুমে অভিযান শুরু করার আগে আনন্দবাজারের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় কুলদীপ যাদব। 

Advertisement

সুমিত ঘোষ 

শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০১৯ ০৩:২৪
Share:

ইডেনে অনুশীলনে চায়নাম্যান কুলদীপ। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

শাহরুখ খানের কলকাতা নাইট রাইডার্সের তুরুপের তাস। গত এক বছরে বিরাট কোহালির ভারতীয় দলের সব চেয়ে উন্নতি করা ক্রিকেটার। প্রতিভাসম্পন্ন তরুণ থেকে ম্যাচউইনারে পরিণত। আইপিএলের নতুন মরসুমে অভিযান শুরু করার আগে আনন্দবাজারের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় কুলদীপ যাদব।

Advertisement

প্রশ্ন: এক বছর বাদে ফের আইপিএলে। ফের সেই ইডেন। ফের নাইট রাইডার্স শিবির। কতটা পাল্টেছে জীবন?

কুলদীপ যাদব: এক বছরে পরিসংখ্যান বদলে গিয়েছে হয়তো (হাসি)। খেলতে খেলতে এই এক বছরে অনেক কিছু শিখেছি। গত বার যখন আইপিএলে এলাম, দক্ষিণ আফ্রিকায় ঠিক তার আগেই চোট লেগেছিল। প্রথম তিন-চারটে ম্যাচে খেলতে পারিনি। গত এক বছরে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজ়িল্যান্ড— সব জায়গায় খেলেছি। অনেক আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছি।

Advertisement

প্র: সীমিত ওভারের ক্রিকেট থেকে টেস্ট দলে ঢুকে পড়েছেন। কতটা তৃপ্তিদায়ক?

কুলদীপ: আমি বলব, সব চেয়ে তৃপ্তিদায়ক। যে কোনও ক্রিকেটারকে জিজ্ঞেস করুন, তোমার কোন ধরনের ক্রিকেট সব চেয়ে পছন্দের, সে বলবে টেস্ট ক্রিকেট। টেস্টে যদি কেউ পাঁচ উইকেট নেয় বা সেঞ্চুরি করে, তার অনুভূতিই আলাদা। আমার সব চেয়ে আনন্দ হচ্ছে এটা ভেবেই যে, তিনটে ফর্ম্যাটেই দেশের হয়ে খেলতে পারছি। ভাল পারফরম্যান্সও করতে পারছি।

প্র: সফল কুলদীপ নিজেকে কী বলছেন?

কুলদীপ: নিজেকে সে বলছে, এই সাফল্য যেন তোমাকে আরও ভাল খেলার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে। আমি আরও পরিশ্রম করছি। ফিটনেসের ব্যাপারে আরও সচেতন হচ্ছি (কলকাতার মিষ্টি দই খাবেন কি না, জিজ্ঞেস করায় বলে দিলেন, ও সব একদম বারণ)। কখনও যদি আত্মতুষ্ট হয়ে পড়ি তা হলে ক্রিকেট আমাকে ক্ষমা করবে না। তখন ফিরে আসা খুব কঠিন হবে। খুব জরুরি হচ্ছে, সাফল্যের জোয়ারে ভেসে না যাওয়া। ভারসাম্য না হারানো। পরিশ্রমের রাস্তা থেকে সরে না আসা।

প্র: সামনেই বিশ্বকাপ, ভারত স্বপ্ন দেখছে কুল-চা জুটিকে ঘিরে...

কুলদীপ: আমরাও দেখছি। বিশ্বকাপ জেতা সকলের স্বপ্ন। যদি দেশের হয়ে বিশ্বকাপ জিততে পারি, তার চেয়ে খুশির মুহূর্ত আর কী হতে পারে! যখন থেকে আমি আর চহাল দলে এসেছি, দু’জনেই চেয়েছি, দেশের হয়ে ভাল খেলতে। একে অন্যের সাফল্যকে উপভোগ করি। বিশেষ করে আমাদের লক্ষ্য থাকে, মাঝের দিকের ওভারগুলোতে ভাল করা। যে কোনও দলকে যদি মাঝের ওভারগুলোতে ধাক্কা দেওয়া যায়, যদি মাঝের পর্বে তিন-চারটে উইকেট তুলে নেওয়া যায়, তা হলে তাদের পক্ষে ম্যাচে ফিরে আসাটা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে শেষ ওয়ান ডে সিরিজটাই দেখুন। যে ম্যাচগুলোতে আমরা হেরেছি, তাতে মাঝের ওভারে ওরা ভাল ব্যাটিং করেছে। আমার আর চহালের লক্ষ্যটাই থাকে, মাঝের দিকের ব্যাটসম্যানগুলোকে পাকড়াও।

প্র: বিশ্বকাপ জয়ে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কী হতে পারে?

কুলদীপ: ক্রিকেট একটা টিমগেম। পুরো দলকে ভাল করতে হয়, তবেই বিশ্বকাপের মতো প্রতিযোগিতা জেতা সম্ভব। সব বিভাগে ভাল করতে হবে। সঠিক কম্বিনেশন তৈরি হওয়া দরকার। এক জনের ভাল পারফরম্যান্স দিয়ে বিশ্বকাপ জেতা যায় না। পুরো দলটাকে টগবগে ঘোড়ার মতো দৌড়তে হবে।

প্র: ভারত ছাড়া আর কোন দল বিশ্বকাপে ফেভারিট বলে মনে হয়?

কুলদীপ: ইংল্যান্ড ভাল দল। ওদের ভাল ক্রিকেটার আছে, ব্যাটিং বিভাগ খুব ভাল। অস্ট্রেলিয়া ভাল দল, ওরা দারুণ ক্রিকেট খেলছে। বড় টুর্নামেন্টে ওরা ভাল খেলে। পাকিস্তান ভাল দল।

প্র: আপনার প্রথম দুই প্রতিপক্ষ সানরাইজার্স হায়দরাবাদ এবং কিংস ইলেভেন পঞ্জাব। প্রথমটায় ডেভিড ওয়ার্নার, দ্বিতীয়টায় ক্রিস গেল। শুরুতেই তো দু’টো বড় দ্বৈরথ!

কুলদীপ: ডেভিড ওয়ার্নারকে বল করতে আমার খুব মজা লাগে (হাসি)। চ্যালেঞ্জিং হবে নিশ্চয়ই। কিন্তু আমি এই চ্যালেঞ্জটা উপভোগ করি। অনেক দিন ক্রিকেটের বাইরে ছিল ওয়ার্নার। তাই চাপটা ওর উপরেই থাকবে। আমার লক্ষ্য থাকবে, ওর এই চাপটা আরও বাড়িয়ে দেওয়া। আর ক্রিস গেলকে নিয়ে একটা কথা আমার মনে হয় যে, বড় শট নিতে থাকে বলে ওকে আউট করার সুযোগটাও সব সময় রয়েছে। কিন্তু কোনও সন্দেহ নেই, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বিশাল ক্রিকেটার ক্রিস গেল। গেমচেঞ্জার। তাই আমার টার্গেট থাকবে গেলকে আউট করা। আমরা জানি, গেলের উইকেট তুলতে পারলে ম্যাচে কেকেআর এগিয়ে যাবে।

প্র: টি-টোয়েন্টিতে কাকে বল করা সব চেয়ে কঠিন বলে মনে হয়েছে?

কুলদীপ: কাউকে বোলিং করতেই আমি ভয় পাই না। ভয় পেলে তো আর বোলিংই করতে পারব না। বড় বড় অনেক ব্যাটসম্যানই আছে। বিরাট ভাই (কোহালি) আছে, এ বি ডিভিলিয়ার্স আছে, মাহি ভাই (ধোনি) আছে। ওদের কাউকে ভয় পাই না, বরং সব সময় ভাবি যে, বড় ক্রিকেটারদের উইকেট নেব।

প্র: কোহালি বা ধোনি, যাঁদের সঙ্গে ভারতীয় দলে খেলেন, তাঁদের বোলিং করার অভিজ্ঞতা কী রকম?

কুলদীপ: এটা আরও বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ নেটে সব সময় ওদের বোলিং করছি। ওরা সকলে জানে, আমি কী ধরনের বোলিং করি। আমিও জানি, ওদের দুর্বলতা কী। খুবই উপভোগ্য অভিজ্ঞতা কারণ শুধু আইপিএলেই বিরাট ভাই, রোহিত ভাই বা মাহি ভাইয়ের মতো বড় ক্রিকেটারকে বল করার সুযোগ আসে।

প্র: ধোনি উইকেটের পিছন থেকে সারাক্ষণ আপনাকে উপদেশ দিচ্ছেন। আইপিএলের দ্বৈরথে কোন লুকনো অস্ত্রে ধোনিকে ঘায়েল করবেন?

কুলদীপ: (হাসি) মাহি ভাই সব জানে আমার বোলিংয়ের ব্যাপারে। আমি কখন কী বোলিং করতে পারি, সম্পূর্ণ নখদর্পণে। আমাকে সেটা বলতেও থাকে সারাক্ষণ— আমি জানি তুই এ বার কী বোলিং করবি। তাই আমাকেও খুব ধৈর্য ধরে, খুব ভেবে কৌশল সাজাতে হবে যে, কী ভাবে মাহি ভাইকে আউট করা যায়।

প্র: স্পিন কে ভাল খেলেন?

কুলদীপ: আমাদের কেকেআর ক্যাপ্টেন দীনেশ কার্তিক। আমার মনে হয়েছে, স্পিনের বিরুদ্ধে ও-ই সেরা ব্যাটসম্যান। কোন স্পিনার কখন কী বল করতে পারে, দারুণ বোঝে।

প্র: হেড কোচ রবি শাস্ত্রী বলেছেন, বিদেশে আপনিই হবেন এক নম্বর স্পিনার। আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

কুলদীপ: আমার জন্য খুবই ইতিবাচক সংকেত। হেড কোচ আস্থা রাখছে দেখলে যে কেউ উদ্বুদ্ধ হবে। বিশেষ করে এক জন তরুণ ক্রিকেটারের জন্য এটা খুবই মনোবল-বর্ধক। আর আমার বিশেষ করে ভাল লেগেছে কারণ, টেস্ট ক্রিকেটের কথা বলেছেন উনি। টেস্ট ক্রিকেট সব চেয়ে সেরা ফর্ম্যাট। ছোটবেলা থেকে আমি স্বপ্ন দেখেছি, ক্রিকেট মাঠে দলকে জেতাব, দেশকে জেতাব। কখনও ভাবিনি যে, তিন বা চার নম্বর স্পিনার হয়ে থাকব। সব সময় ভেবেছি, প্রধান বোলার হব। সুপারস্টার হলাম কি হলাম না, ও সব নিয়ে ভাবি না। ভাবি, দলের প্রয়োজনের দিক থেকে আমি কোথায় দাঁড়িয়ে। সে দিক দিয়ে রবি স্যরের মন্তব্যটা খুব উৎসাহ দিয়েছে।

প্র: সিডনিতে পাঁচ উইকেট আপনার জন্য কত বড় সাফল্য?

কুলদীপ: জীবন বদলে দেওয়া সাফল্য বলতে পারেন। লর্ডস টেস্ট আমার খুব খারাপ গিয়েছিল। তার পরে নিজেকে বলেছিলাম, আমাকে ভাল পারফরম্যান্স করে দেখাতেই হবে। সিডনির পাঁচ উইকেট তাই আমার কাছে সেরা পারফরম্যান্স।

প্র: সেখানে এক অস্ট্রেলীয় কিংবদন্তিকে দেখেছিলাম। তাঁর দেশ হারছিল কিন্তু আপনার সাফল্যে শিশুর মতো লাফাচ্ছিলেন!

কুলদীপ: ইয়েস, শেন ওয়ার্ন। আমার আদর্শ। আমি শুরু থেকে ওঁর ফ্যান। সারা জীবন থাকবও। ক্রিকেট খেলা শুরুই করেছি ওঁর জন্য। ওঁকে দেখেই আমার মধ্যে স্পিন বোলিং নিয়ে আবেগ তৈরি হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া সফরে রবি স্যার (রবি শাস্ত্রী) আমাকে ওঁর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন অনেক পরামর্শ দেন উনি। আমার মনে হয়েছে, উনি আমার শুভাকাঙ্ক্ষীও। আমার ভাল চান। সিডনি টেস্টের সময়েও আমাকে অনেক পরামর্শ দিয়েছিলেন। আমার আদর্শের সামনে পাঁচ উইকেট নেওয়াটা সব চেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত।

প্র: ওয়ার্নের থেকে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কী শিখেছেন?

কুলদীপ: কী ভাবে আত্মবিশ্বাসী হতে হয়, সেটা শিখেছি শেন ওয়ার্নের থেকে। যখন খেলতেন, হয়তো সব সময় উনি জেতেননি। কখনওসখনও ব্যাটসম্যান জিতেছে। কিন্তু কখনও আত্মবিশ্বাস হারাননি। ওয়ার্ন বলেন, সব সময় হাসিটা রেখে যাও মুখে। ব্যাটসম্যানের সঙ্গে মানসিক ভাবে খেলতে থাকো। আর প্রাথমিক পাঠের উপরে সব সময় জোর দিতে বলেন।

প্র: ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্টের থেকে কতটা লাভবান হয়েছেন?

কুলদীপ: খুবই লাভবান হয়েছি। ভারতীয় দলের বোলিং কোচ বি অরুণ আমাকে দশ বছরের উপর দেখছেন। যখন আমি প্রথম বার বেঙ্গালুরুতে জাতীয় অ্যাকাডেমিতে এসেছিলাম, তখন থেকে। আমার ব্যাপারে সব কিছু জানেন উনি। খুব ভাল একটা বন্ধন তৈরি হয়ে গিয়েছে। আমাকে খুব সমর্থন করেন অরুণ স্যর। আর রবি স্যর প্রথম থেকেই আমাকে খুব উদ্বুদ্ধ করে গিয়েছেন, এখনও করে যাচ্ছেন। টিম ম্যানেজমেন্ট তরুণদের খুব সমর্থন করে। তার জন্য আমাদের প্রত্যেকের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।

প্র: কেকেআরের কোচ জাক কালিস আপনার শান্ত মনোভাব দেখে প্রভাবিত। সত্যিই কি আপনি শান্ত?

কুলদীপ: বাড়িতে থাকার সময় যখন প্র্যাক্টিস করি, তখন দেখলে বোঝা যাবে আমি কতটা শান্ত (হাসি)। আমি যখন বাড়িতে থাকি, খুবই রেগে যাই মাঝেমধ্যে। যখন দেখি, যেটা করার চেষ্টা করে যাচ্ছি কিন্তু কিছুতেই হচ্ছে না, তখন নিজেকে সামলাতে পারি না। সমস্ত রাগ ওখানেই আমি বের করে দিই। স্টাম্পে লাথি মেরে দিই, বল ছুড়ে ফেলে দিই। এর পর যখন আন্তর্জাতিক মঞ্চে আসি, তখন আমাকে শান্ত দেখায় কারণ আমি সব রাগটাই প্র্যাক্টিস মাঠে ফেলে এসেছি।

প্র: কুল-চা ভারতে বিশ্বকাপ আনতে পারবে? কুলদীপ কলকাতাকে আইপিএল উপহার দিতে পারবে?

কুলদীপ: বিলকুল, বিলকুল। ফ্যানদের অনুরোধ করব, আমাদের সমর্থন করুন। যে রকম ছন্দে আমরা রয়েছি, আশা করি কুল-চা বিশ্বকাপ নিয়ে আসতে পারবে। আর কলকাতাতেও অবশ্যই আইপিএল আনতে চাই।

প্র: কোনও বাংলা শব্দ শিখেছেন?

কুলদীপ: ছ’বছরে কিছুই শিখিনি। কেমন আছি— এটা জানি। আর বলতে পারি— ‘করব, লড়ব, জিতব’।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement