বিশ্বরেকর্ডের পর।
‘‘বাবা, আমি ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছি। এ বার কিন্তু তোমাকেও হতে হবে।’’
রাজস্থানের চুরু জেলা থেকে বিশ্বের অন্য প্রান্তের রিওয়, বাবার কাছে টেলিফোনে ভেসে এসেছিল ছ’বছরের জিয়ার উচ্ছ্বসিত গলা। অলিম্পিক্স স্টেডিয়ামে বিশ্বরেকর্ড গড়ে সোনা জিততে সেই আবদারটাই সবচেয়ে বেশি উদ্বুদ্ধ করে, বলে দিলেন দেবেন্দ্র ঝাঝারিয়া।
প্যারালিম্পিক্সে জ্যাভলিনের এফ৪৬ বিভাগে বারো বছরের ব্যবধানে দ্বিতীয় সোনা জেতার বেনজির কীর্তির পর এই মুহূর্তে যিনি ভারতীয় খেলার জগতে নতুন সুপারহিরো।
প্যারালিম্পিক্স হোক বা অলিম্পিক্স বা অ্যাথলেটিক্সের অন্য কোনও বিশ্ব মঞ্চ, এক ইভেন্টে দু’বার সোনা জেতার নজির কোনও ভারতীয়ের এই প্রথম। তা-ও দু’বারই বিশ্বরেকর্ড করে। ২০০৪ আথেন্সে সোনা ও বিশ্বরেকর্ড এসেছিল ৬২.১৫ মিটার ছুড়ে। রিওয় নিজের তৃতীয় থ্রো-এ পার করলেন ৬৩.৯৭ মিটার। হাইজাম্পার থঙ্গভেলু মারিয়াপ্পানের পর রিওয় যা ভারতের দ্বিতীয় সোনা। বরুণ ভাটির ব্রোঞ্জ আর দীপা মালিকের রুপোর পর চতুর্থ পদক।
• আট বছর বয়সে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বাঁ হাত খোয়ান।
• স্কুলে পড়ার সময়েই জ্যাভলিনে জেলা চ্যাম্পিয়ন।
• ২০০১-এ একুশ বছর বয়সে ফার ইস্ট ও এশিয়া প্যাসিফিক গেমসে পদক।
• ২০০৪ আথেন্সে সোনা ও বিশ্বরেকর্ড। সেই বছরেই পান অর্জুন পুরস্কার।
• ২০১২-য় প্রথম প্যারা অ্যাথলিট হিসাবে পদ্মশ্রী।
• ২০১৩ বিশ্ব প্যারা মিটে সোনা।
• ২০১৬ প্যারালিম্পিক্সে বারো বছর পর আবার সোনা ও বিশ্বরেকর্ড।
অসাধারণ ইতিহাস গড়ার আনন্দে দু’ চোখ থেকে ঘুম নিরুদ্দেশ ছত্রিশ বছরের দেবেন্দ্রের। ‘‘আরে এখন আর ঘুম কোথায়? সারারাত জাতীয় পতাকা নিয়ে উৎসব করব,’’ বলছিলেন ২০১৪-য় পদ্মশ্রী পাওয়া ভারতের একমাত্র প্যারা অ্যাথলিট। রিওয় তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। ভারতে বুধবার ভোরের আলো ফুটছে। প্যারা গেমসে জ্যাভলিনে বিশ্বের সর্বকালের সেরাদের দলে ঢুকে পড়া দেবেন্দ্রও অপেক্ষা করছিলেন সেই ভোরের। মেয়ে জিয়াকে খবরটা দিতে হবে যে। বাবাও পেরেছে!
সোনা ও বিশ্বরেকর্ডের মালিক বলছিলেন, ‘‘খবরটায় জিয়া সবচেয়ে বেশি খুশি হবে। রিও আসার আগে মেয়ে আমার সঙ্গে চুক্তি করেছিল। কিন্ডারগার্টেনের পরীক্ষায় ও ফার্স্ট হলে আমাকেও সোনা জিতে দেখাতে হবে। এখন ওর ঘুম ভাঙার অপেক্ষা করছি খবরটা দেব বলে।’’
জিয়ার ঘুম ভাঙার জন্য দেবেন্দ্রকে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি হয়তো। কিন্তু প্যারালিম্পিক্সে দ্বিতীয় বার নামার জন্য অপেক্ষা করতে হল পুরো এক যুগ। যে অপেক্ষাকে তিনি বলেছেন, ‘‘যেন কুম্ভ মেলার প্রতীক্ষায় বসেছিলাম এত দিন।’’
দেবেন্দ্র ঝাঝারিয়ার সোনার থ্রো।
প্যারালিম্পিক্সে প্রথম সোনা পেয়েছিলেন চব্বিশ বছর বয়সে। ২০০৪ আথেন্সের সেই সোনার পর তাঁকে নিয়ে দারুণ হইচই চলেছিল কিছু দিন। অর্জুন পুরস্কারটা তখনই পান। কিন্তু এমন কপাল বেজিং ও লন্ডন গেমসে তাঁর ইভেন্ট বাদ পড়ে যায়। অবশেষে রিওয় ফিরল এফ৪৬ জ্যাভলিন। তিনিও ফিরলেন পুরস্কার মঞ্চের সর্বোচ্চ ধাপটাতে।
মাঝে নিজের সেরা ফর্ম আর মোটিভেশন ধরে রাখার লড়াই। যে জন্য পরিবারের থেকে দূরে থেকেছেন টানা। দেবেন্দ্রের কথায়, ‘‘জিয়া তবু আমার সঙ্গে কখনও প্র্যাকটিসে গিয়েছে। ওর ছোট ভাইয়ের বয়স দুই। সে বাবা কাকে বলে জানেই না। আমার স্ত্রী মঞ্জু ছবি দেখিয়ে ওকে বাবা কে সেটা চেনায়।’’
কৃষক পরিবারের ছেলে নিজের বাঁ হাতটা হারিয়েছিলেন আট বছর বয়সে। গাছে চড়তে গিয়ে ডালে আটকে থাকা বিদ্যুতের হাই টেনশন তারে হাত পড়ে গিয়েছিল। প্রাণ বাঁচাতে হাসপাতালে কনুইয়ের তলা থেকে বাদ দিতে হয় হাত। তবে প্রাণ বাঁচলেও সমাজে মানুষ হিসাবে কমে যায় দাম। দেবেন্দ্রের কথায়, ‘‘সমবয়সিরা খেলত না। সবাই এড়িয়ে যেত।’’ দূরে ঠেলে দেওয়াটাই কিন্তু করে দেখানোর জেদকে ক্রমশ আরও মজবুত করে। আর ছিল মা জিবানী দেবী ও বাবার প্রেরণা। ‘‘সাধারণ বাচ্চাদের থেকে আমি বেশি ভাল দেখিয়ে দিতেই অ্যাথলেটিক্সে আসি।’’ সাধারণ বাচ্চাদের সঙ্গে তাঁকে প্রতিযোগিতায় দেখে লোকে এমনও বলেছে, ‘‘সুপারিশে এসেছে।’’ দেবেন্দ্র জিতে প্রমাণ করতেন যোগ্যতা। বাঁশের জ্যাভলিন নিয়ে লড়াই শুরু করা ছেলে জেলা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর অবশ্য টিটকিরি বন্ধ হয়। ২০০২-এ একুশ বছর বয়সে কোরিয়ায় জেতেন প্রথম আন্তর্জাতিক পদক। তার পর আথেন্স প্যারালিম্পিক্সে বিশ্বরেকর্ড ও সোনা।
মাঝের বারো বছর আসল চ্যালেঞ্জ ছিল প্রতিভায় মরচে ধরতে না দেওয়া। হিসার সাই-এ যে কাজে সাহায্য করেন কোচ সুনীল তনোয়ার। যাঁর পরামর্শে দেশে বিদেশে প্র্যাকটিস ও প্রতিযোগিতা করে গিয়েছেন। ২০১৩ লিয়ঁ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জেতার আগে ২০১২-য় পদ্মশ্রী প্রাপ্তি। তবে জাতীয় সম্মান আন্তর্জাতিক মঞ্চে সাফল্যের খিদেটা মেটাতে পারেনি। ২০১৪ এশীয় প্যারা গেমসের রুপোর পর ২০১৫ দোহা বিশ্ব মিটে জ্যাভলিনে জেতেন রুপো। বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে উঠে আসেন তিনে। তার পর চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুলাই ফিনল্যান্ডে গিয়ে তৈরি করেন নিজেকে। যেখানে কেনিয়ার থ্রোয়ার জুলিয়াস ইয়েগোর দারিদ্রকে হারিয়ে জেতার সংগ্রাম নতুন প্রেরণা দিয়েছিল দেবেন্দ্রকে।
দিনে সাত ঘণ্টা ট্রেনিং করতে করতেই ঠিক করে নেন, নিজের খেলাকে কিছু ফিরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু তারও আগে প্যারালিম্পিক্সে আরও একবার ওড়াতেই হবে জাতীয় ধ্বজা। রিওর অলিম্পিক স্টেডিয়ামে রাখলেন সেই প্রতিজ্ঞা।
এক যুগের প্রতীক্ষা শেষে কুম্ভ পূর্ণ হল দেবেন্দ্রের।
ছবি: পিটিআই।