ফিনিশার: ৭২ বলে ৫৯। অভিজ্ঞতার মূল্য বোঝাচ্ছেন ধোনি। এএফপি
বিরাট কোহালির প্রিয় অভিনেতার তালিকায় জনি ডেপের নাম থাকলেও জিম ক্যারির নামটা সম্ভবত নেই। কিন্তু ‘দ্য মাস্ক’ সিনেমার নায়কের থেকে স্বপ্নপূরণের টোটকাটা তিনি নিতেই পারেন।
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে জিম ক্যারিকে যখন হলিউডে জায়গা পাওয়ার জন্য লড়াই করতে হচ্ছে, তখন একটা অদ্ভুত কাজ করেছিলেন তিনি। নিজেই নিজের নামে একটা এক কোটি ডলারের চেক লিখেছিলেন। চেকে তারিখ দিয়েছিলেন, ১৯৯৪। চেকের ওপর লেখা ছিল, অভিনয় করার প্রাপ্তি। চেকটা চোখের সামনে রাখতেন তিনি, আর নিজেকে বলতেন, ‘‘পারতেই হবে আমাকে।’’ ’৯৪ সালে এসেই ‘ডাম্ব অ্যান্ড ডাম্বার’ সিনেমার জন্য ওই অঙ্কেরই চেক পারিশ্রমিক হিসেবে পেয়েছিলেন জিম ক্যারি!
কোহালি এ রকম কোনও ‘মনোবল বৃদ্ধিকারক টনিক’ রাখেন কি না, জানা নেই। যদি না রাখেন, ২ মার্চ, ২০১৯ তারিখ থেকে একটা ছবি ঘরের দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখতে পারেন ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ পর্যন্ত।
আজ থেকে এগারো বছর আগে, এই তারিখেই অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ জিতে নিয়েছিলেন কোহালি। বিশ্বকাপ হাতে কোহালির যে ছবি আইসিসি-ই টুইট করে এ দিন প্রায় ভাইরাল করে দিয়েছে। তা এ হেন ছবিটা আগামী কয়েক মাসে ঘরের দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখতেই পারেন কোহালি। যে ছবি তাঁকে প্রতিনিয়ত বলবে, ‘‘দেখো, ক্যাপ্টেন বিরাট। তুমি একবার পেরেছিলে। তুমি আবার পারবে।’’
শনিবার দুপুরে উপ্পলে রাজীব গাঁধী আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ঢোকার রাস্তায় দু’পা হাঁটতে না হাঁটতেই ধাক্কা লাগছিল জার্সিধারী শরীরগুলোর সঙ্গে। হাজার রকমের চেহারা, কিন্তু জার্সি দু’টো এক। একটার পিছনে লেখা কোহালি, অন্যটার ধোনি। এদের মধ্যে কেউ কেউ সামান্য উদ্বিগ্ন, ধোনি শেষ পর্যন্ত খেলবেন তো? তা, হাতের চোট এবং শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে মাহি দুপুরেই দাঁড়িয়ে পড়লেন উইকেটের পিছনে। আর রাতে কেদার যাদবের সঙ্গে ১৪৯ বলে ১৪১ রানের জুটি গড়ে মাঠ ছাড়লেন দলকে জিতিয়ে। নিজের ৭১তম হাফসেঞ্চুরি এল। তার সঙ্গে রোহিত শর্মার ওয়ান ডে ম্যাচে ছয় মারার (২১৫) রেকর্ডকে পিছনে ফেলে দিলেন। ওয়ান ডে ম্যাচে ধোনির মোট ছয় ২১৬। আর হ্যাঁ, উইনিং শটও এল তাঁর ব্যাট থেকেই।
বিশ্বকাপ দলে ধোনির থাকা উচিত কি না, এ নিয়ে প্রায় জাতীয় বিতর্কের আসর বসেছিল কিছু দিন আগেও। কিন্তু সেই বিতর্ককে মোটামুটি চুপ করিয়ে দিয়েছেন তিনি। খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে ক্যাপ্টেন কুল যখন যান, তখন নিজেকে অনুপ্রাণিত করার নিজস্ব একটা রাস্তা আছে ধোনির। নিজের সাফল্যের ইনিংসগুলোর ভিডিয়ো ক্লিপিংস নিভৃতে দেখেন। আর কল্পনা করেন, এই ব্যাটিংটাই আবার ক্রিজে গিয়ে করছেন।
স্কোরকার্ড
অস্ট্রেলিয়া ২৩৬-৭ (৫০)
ভারত ২৪০-৪(৪৮.২)
অস্ট্রেলিয়া
খোয়াজা ক শঙ্কর বো কুলদীপ ৫০•৭৬
ফিঞ্চ ক ধোনি বো বুমরা ০•৩
স্টোয়নিস ক কোহলি বো কেদার ৩৭•৫৩
হ্যান্ডসকম্ব স্টাঃ ধোনি বো কুলদীপ ১৯•৩০
ম্যাক্সওয়েল বো শামি ৪০ •৫১
টার্নার বো শামি ২১•২৩
ক্যারি ন. আ. ৩৬•৩৭
কুল্টার-নাইল ক কোহলি বো বুমরা ২৮•২৭
প্যাট কামিন্স ন. আ. ০•০
অতিরিক্ত ৫
মোট ২৩৬-৭ (৫০)
পতন: ১-০ (ফিঞ্চ, ১.৩), ২-৮৭ (স্টোয়নিস, ২০.১), ৩-৯৭ (খোয়াজা, ২৩.৫), ৪-১৩৩ (হ্যান্ডসকম্ব, ২৯.৬), ৫-১৬৯ (টার্নার, ৩৭.৫), ৬-১৭৩ (ম্যাক্সওয়েল, ৩৯.৫), ৭-২৩৫ (কুল্টার-নাইল, ৪৯.৫)।
বোলিং: মহম্মদ শামি ১০-২-৪৪-২ , যশপ্রীত বুমরা ১০-০-৬০-২, বিজয় শঙ্কর ৩-০-২২-০, কুলদীপ যাদব ১০-০-৪৬-২, রবীন্দ্র জাডেজা ১০-০-৩৩-০, কেদার যাদব ৭-০-৩১-১।
ভারত
রোহিত ক ফিঞ্চ বো কুল্টার-নাইল ৩৭•৬৬
শিখর ক গ্লেন বো কুল্টার-নাইল ০•১
কোহালি এলবিডব্লিউ বো জ়াম্পা ৪৪•৪৫
রায়ডু ক ক্যারি বো জ়াম্পা ১৩•১৯
ধোনি ন. আ. ৫৯•৭২
কেদার ন. আ. ৮১•৮৭
অতিরিক্ত ৬
মোট ২৪০-৪ (৪৮.২)
পতন: ১-৪ (ধওয়ন, ১.১), ২-৮০ (কোহালি, ১৬.৬), ৩-৯৫ (রোহিত, ২০.৫), ৪-৯৯ (রায়ডু, ২৩.৩)।
বোলিং: জেসন বেহরেনডর্ফ ১০-০-৪৬-০, নেথান কুল্টার-নাইল ৯-২-৪৬-২, প্যাট কামিন্স ১০-০-৪৬-০, অ্যাডাম জ়াম্পা ১০-০-৪৯-২, মার্কাস স্টোয়নিস ৯.২-০-৫২-০।
অতীতের সেই ধ্বংসাত্মক ধোনি হয়তো আর ফিরবে না, কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এক ক্রিকেটারকে এখন দেখা যাচ্ছে, যিনি সম্ভবত নিজের লক্ষ্যটা ঠিক করে ফেলেছেন। যে লক্ষ্য হল, উত্তরসূরির হাতে বিশ্বকাপটা তুলে দেওয়া। এ দিন ৪৫ বলে ৪৪ রান করে ফিরে গিয়ে ড্রেসিংরুম থেকে দলের জয়টা দেখলেন কোহালি। সঙ্গে একটা ছোট্ট প্রার্থনাও কি করেননি ভারত অধিনায়ক— হে ঈশ্বর, কেদারের যেন আর হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট না লাগে!
ইদানীং একটা কথা খুব ওড়াউড়ি করছে। কেদার যাদব যে ‘বোলার’-কে সব চেয়ে বেশি ভয় পান, তার নাম ‘হ্যামস্ট্রিং’। কত বার যে তিনি ‘ক ও বো হ্যামস্ট্রিং’ আউট হয়েছেন ইয়ত্তা নেই।
শনিবারও দেখা গেল, কামিন্স-জ়াম্পা-কুল্টার নাইলদের সহজেই সামলে দিলেন তিনি। উইকেটের মধ্যে খরগোশের ক্ষিপ্রতায় ছুটলেন। তাঁর হাফসেঞ্চুরি এল ৬৭ বলে। পঞ্চাশ পেরনোর পরে রীতিমতো আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন। শেষ করলেন ৮৭ বলে ৮১ রানে অপরাজিত থেকে। গত বছর এশিয়া কাপ ফাইনালে চোট নিয়ে ফিরে এসে প্রায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দলকে জিতিয়েছিলেন। এ দিন দৃপ্ত ভঙ্গিতে ধোনিকে পাশে নিয়ে মাঠ ছাড়লেন।
বিশ্বকাপ কাউন্টডাউন ভারত শুরু করল অস্ট্রেলিয়াকে ছয় উইকেটে হারিয়ে। কিন্তু দলের ব্যাটিংয়ের চেয়েও অধিনায়ককে বেশি স্বস্তি দেবে দলের বোলারদের ফর্ম। আগুনে গতিতে বল করলেন মহম্মদ শামি। প্রথম স্পেলে ব্যাটসম্যানদের প্রায় বল ছুঁতে দেননি। প্রথম স্পেলের হিসেব ছিল ৪-২-৬-০। যশপ্রীত বুমরা চেনা ছন্দে ছিলেন না। তা সত্ত্বেও অস্ট্রেলিয়া আটকে গেল ২৩৬-৭ রানে। কুল-চা জুটি ভেঙে গেলেও (যুজবেন্দ্র চহালের বদলে এ দিন রবীন্দ্র জাডেজা খেললেন) কুলদীপ যাদব (২-৪৬) ইনিংসের মাঝে উইকেট তুলে নিলেন। উল্টো দিক থেকে রান আটকানোর কাজ করলেন জাডেজা। ভারতীয় বোলিংয়ের একমাত্র দুর্বল দিক ছিলেন বিজয় শঙ্কর। তিন ওভারে ২২ রান দেওয়ার পরে বাকি সাত ওভারে অস্ট্রেলিয়াকে আটকালেন কেদার।
বিশ্বকাপ কাউন্টডাউনের প্রথম ম্যাচ থেকে ভারত শুধু জয়ই পেল না। এক জন অলরাউন্ডারকেও পেল। যিনি ‘সাইড আর্ম ওভার দ্য উইকেট’ বল করতে এসে ব্যাটসম্যানকে সমস্যায় ফেলবেন। রান আটকাবেন। উইকেট তুলবেন। আবার চাপের মুখে ঠান্ডা মাথায় ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলবেন প্রায় ফিনিশারের ভূমিকাতে।
হার্দিক পাণ্ড্য, বিজয় শঙ্কর ইত্যাদি অলরাউন্ডারের ভিড়ে কেদার যাদব কিন্তু বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন, তাঁর নামটাও সেই তালিকায় রাখা যায়। এবং, বেশ উপরের দিকেই।