জয়ধ্বনি। বুধবার চেন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে।
ভারত ১৪৬-৭ (২০ ওভার)
বাংলাদেশ ১৪৫-৯ (২০ ওভার)
অপার ক্রিকেট-বোধ আর সমর্থনের সাম্যবাদে ইডেন যদি দেশের এক নম্বর স্টেডিয়াম হয়, চিন্নাস্বামী অনায়াসে তার বৈমাত্রেয় ভাই। ভারতবর্ষের আর পাঁচটা শহরের চেয়ে কর্নাটকের এই ভূখণ্ডের মনন বরাবরই একটু স্বতন্ত্র। এখানে রাত বারোটাতেও পাব খোলা থাকে। বেঙ্গালুরুর ক্রিকেট-মাঠের আবেগ স্ফুরণের ভঙ্গিমাও ভিন্নধর্মী। ইডেনের মতো মেক্সিকান ওয়েভ এখানে ওঠে না। এখানকার ক্রিকেট দর্শক অত সমঝদারের উর্দি চাপিয়ে নামে না, যেমন নামে ইডেন। বিপক্ষের ভাল ক্রিকেটের এখানে কোনও মর্যাদা নেই। বরং ভাল করলে গ্যালারি থেকে ব্যাঙ্গাত্মক বিদ্রূপ উড়ে আসা অবশ্যম্ভাবী। রাহুল দ্রাবিড়ের শহরে প্রতিপক্ষ শুধুই প্রতিপক্ষ, যার বিরুদ্ধে জনতার জঙ্গিমনোভাবাপন্ন হওয়াটাই একমাত্র ধর্ম।
রাতের এ হেন চিন্নাস্বামীকে দেখা গেল, বদ্ধ উন্মাদে পরিণত! চেয়ারের উপর লাফিয়ে উঠে পাগলের মতো নাচছেন কেউ কেউ। ‘ভারত-আর্মি’ আবার নাগাড়ে তেরঙ্গা দুলিয়ে যাচ্ছে, দুলিয়েই যাচ্ছে। যেন একটু আগে হার্দিক পাণ্ড্যকে দেওয়া মুশফিকুর রহিমের দাত খিঁচুনির উত্তর! প্রতি মুহূর্তে বুঝিয়ে দেওয়া রাতের পাব আজ আর বন্ধ হবে না। দোলপূর্ণিমার পূণ্যলগ্নে নির্ঘুম রাত কাটবে বেঙ্গালুরুর। গ্যালারি ছেড়ে এ বার প্রেসবক্সে ঢুকুন, মাঠে দেখুন। বাংলাদেশ কোথায়, আজ তো অনাবেগী বলে বিশ্বে পরিচিত ভারতীয় সাংবাদিকরা ঝোড়ো হাততালিতে ফেটে পড়ছে! উঠে দাঁড়িয়ে টিমের উদ্দেশে জয়ধ্বনি দিচ্ছে। আর মাঠ?
চিন্নাস্বামীর সেই রোমাঞ্চকর শেষ ওভার: চতুর্থ বলে আউট মুশফিকুর। শেষ বলে রানআউট মুস্তাফিজুর।
সেখানে আশিস নেহরা এখন যুবরাজের কোলে। মহেন্দ্র সিংহ ধোনি বাকি দশের মধ্যে কোথায় হারিয়ে গিয়েছেন, বোঝা যাচ্ছে না। হার্দিক পাণ্ড্য ছুটে চলেছেন দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে। দেখলে মনে হবে, ভারত বোধহয় বুধবার বিশ্বচ্যাম্পিয়নই হয়ে গেল!
আসলে ক্রিকেটে এক-একটা ম্যাচ মাঝেমধ্যে ঘটে যায়, যাকে শব্দকোষের বন্ধনীতে ধরা অসম্ভব। বুধবার বেঙ্গালুরুর ভারত বনাম বাংলাদেশ ঠিক সেটাই হয়ে উঠল। যেখানে ম্যাচের মাথা থেকে পা পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকল টেনশনের শিরশিরানি, দু’দেশের সমর্থককুলকে চার ঘণ্টা কাটাতে হল দাঁতে সরবিট্রেট চেপে। এক কথায়, চলতি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ‘দ্য ম্যাচ’ খেলে ফেলল মহেন্দ্র সিংহ ধোনির ভারত। জিতল কি না এক, মাত্র এক রানে!
চিন্নাস্বামী এর পর পাগল হবে না? ধোনির ঘাড়ে বাকিরা উঠে পড়ে তাঁকে অদৃশ্য করে দেবেন না? এ সব আজ হবে না তো আর কবে হবে?
ম্যাচ শেষে কোনও কোনও বাংলাদেশ-সাংবাদিককে দেখা গেল, হতাশায় ডুবে যেতে। স্বাভাবিক, খুব স্বাভাবিক। সত্যি কথা সহজে স্বীকার করে নেওয়াই ভাল। বাংলাদেশ বুধবার বীরের ক্রিকেট খেলেছে। এক দিক থেকে দেখলে ভারত আজ জেতেনি, বাংলাদেশ হেরেছে। ভাবা যায়, একটা টিম যার কি না আসল দুই বোলারই নেই, টিমের মনোবল গুঁড়িয়ে গিয়েছে গ্রুপ লিগের মাঝপথে, বিশ্বকাপে বেঁচে থাকার স্বপ্ন যাদের হচ্ছে ধূসর থেকে ধূসরতম, তারাই কি না শেষ বল পর্যন্ত লড়াই উপহার দিয়ে গেল!
জয়ের উৎসব টিম ধোনির।
ম্যাচ শুরুর আগে একটা টুইট চোখে পড়ল যে, মাশরফি মর্তুজা আজ বাঁ হাতে বল করছেন! কারণ তাসকিন আহমেদ নামক তাঁর ডান হাত পুরোপুরি বাদ গিয়েছে দোলের সকালে। ঠিকই তো। এ দিন সকালেই আইসিসির মেল ঢুকেছে যেখানে লেখা, বিশ্বকাপে তাসকিন নির্বাসিতই। তখনকার মতো মনে হচ্ছিল, মাশরাফিরা এর পর আরও নিষ্প্রভ হয়ে পড়বেন। ভারত হয়তো নির্বিবাদে ম্যাচটা জিতে বেরিয়ে যাবে। ভাবা যায়নি, দুঃখের ক্ষত থেকে এমন প্রত্যুত্তরের বারুদের জন্ম হতে পারে বলে!
চিন্নাস্বামীর চটচটে, স্লো উইকেটে ভারত যে রানটা তুলেছিল খারাপ নয়। পিচে প্রথম থেকেই বল এতটা থমকে থমকে আসছিল যে, মনেই হচ্ছিল এ উইকেটে একশো আশি হবে না। ১৪৭ তাই জয়ের স্কোরই ছিল। কিন্তু তামিম ইকবাল রান তাড়া করতে নেমে যে ২০০৭ বিশ্বকাপ মনে পড়িয়ে দেবেন, কে জানত! পরে তামিম গেলেন, কিন্তু সাকিব ধরলেন। টেনশনটা তাই থেকেই যাচ্ছিল ক্রমাগত। কখনও ৭০ বলে ৮৩ চাই। কখনও ৪২ বলে ৫৫। বাংলাদেশের হাতে আরও গোটা কয়েক উইকেট, ভারতবাসী নিশ্চিন্তে বসবে কী?
এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে ক্যাপ্টেন কুল কিছু ভুল করতে শুরু করলেন। এমনিতেই ভারতীয় ফিল্ডিং এ দিন খারাপ হয়েছে। চারটে ক্যাচ পড়েছে। মিসফিল্ড হয়েছে। যেগুলো না ঘটলে ম্যাচটা হয়তো উত্তেজনার স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছতই না। তার মধ্যে অধিনায়ক ধোনি খুব সহজ কিছু ভুল করে বসলেন। যেমন, অশ্বিনের চারটে ওভারই ১৩ ওভারের মধ্যে শেষ করে ফেলা। ঘূর্ণিতে ডেথ ওভার বোলিংয়ের সময় অশ্বিনকে আর পাওয়াই গেল না। জসপ্রীত বুমরাহকে আচমকা তামিমের সামনে ফেলে দেওয়ার সিদ্ধান্তটাও অদ্ভুত। তামিমের ক্যাচ তার পাঁচ মিনিট আগে বুমরাহ ফেলেছেন। বছর বাইশ-তেইশের তরুণ তিনি, নার্ভের উপর চাপ তো পড়বেই। বুমরাহ ওই ওভারে পরপর চারটে চার খেলেন। ম্যাচ ওখানে আরও গনগনে হয়ে গেল।
কিন্তু মহানাটকের আরও বাকি ছিল। যা চলল শেষ বল পর্যন্ত। কে বিশ্বাস করবে যে শেষ ওভারে এগারো প্রয়োজন, এ অবস্থা থেকে লক্ষ্য মাত্র ৩ বলে ২ রানে নামিয়ে এনেছিলেন মুশফিকুর রহিম। পরপর দু’টো বাউন্ডারি মেরে। কে জানত, এর পরেও নাটক লুকিয়ে থাকবে।
হার্দিকের তৃতীয় বলে চালাতে গিয়ে উঁচু ক্যাচ তুললেন মুশফিক। শিখর ধবন ধরতে ভুল করলেন না। পরেরটা এ বার মাহমুদউল্লাহ, সেই আকাশে বল, নীচে জাডেজার নির্ভুল হাত। শেষ বলে দুই চাই, সামনে মুস্তাফিজুর। হার্দিকের বল ব্যাটে বলে হল না, মুস্তাফিজ দৌড় দিলেন সুপার ওভারের লক্ষ্যে। উইকেটের পিছন থেকে আরও একজন ছুটে আসছেন, তিনি মহেন্দ্র সিংহ ধোনি, আসছেন উইকেটটা ভাঙতে।
রান আউট না নটআউট?
রান আউট না নট আউট?
এমএসডির টিম সেমিফাইনাল দেখছে!
পিটিআই ও উৎপল সরকারের তোলা ছবি।