সঙ্গকারার ইনিংস কোহলিদের শান্তিরেখা লঙ্ঘন করতে দেয়নি

কুমার সঙ্গকারার আন্তর্জাতিক অনুরাগীরা নিয়মিত আক্ষেপ করেন, আর কেন মাত্র ৭৮৪ মাইল উত্তরে তিনি জন্মালেন না? তা হলে ক্যান্ডি নয়, তাঁর জন্মস্থান হত চেন্নাই। আর যাবতীয় ক্রিকেটীয় কীর্তির জন্য তিনি এত সমাদর পেতেন যা ভারত মহাসাগরের ধারে ছোট দ্বীপভূমি দিতে পারেনি।

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

কলম্বো শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০১৫ ০২:৫০
Share:

পি সারা জুড়ে সঙ্গা। ছবি: এএফপি।

কুমার সঙ্গকারার আন্তর্জাতিক অনুরাগীরা নিয়মিত আক্ষেপ করেন, আর কেন মাত্র ৭৮৪ মাইল উত্তরে তিনি জন্মালেন না? তা হলে ক্যান্ডি নয়, তাঁর জন্মস্থান হত চেন্নাই। আর যাবতীয় ক্রিকেটীয় কীর্তির জন্য তিনি এত সমাদর পেতেন যা ভারত মহাসাগরের ধারে ছোট দ্বীপভূমি দিতে পারেনি।

Advertisement

এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই যে, নিছক রানের প্রাসাদ মাপকাঠি হলে আধুনিক ব্র্যাডম্যান তিনিই। কিপিং করতে হয়নি যে সব টেস্টে সেখানে শুধু ব্যাটসম্যান হিসেবে তাঁর গড় ৬৭.৩৯। ব্র্যাডম্যানের পরেই। এক-একটা হাজারে পৌঁছনোর এমন সব রেকর্ড আর বাহারি মণিমুক্ত আছে যে, ব্র্যাডম্যানের পরে অঙ্কের সাতমহলা বাড়ি তাঁরই। সেই তুলনায় সত্যি তো কোনও প্রচার পাননি।

অন্তত শুক্রবারের জন্য অবশ্য মাত্র আটশো কিমি উত্তরে না জন্মে তাঁর ভালই হয়েছে! ভারতীয় ক্রিকেটার হলে শেষ টেস্টে তাঁকে এমন সব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হত যার জন্য শুধুই ক্রিকেট ব্যাট যথেষ্ট নয়। বলা হয়ে থাকে, একজন ক্রীড়াবিদ অনুশীলনে-অনুশীলনে ধ্বনিকে মাথা থেকে ডিলিট করে দিতে পারে। সচিন যেমন ভক্তদের আকুল চিৎকার ব্যাট করার সময় ইরেজ করতে জানতেন। কিন্তু সামনে ঘটতে থাকা দৃশ্য কী করে ডিলিট হবে! যে লোকটা মন দিয়ে এক বলের খেলায় বল দেখবে তার তো চোখে সব কিছুই পড়বে।

Advertisement

সঙ্গা আজ যখন ব্যাট করতে নেমেছিলেন তখন তাঁকে স্বাগত তোপধ্বনির দায়িত্বে থাকা লোকটি বোধহয় ক্ষণিক অন্যমনস্ক ছিল। বা সে ভাবেইনি অ্যাদ্দিন চারে নামছিলেন, জীবনের শেষ টেস্টে যে সঙ্গা হঠাৎ করে নিজের প্রকৃত জায়গায় ফেরত যাবেন। এর ফলে কোহলিরা দু’দিকে দাঁড়িয়ে গার্ড অব অনার দেওয়া শেষের মিনিটপাঁচেক বাদে বাজিগুলো পোড়া শুরু হল। সঙ্গা স্রেফ দাঁড়িয়ে পড়লেন। জনতার চিৎকার, ভক্তের আহ্লাদ, শেষ টেস্টের এক সমুদ্র চাপ সব সামলাতে পারেন। কিন্তু ওই যে সাইটস্ক্রিনের পাশে ধোঁয়া উড়ছে, তার সঙ্গে খেলেন কী করে!

তখনই মনে হল চেন্নাইজাত হলে আজ হোস্ট ব্রডকাস্টার সোনি তাঁকে মোটেও এত সহজে নিষ্কৃতি দিত না। সচিনের শেষ ইনিংসে স্টার স্পোর্টস যা করেছিল অন্তত তিনি ভোলেননি। ওয়াংখেড়ের দু’দিকে লাগানো দুটো বিশাল ভিডিও স্ক্রিনে তারা এক বার দেখাচ্ছিল হুইলচেয়ারে বসা তাঁর মা। এক বার আর একটা হুইলচেয়ারে বসা কোচ আচরেকরকে। পরক্ষণেই উদ্বিগ্ন মুখের অঞ্জলি আর কন্যা সারা।

সচিন তখন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ফাস্ট বোলারের বিরুদ্ধে দিনের শেষ কয়েকটা ওভার খেলছিলেন। গ্যালারিতে বসে থাকা অজিত তেন্ডুলকরকে তাঁর বন্ধুরা উত্তেজিত ভাবে বলেছিলেন, হচ্ছেটা কী! এখনই স্টারের কাছে প্রতিবাদ করো। সচিন পরে বলেছিলেন বোলারের বল দেখবেন কী, তাঁর চোখ বারবার চলে যাচ্ছিল কখনও মা, কখনও কোচের দিকে। সঙ্গার শেষ টেস্টের প্রথম ইনিংসে তেমন কোনও অদৃশ্য ক্রিকেট-বহির্ভূত চ্যালেঞ্জ গজিয়ে ওঠেনি।

একমাত্র চ্যালেঞ্জ ছিল যে, তিনি পরিস্থিতিকে খেলেন? না নিজের ইগোকে?

গোটা ক্রিকেট পৃথিবী আপাতত তাঁর আর মাইকেল ক্লার্কের শেষ ইনিংসের দিকে তাকিয়ে। এই মোমবাতি নিভে যাচ্ছে-যাচ্ছে সময় স্বাভাবিক ইচ্ছে হতেই পারে যে এত বছর দলকে টেনেছি, এ বার একটু নিজের সৌকর্য মেলে ধরার জন্য খেলি। স্ট্রোকপ্লে-র কিছু এগজিবিশন করি যা দিয়ে লোকে শেষ স্মৃতিটুকু রাখবে।

শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটের চিরকালীন টিমম্যান সেই রাস্তাতেই যাননি। কামড়ে থেকে গেলেন ৮৭ বলে ৩২ রানের ইনিংস খেলার জন্য। জানার খুব লোভ হচ্ছে তিনি ব্যাট করতে নামলেই দু’পাশে দাঁড়িয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হওয়ার মতো এটাও কি পরিকল্পিত ছিল যে, ফার্স্ট ডেলিভারিতেই তাঁকে ইয়র্ক করানোর চেষ্টা হবে?

সঙ্গার পেস বোলিং খেলার প্রতিভা কোনও মতে তাঁকে প্রথম বলে উমেশের ওই শক্তিশেলতুল্য ইয়র্কার থেকে বাঁচাল। এর পরেও এক দিক থেকে উমেশ। উল্টো দিকে ইশান্ত। তাঁকে লাগাতার বাউন্সার বর্ষণ করে গেলেন। এমনিতে কোহলি খুব শ্রদ্ধা করেন সঙ্গাকে। দু’জনে দারুণ সম্পর্ক। কিন্তু ভারত অধিনায়কের এই মনোভাবটা দারুণ যে, সৌজন্য সৌজন্যের জায়গায়। হিংসে হিংসের জায়গায়। সঙ্গা ভারতীয় বোলিংয়ের যে বিষটা সামলালেন মনে হয় না অন্য কেউ তিন নম্বরে এলে আজ সেটা সম্ভব ছিল বলে।

তিন নম্বর পেসার স্টুয়ার্ট বিনিও খুব জায়গা রেখে অফস্টাম্প আর তার বাইরে বল করে গেলেন। শ্রীলঙ্কা যে ওভার পিছু তিন রানও তুলতে পারেনি তার অন্যতম কারণ বিনির ১১-৩-২৪-০। সঙ্গা আবার হাফসেঞ্চুরি পেতে ব্যর্থ। সিরিজে তিন বার টানা অশ্বিনের শিকার। কিন্তু আজকের ৩২ আসলে ৬২। ওই যে দুপুর একটা নয় থেকে তিনটে উনিশ পর্যন্ত তাঁর ক্রিজে কাটানো— ওটাই ভারতকে আজকের মতো শান্তিরেখা লঙ্ঘন করে শ্রীলঙ্কা ব্যাটিংয়ের ওপর চড়াও হতে দেয়নি।

অমিত মিশ্র চেষ্টা করে যাচ্ছেন প্রাণপণ। কিন্তু তিনি হাওয়ায় এত মন্থর যে পিচ আজকের মতো ঢিমে হলে ঘোর সমস্যা। তখন ব্যাটসম্যানের ভুলের জন্য অপেক্ষা ছাড়া গতি নেই। গলের দ্বিতীয় দিনের তুলনায় ওভালের দ্বিতীয় দিন অনেক বেশি ব্যাটিং সহায়ক।

এমন দিনে অশ্বিনের ওপর ভরসা ছাড়া উপায় কী! সচিন ভারতীয় দলের ক্যাপ্টেন থাকাকালীন এক বার বলেছিলেন তাঁর কুম্বলে-নির্ভরতার কথা। উইকেট না পড়লে কুম্বলে। উইকেট পড়লে দ্রুত কুম্বলে। রানের গতি কমাতে চাইলে কুম্বলে। খেলা ঝিমিয়ে পড়ছে, গতি আনতে হবে— কুম্বলে।

কোহলি মুখে কিছু না বললেও বুঝে নিতে অসুবিধে নেই তাঁর কুম্বলে এখন কে!

ব্যাটসম্যান অশ্বিনের ওপরও এ দিন ভরসা করা হয়েছিল এবং তিনি একটা বাজে শটে আউট হলেন। শ্রীলঙ্কা তখন এমনই রক্তোন্মত্ত যে, ঘনঘন সর্বাত্মক অ্যাপিল করছে। এই সময় রান লিক মানে তারা জানে টেস্ট গেল। আর কৌশল সিলভা তো বলেই দিলেন, ‘‘এই টেস্টটা সঙ্গার জন্য জিততে আমরা উজাড় করে দিচ্ছি।’’ সেই উজাড়ের সামনে দারুণ ব্যাট করলেন বঙ্গসন্তান। ঋদ্ধিমান সাহার টানা দ্বিতীয় হাফসেঞ্চুরি। আজকেরটা অনেক বেশি কৃতিত্বের। ভারত যদি এখানে জিতে সিরিজ সমান করতে পারে সেই সেতুবন্ধনে কাঠবেড়ালির চেয়ে অনেক বেশি অবদান থাকবে ঋদ্ধির! শ্রীলঙ্কা লাইনে বল করে আর অনে লোক রেখে রান-উপোসী রাখতে চাইছে দেখে ঋদ্ধি সাহসী রিভার্স সুইপ শুরু করেন। সঙ্গার ইনিংস যেমন ভারতকে শ্রীলঙ্কার ওপর চড়াও হতে দেয়নি। তেমনই ঋদ্ধির দু’ঘণ্টার লড়াই হোম টিমকে এলওসি অতিক্রম করে এ দিকে আসতে দেয়নি। আর দু’সপ্তাহ আগে আজকের ইনিংসটা এলে ‘সেরা বাঙালি’র নমিনেশনে অবধারিত নাম ঢুকত তাঁর!

সঙ্গা আর ঋদ্ধির কাটাকুটিতে ওভালের দ্বিতীয় দিনটা ভিন্টেজ টেস্ট ক্রিকেট হিসেবে থেকে গেল। এমন ছয় ঘণ্টা যার মধ্যে কেউ জেতেনি, কেউ হারেনি। কিন্তু যার তাৎপর্য পরে ফল বার হলে বোঝা যাবে।

লিখতে ভুলে গেছিলাম সঙ্গা যখন আউট হয়ে ফিরছেন চিরবিশ্বস্ত পার্সি তাঁকে এগিয়ে দিলেন শ্রীলঙ্কার পতাকা সমেত। টেস্ট যে দিকে, সঙ্গার আরও একটা ইনিংস পাওয়া উচিত। পার্সি কিন্তু অলরেডি বলে দিয়েছেন, মন খারাপ কোরো না। শেষ ইনিংসে ওই ভদ্রলোকের চেয়ে তুমি ৩২ রান বেশি করেছ।

ওই ভদ্রলোক অবশ্যই ব্র্যাডম্যান! এ দেশের মানুষের কাছে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড অব ব্যাটিংয়ে ব্র্যাডম্যানই তাদের সঙ্গার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী! আর কোনও মরাঠি নাম-টাম তারা আলোচনায় আনতে একেবারেই উদ্যোগী নয়। ক্যান্ডির ৭৮৪ মাইল উত্তরে জন্মাননি তো কী! এই সম্মানটা তো আর হাতছাড়া হচ্ছে না কুমার সঙ্গকারার!

ভারত

প্রথম ইনিংস (আগের দিন ৩১৯-৬)

ঋদ্ধিমান এলবিডব্লিউ হেরাথ ৫৬

অশ্বিন ক সিলভা বো ম্যাথেউজ ২

মিশ্র ক চণ্ডীমল বো চামিরা ২৪

ইশান্ত এলবিডব্লিউ হেরাথ ২

উমেশ ন.আ. ২

অতিরিক্ত ২৮

মোট ৩৯৩ অল আউট।

পতন: ৪, ১২, ১৭৬, ২৩১, ২৬৭, ৩১৯, ৩২১, ৩৬৭, ৩৮৬।

বোলিং: প্রসাদ ২৪-৭-৮৪-২, ম্যাথেউজ ১৫-৭-২৪-২,

চামিরা ২০-২-৭২-২, হেরাথ ২৫-৩-৮১-৪, কৌশল ৩০-২-১১১-০।

শ্রীলঙ্কা

প্রথম ইনিংস

করুণারত্নে এলবিডব্লিউ উমেশ ১

সিলভা ক অশ্বিন বো মিশ্র ৫১

সঙ্গকারা ক রাহানে বো অশ্বিন ৩২

থিরিমান্নে ন.আ. ২৮

ম্যাথেউজ ন.আ. ১৯

অতিরিক্ত

মোট ১৪০-৩।

পতন: ১, ৭৫, ১১৪।

বোলিং: ইশান্ত ১০-২-৩১-০, উমেশ ১১-৫-৩৪-১,

বিনি ১১-৩-২৪-০, অশ্বিন ১৪-২-৩৭-১, মিশ্র ৭-১-৯-১।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement