পড়শিদের আবদারে রান্নায় হাত লাগাল অভিজিৎ। নিজস্ব চিত্র
ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ১১টা ২০ মিনিট। ছাইরঙা চার চাকা গাড়িটা পাড়ার মোড়ে থামতেই দুমদাম বাজি ফাটতে শুরু করল। উজ্জ্বল ফুলকিতে তখন রং ছড়াচ্ছে তুবড়ি। ব্যান্ডপার্টি বাজছে। হাফ প্যান্ট আর ডেনিম শার্ট পরিহিত ছেলেটা গাড়ি থেকে নামতেই একসঙ্গে কয়েকশো মানুষ ‘অভিজিৎ, অভিজিৎ’ করে চিৎকার করে উঠল। কেউ কেউ ফুল ছুঁড়তে শুরু করল। সরু গলির দু’ধারে তখন সার দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন মহিলারা। যাঁদের অনেকেই পাড়ার ছেলেকে দেখার জন্য টিভিতে প্রথমবার ফুটবল ম্যাচ দেখতে বসেছিলেন।
অনূর্ধ্ব ১৭ বিশ্বকাপে তিনটে ম্যাচ হেরেই বিদায় নিয়েছে ভারত। তবে তাদের লড়াই গর্বিত করেছে দেশবাসীকে। সেই দলের অন্যতম ভরসা অভিজিৎ সরকার ব্যান্ডেল কেওটার হেমন্ত বসু কলোনির ছেলে। বিশ্বকাপের আগে এই এলাকার রাস্তাঘাট অভিজিতের ছবি ও জাতীয় পতাকা দিয়ে সাজানো হয়েছিল। খেলা দেখার জন্য লাগানো হয়েছিল জায়ান্ট স্ক্রিন। অভিজিৎ গোল না পেলেও গোলের সুযোগ পেয়েছিল। তাতেই খুশি গোটা পাড়া।
পাড়ার ছেলেকে বরণ করে নিতে আয়োজনে কোনও কমতি ছিল না শুক্রবার রাতে। শুক্রবার দুপুরে অভিজিৎ ফোন করে বাড়ি ফেরার কথা জানিয়েছিল। তখন থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যা নামতেই প্রায় গোটা পাড়া রাস্তায় নেমে আসে। খুদে, বৃদ্ধ, ছাপোষা মহিলা— কে ছিলেন না সেই ভিড়ে! মাইকে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজছিল। কখনও কখনও গান থামিয়ে মাইক্রোফোনে ঘোষণা করা হচ্ছিল অভিজিতের ফিরে আসার কথা। সন্ধ্যা থেকেই অভিজিতের ছবি আর জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে পাড়াময় দৌড়ে বেড়াচ্ছিল খুদেরা। গাড়ি থেকে নামতেই বন্ধুদের কাঁধে চেপে স্থানীয় উন্নয়ন সমিতির ঘরের সামনে আসে অভিজিৎ। সেখানে তার গলায় মালা পড়িয়ে দেওয়া হল। ছড়ানো হয় রঙিন কাগজ। চলে দেদার মিষ্টিমুখ। সেলফি তোলার ধূম তো ছিলই। পড়শিদের ভিড়েই মিশেছিলেন বাবা হরেন সরকার আর মা অলোকাদেবী। সেখানেই মুরগির মাংস-ভাত রান্না হচ্ছিল। সেখানে রান্নাতে হাত লাগায় সে। রাস্তার ধারেই সকলের সঙ্গে খেতে বসে।
নিজের পাড়ায় এই অর্ভ্যথনা পেয়ে দৃশ্যতই আপ্লুত দেখাচ্ছিল দেশের ১০ নম্বর জার্সিধারীকে। দেশের হয়ে বিশ্বকাপ খেলে ফেললেও শিকড়কে ভোলেনি অভিজিৎ। তাই তো সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মাইক্রোফোন হাতে সে বলল, তাকে তৈরি করার পিছনে রয়েছেন ছোটবেলার কোচ অশোক মণ্ডল। সে যোগ করে, ‘‘মা-বাবা অনেক কষ্ট করে আমাকে বড় করেছে। বাবা, মা এবং অশোকবাবুর জন্যই আজ আমি এখানে পৌঁছেছি। আরও অনেক পথ যেতে হবে। দেশের সিনিয়র দলে খেলতে চাই।’’
গোটা পর্বে দেখা যায়নি জেলা প্রশাসন থেকে জন-প্রতিনিধি কিংবা কোনও ক্রীড়াকর্তাকে। শুক্রবার রাতে অবশ্য সে দিকে হুঁশ ছিল না হেমন্ত বসু কলোনির। ঘরের ছেলেকে নিয়ে তারা তখন আত্মহারা।