আফগান-যুদ্ধ জিতে। ট্রফির সামনে উচ্ছল।
আফগানিস্তান-১ : ভারত-২
(আমিরি) ( জেজে, সুনীল)
ম্যাচটা লিখতে বসে প্রথমেই একটা কথা স্বীকার করে নিচ্ছি। জাতীয় দলকে বিশ্বাসের প্রশ্নে আই লিগ চ্যাম্পিয়ন কোচ অন্তত এ দিন ভুল করে ফেলেছে!
সাফ ফাইনাল শুরুর আগে দেশের জয়ের জন্য জোর গলায় বাজি ধরার আত্মবিশ্বাসটা পাচ্ছিলাম না। বলতে কোনও লজ্জা নেই যে, আমাকে ভুল প্রমাণিত করেছে সুনীল-অর্ণব-জেজেরা।
আর স্টিভন কনস্ট্যান্টাইনের যেটা আমার খুব ভাল লেগেছে, আইএসএল শেষ হওয়ার পর অল্প সময় জুনিয়রদের নিয়ে যে ভাবে ভারতীয় দলটাকে উনি সাফ কাপে মোটিভেট করেছেন। সন্দেশের জায়গায় অগাস্টিন, মন্দার-রোমিওদের বদলে হোলি-বিকাশ বেশ নজর কাড়ল।
অনেকে হয়তো বলবেন, ভারতের সাফ জিতে লাভ একটাই— স্টিভনের চাকরিটা বেঁচে গেল। সমালোচকদের খোঁচাটা খানিকটা নিষ্ঠুর সত্যিও। তবে তার চেয়েও বড় সত্যি— আফগানিস্তানকে একটা আন্তর্জাতিক ফাইনালে পিছিয়ে পড়েও ভারতের হারানোটা। যত কমই হোক, আমার মতো ভারতীয় ফুটবলসমাজের সমস্ত টেকনিক্যাল লোকের কাছে নতুন বছরের প্রথম রবিবারের জয়টা একটা নতুন আলো। এখনকার ভারতীয় ফুটবলে বিশ্বকাপ-অলিম্পিক তো বটেই, এশিয়াড-ই যখন অনেক দূর গ্রহের বস্তু তখন সাত নম্বর সাফ কাপ জয় আমাদের ছেলেদের একটু হলেও আত্মবিশ্বাস বাড়াবে। ভবিষ্যতের আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলোর জন্য।
ড্রেসিংরুমে উদ্দাম। ছবি পিটিআই, এআইএফএফ
দু’টো কারণে ভারতের আফগান-জয় তাৎপর্যের। এক, ওদের টিমের বেশির ভাগ ফুটবলারের ইউরোপে খেলার অভিজ্ঞতা। দুই, টুর্নামেন্টে ১৬ গোল করে ‘আমিরি’ চালে জার্মান কোচ পিটার সেগ্রেটের দলের দুরন্ত ফর্মে থাকা। ষোলোটার মধ্যে সেমিফাইনালেই আবার পাঁচ গোল!
ফাইনাল শুরুর আগে তীর্থের কাকের মতো টিভির দিকে তাকিয়েছিলাম দেখার জন্য যে, ভারতীয় কোচ মাঝমাঠ এবং অ্যটাকিং লাইন কী ভাবে সাজাচ্ছেন। কারণ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মলদ্বীপের চেয়ে এই আফগান টিম অনেক ভাল। ম্যাচের আগে ওরাই ছিল ফেভারিট।
ম্যাচ শুরুর পরেও দেখছিলাম সেটা। প্রথম পাঁচ মিনিট বাদ দিলে গোটা প্রথমার্ধে ভারতের মাঝমাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল আফগানদের তাহের, আমিরিরা। বোধহয় টুর্নামেন্টে আফগানিস্তানের ধারাবাহিক ফর্ম দেখে কনস্ট্যান্টাইন আর তাঁর ছেলেরা প্রতিদ্বন্দ্বীকে একটু বেশিই সমীহ করে ফেলেছিল। তা ছাড়া, দু’বছর আগের সাফ ফাইনালে এই আফগানদের কাছেই হারের জুজুটা বোধহয় প্রভাব ফেলেছিল সেই টিমে থাকা অর্ণবদের মনে।
ওই সময়টায় ভারতের খেলা ভাল না লাগার কারণ তিনটে। এক, বিকাশ জাইরু আর হোলিচরণ—দুই উইং হাফ অন্য দিন যে রকম আক্রমণে যায় ফাইনালের প্রথম পঁয়তাল্লিশ মিনিট তার কোনও চিহ্ন ছিল না। উল্টে নেমে এসে চূড়ান্ত ডিফেন্সিভ ভূমিকা নিচ্ছিল।
দুই, সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে রওলিন বর্জেস ছেলেটার দিশাহীন ফুটবল। তিন, বল পেলেই তখন ভারতের ডিফেন্স আর মাঝমাঠ সোজা তুলে দিচ্ছিল আফগানদের অ্যাটাকিং থার্ডে। আর এরিয়াল বলে লম্বা আফগানরা জেজে-সুনীলদের কম উচ্চতার ফায়দা তুলে যাচ্ছিল।
কিন্তু সেই দুঃসহ বোতলবন্দি অবস্থাটাই ভারত নিজের দিকে এনে ফেলল কোচের একটা মাস্টারস্ট্রোক আর তাঁর দলের তারুণ্যের জোশে।
দ্বিতীয়ার্ধে দেখলাম, বিকাশকে ডান দিক থেকে ওর পছন্দের জায়গা বাঁ দিকে আর হোলিচরণকে বাঁ দিক থেকে ডান দিকে পাল্টাপাল্টি করে দিলেন স্টিভন। এতে প্রথমত ধোঁকা খেল আফগানিস্তান। সঙ্গে লং বল থিওরি ভুলে সুনীলরা শুরু করল ছোট পাসে আক্রমণ। ভারত অবশ্য এই সময়ই গোলটা খেল বটে তবে সেটা আফগানিস্তানের একটা দুরন্ত মুভে। গোলটার জন্য অনেকেই হয়তো বলবেন অর্ণব ফলো করতে ভুল করেছিল আমিরিকে। কিন্তু আমি বলব ভুলটা রওলিনের। কারণ ও যদি ঠিক জায়গায় দাঁড়িয়ে ব্লকিং করত, তা হলে কিন্তু ওই ‘ডিফেন্স ব্রেকিং’ পাসটা হয় না আফগানিস্তানের।
এক গোলে পিছিয়ে গিয়েও প্রীতমরা ম্যাচে ফিরতে পারল অদম্য জেদ, সুনীলের বরফ শীতল মাথায় টিমটাকে গাইড করা আর হার না মানা মনোভাব থেকে। ততক্ষণে ভারত কোচ বুঝে গিয়েছিলেন আফগানদের সবচেয়ে নড়বড়ে জায়গা তাদের দুই স্টপার। আর সেটা কাজে লাগিয়েই জেজের প্রথম গোল।
আর এক বার ১-১ হতেই কিন্তু ঘরের মাঠ ঠাসা সমর্থকদের সামনে ফাইনালের রাশ হাতে তুলে নিয়েছিল ভারতীয়রা। সুনীলও অনেকটা সেই টোটকাতেই করে গেল সাফে ওর ভারতীয় রেকর্ড গড়ার গোলটা। যেটা আরও স্মরণীয় কেননা সেটা ওর টিমের সাফ ট্রফি জয়ের গোলও।
আমি অবশ্য এ সবের সঙ্গে আরও একটা পজিটিভ দেখছি ভারতীয় দলে। মাঝের কয়েক বছরে জাতীয় দলে বাঙালি ফুটবলারের সংখ্যাটা হুড়হুড় করে কমছিল। ছবিটা আবার বদলাতে শুরু করেছে সাফ কাপে। এ দিনই তো ফাইনালের ডিফেন্সে তিন জন বঙ্গসন্তান—প্রীতম, অর্ণব, নারায়ণ। পরে নামা প্রণয়, স়ঞ্জুরাও বাংলার ছেলে। বছরের শুরুতেই যা দেখতে পেয়ে আরও ভাল লাগছে।
তবে একইসঙ্গে ফাইনালে ভাগ্যকেও ধন্যবাদ দিতে হবে ভারতকে। অতিরিক্ত সময় অর্ণবের হ্যান্ডবল এবং বক্সে বিকাশের ফাউল থেকে রেফারি পেনাল্টি দিলে বলার কিছুই থাকত না।
যদিও ভাগ্য সাহসীদেরই সহায় হয়। আর সেই সাহসটা ফাইনালে দেখিয়েই বাজিমাত কনস্ট্যান্টাইনের।
ভারত: গুরপ্রীত, প্রীতম, অর্ণব (আইবর), অগাস্টিন, নারায়ণ, হোলিচরণ, লিংডো (প্রণয়), রওলিন, বিকাশ (সঞ্জু), জেজে, সুনীল। (৩৬০ কর্পোরেট রিলেশনস)
স্টিভন কনস্ট্যান্টাইন : আমার কোচিং কেরিয়ারে অন্যতম স্মরণীয় দিন। সব বাধার বিরুদ্ধে জিতলাম। প্রত্যেক ফুটবলার সব কিছু উজাড় করে দিয়েছে। দলটা এক হয়ে খেলেছে।
সুনীল ছেত্রী : একটা তরুণ দল নিয়ে টুর্নামেন্ট জেতা সহজ নয়। আমরা সেটা করে দেখিয়েছি। ছেলেদের বলেছিলাম, হারা চলবে না। এই জয় রবিন সিংহকে উৎসর্গ করতে চাই। ওকে হারানোটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক ছিল।