বৃহস্পতির চিন্নাস্বামী। অভিনব ‘ক্যানোপি কভার’-এ ঢাকা পড়েছে পিচ।
বেঙ্গালুরুর হলটা কী? হঠাৎ বদলে গেল নাকি?
বদলের উপসর্গ চিন্নাস্বামীর মধ্যিখানে সাদা ওই বিশাল ওয়াটারপ্রুফ ওভারহেড কভারটা নয়। যা প্রায় দু’হাজার স্কোয়ারফিট জায়গা নিয়েছে আর যার ভেতর অনায়াসে চল্লিশ-পঞ্চাশজন মিলে বারবিকিউ করে ফেলা যায়। এ দিন সকাল ন’টা নাগাদ বেঙ্গালুরু বিমানবন্দরে নামামাত্র যে হিমেল হাওয়াটা বিঁধল, তা অবিকল ডিসেম্বরের দিল্লি! তামিলনাড়ু উপকুলে উদ্ভূত একটা নিম্নচাপ এমনই জোরালো হয়ে গত ক’দিন বেঙ্গালুরুতে আছড়েছে যে বর্ষাবিক্ষত রাস্তায় গর্ত তৈরি আর জমে থাকা জল-কাদায় মানুষের কী পরিমাণ ভোগান্তি হয়েছে তারই গল্প শুনছিলাম সারা দিন।
রবিচন্দ্রন অশ্বিন আবার ভারতকে জেতাতে পারবেন কি না? নিজের শততম টেস্টে এবি ডে’ভিলিয়ার্স সিরিজ ১-১ করার দৌড়ে কী পরিমাণ সফল হবেন? এ সব আলোচনা আপাতত খবরের দ্বিতীয় সারিতে। ব্রেকিং নিউজ ক্যাটাগরিতে নেই।
বেঙ্গালুরু এখন উত্তপ্ত তার আইনশৃঙ্খলার অভাব আর অশান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে। বৃহস্পতিবার নিয়ে টানা এক মাসে তিনটে ধর্ষণের ঘটনা এই শহরে। যা ভাবাই যায় না। বেঙ্গালুরু সম্ভবত ভারতের একমাত্র শহর যেখানে রাত একটা অবধি পাব খোলা থাকে। কত কলেজের ছাত্রছাত্রী আর মহিলা এগজিকিউটিভরা পানশালাগুলো থেকে বেরিয়ে এত কাল নির্ভয়ে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট করে বাড়ি ফিরেছে। কখনও কোনও সমস্যা হয়নি। কলকাতায় শয়ে শয়ে অভিভাবকও তো নির্ভয়ে ছেলেমেয়েকে বেঙ্গালুরু পড়তে পাঠিয়েছেন। আর যাই হোক অপরাধপ্রবণ শহর নয়। হালফিলের মোটামুটি সব সমীক্ষায় ভারতের এক নম্বর আইটি সিটি হিসেবেও এগিয়ে।
অথচ এ দিন সেই শহরেরই অধিবাসীদের মুখে লাগাতার আলোচনা, হচ্ছেটা কী? এ ভাবে চললে তো দিল্লির মতো বদনাম হয়ে যাবে!
শহরের রাজনৈতিক আকাশেও পরিবর্তনের হিংস্র গেরুয়া রঙ। গিরিশ কারনাড এখানকার মানুষের কাছে খুব শ্রদ্ধেয়। অনেকটা গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথের মতো। বিশ্বনাথের বাড়ি থেকে জেপি নগরে কারনাডের বাড়ি খুব একটা দূরেও নয়। তা বেঙ্গালুরু এয়ারপোর্ট টিপু সুলতানের নামে হওয়া উচিত ছিল বলে ফেলায় কারনাড যে গতকাল থেকে এই শহরে অগ্নিগর্ভ উত্তেজনা তৈরি করে ফেলবেন কেউ ভাবেওনি। ভারতের সবচেয়ে প্রগতিশীল শহর বলে খ্যাত সমতলভূমিতে কুশপুতুল পোড়ানো। উত্তেজক মিছিল করা। কারনাডের বাড়িতে গিয়ে অনুব্রতর ভঙ্গিতে শাসানো এগুলো সচরাচর ঘটে না।
সেটা নিয়েও বিস্ময়। হতাশা। আর খানিক টেনশন। এর পর কী? এর পর কে?
তালেগোলে মনে হচ্ছে ডে’ভিলিয়ার্সের শততম টেস্ট খেলার হাইপটা নো নেটওয়ার্ক হয়ে গেল। স্থানীয় ফুটবল টিম অবশ্য গতকাল জার্সি দিয়ে তাঁকে সম্মান জানিয়েছে। আই লিগে বেঙ্গালুরু এফসি-র হয়ে তিনি কয়েকটা ম্যাচে গলা ফাটাবেন এমন কথাও দিয়েছেন ডে’ভিলিয়ার্স। ভারতীয় বোর্ড ম্যাচের প্রথম দিন তাঁকে সম্মান জানাচ্ছে। কর্নাটক ক্রিকেট সংস্থা জানাবে। দক্ষিণ আফ্রিকান টিম কিছু করবে। গ্রেম স্মিথের শততম টেস্টে তাঁকে স্পনসররা বিশেষ জুতো, ব্যাট আর ব্যাটে নতুন লোগো তৈরি করে সম্মান জানিয়েছিল।
তা এবি ক্রিকেটার হিসেবে আরও বড়। এই মুহূর্তে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের অঙ্ক বিচারে দক্ষিণ আফ্রিকার জনপ্রিয়তম ক্রীড়াবিদ। ফুটবল বা রাগবি প্লেয়ারদেরও ছাপিয়ে। তাঁকে অনেকটা সচিনের মতো দেখা হয়। ক্যাপ্টেন হিসেবে ভাল নয় কিন্তু বিরাট ক্রিকেটার এবং জনমানসে নিষ্কলঙ্ক ভাবমূর্তি। দক্ষিণ আফ্রিকা যতই প্রথম বিশ্ব হোক, ক্রীড়াবিদদের মাঠের বাইরের জীবন কাটাছেঁড়ায় যথেষ্ট রক্ষণশীল।
ডে’ভিলিয়ার্সের বিবাহিত জীবনে স্থায়িত্ব তাঁকে যেমন বাড়তি সম্ভ্রম দিয়েছে তেমনই ভ্রূ কুঁচকে বিচার্য হয়েছে পাশাপাশি গ্রেম স্মিথের বিয়ে ভাঙার দিকে এগিয়ে যাওয়া। বা বার্থা ক্রোনিয়ের তাঁর স্বামীরই বিজনেস ম্যানেজারকে সাততাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেলা। এ দিন চিন্নাস্বামীতে দাঁড়িয়ে অভিজ্ঞ দক্ষিণ আফ্রিকান রিপোর্টার বলছিলেন, ‘‘কীসের ভালবাসা তোর হ্যান্সি মারা যাওয়ার পরপরই বিয়ে করে ফেললি। দুটো বাচ্চাও হয়ে গেল।’’
উপপাদ্য- ডে’ভিলিয়ার্স নিছক অতিথি দেশের নক্ষত্র নন। মহান রোল মডেল। বেঙ্গালুরু নানা কারণে স্থানীয় আইপিএল মহাতারকার কীর্তির নতুন সোপানে পা দেওয়ার আবেগ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মহল এবং ওই গোলার্ধের জো’বার্গ থেকে কেপটাউন- একই রকম আলোড়িত।
দারুণ লাগল এ দিন ডে’ভিলিয়ার্সের সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত থেকে। আরও অনেকের প্রাক একশো টেস্ট মিডিয়া-সাক্ষাৎ কভার করেছি। কাউকে ব্যক্তিগত কীর্তির মুকুট সম্পর্কে এত ইচ্ছাকৃত অন্যমনস্ক দেখিনি। জিজ্ঞেস করা হল শততম টেস্টের আগে আপনি কি চাপে? ডে’ভিলিয়ার্স বললেন, ‘‘চাপে তার জন্য নয়। চাপে আছি সিরিজে ০-১ পিছিয়ে বলে।’’ এও সাফ জানিয়ে দিলেন সিরিজের এই অবস্থায় এসে টিম ছেড়ে ব্যক্তিগত সৌধ নিয়ে নাচানাচির বিন্দুমাত্র শখ নেই তাঁর।
‘‘ওইসব একশো টেস্ট নিয়ে ভাবনা-টাবনা জীবনের পরের দিকে করার অনেক সময় পাওয়া যাবে। এখন একটাই লক্ষ, ১-১ করা।’’ ডে’ভিলিয়ার্স জেনেই সাংবাদিক বৈঠকে বসেছেন যে হঠাৎ করে আজকের প্র্যাকটিসে পাওয়া চোটে ভারনন ফিল্যান্ডার ম্যাচের বাইরে চলে গেলেন। আর ডেল স্টেইনের তখন ফিটনেস পরীক্ষা চলছে। খেললেও কতটা ঝাঁঝ থাকবে? টিমের এই অবস্থাতেও কী রোখ ডে’ভিলিয়ার্সের! বললেন, ‘‘ভারতকে হরানোর আগুন জড়ো করছি।’’ তাঁর প্রেস কনফারেন্সটাই যেন পুল আর হুকের প্রদর্শনী। দেখে মনে হচ্ছিল বড় প্লেয়ারের রান শুধু ব্যাট দিয়েই নয়, মাঠের বাইরে থেকেও আসে!
বৃষ্টিবাদলার দিনে যেমন তেলেভাজা আর মুড়িতে কলকাতাবাসী জমিয়ে আড্ডা মারে এ দিন তেমনই ম্লান আলোতে ভারত প্র্যাকটিস করার ফাঁকে মুখরোচক আড্ডা চলছিল অন্য একটা বিষয় নিয়ে।
চিন্নাস্বামীর পিচ কেমন ব্যবহার করবে? এই বৃষ্টি তার চরিত্র বদলে দেবে না তো? মানে তাকে যেমন ডিজাইনার করার চেষ্টা চলছিল, সেটা সফল হবে তো?
এ মাঠের সুধীর নায়েককে ফাঁকায় পেলাম না। পেলে তাঁকে সমবেত আশঙ্কার কথা জানানো যেত। চিন্নাস্বামীর শেষ দুটো টেস্ট ভারত জিতেছে ঠিক আছে। কিন্তু এ বারে সন্তোষজনক ঘূর্ণি করা যাবে তো?
বেঙ্গালুরু শহর যেমন বদলাচ্ছে- ক্রিকেট সারফেসও তার মতো আচমকা পাল্টে যাবে না তো?
ছবি: টুইটার ও পিটিআই।