দুশো মিটারেও মহামানব
ছোটবেলায় দু’পায়ে দু’রকম বুট পরে দৌড়োতেন। মা জেনিফার বোল্ট বারবার তাঁকে ট্র্যাকে যাওয়ার কথা বললেও ছোট্ট উসেইনের মন পড়ে থাকত গল্ফ কোর্সে। ছুতো পেলেই গল্ফ খেলতে চলে যেতেন। কিন্তু একবার স্কুলের স্পোর্টসে নেমে দৌড়ে তিনিই প্রথম হয়েছিলেন। তার পরেই স্প্রিন্টিংকে ভালবেসে ফেলা। একজন গল্ফারের স্বপ্ন শেষ হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু তাঁর এই সিদ্ধান্তেই তো অ্যাথলেটিক্স পেয়েছে তার অন্যতম প্রিয় সন্তানকে। তাঁকে দেখতেই তো আজ ভরে যায় গ্যালারি। তাঁর সঙ্গে সেলফি তোলা নিয়ে হইচই পড়ে যায়। তাঁর অটোগ্রাফ কোনও ভক্তের কাছে মণিমাণিক্যের থেকে কম কিছু নয়।
বৃহস্পতিবার রাতের রিও ঠিক সেটারই সাক্ষী থাকল। কেন তিনি বিশ্বের সেরা স্প্রিন্টার, তার প্রমাণ আরও এক বার দিয়ে গেলেন উসেইন বোল্ট। এটাই তাঁর কেরিয়ারের শেষ একক দৌড়। কিন্তু তাতেও বিশ্বের দ্রুততম মানব যেন সমান বিধ্বংসী। ২০০ মিটার জিতে অলিম্পিক্সের আট নম্বর সোনাটা তুলে নিলেন। অলিম্পিক্স ইতিহাসে প্রথম ২০০ মিটার জয়ের হ্যাটট্রিক করলেন। গ্যালারিকে বুটও ছুড়ে দিলেন। ট্রিপল ট্রিপল করার স্বপ্নও টিকিয়ে রাখলেন। কোনও অ্যাথলিটের কাছে আট নম্বর সোনা মানে স্বপ্নের থেকে কম কিছু নয়। কিন্তু এঁর নাম তো বোল্ট। যিনি শুধু সোনা জিতেই সন্তুষ্ট থাকতে পারেন না। তাঁর যে সোনাও চাই। সঙ্গে বিশ্বরেকর্ডও।
সোনা জিতেছেন। কিন্তু নিজের তৈরি করা ১৯.১৯ সেকেন্ডের বিশ্বরেকর্ড ভাঙতে পারলেন না। রেসের পরেও একবার মনে হয়েছিল। মিক্সড জোনেও বোল্টকে দেখে সে রকমই লাগল— একটু হতাশ। এ দিন ১৯.৭৮ সেকেন্ডে দৌড় শেষ করে সেই হাসিখুশি মুখে একটু হলেও বিষণ্ণতার ছাপ। কে বলবে এটা কোনও সোনাজয়ী অ্যাথলিটের শরীরীভাষা। ‘‘হ্যাঁ, বিশ্বরেকর্ড করব ভেবেছিলাম। কিন্তু জীবনে তো আর সব কিছু পাওয়া যায় না। আমি যে এই জায়গায় পৌঁছোব সেটাই কোনওদিন ভাবিনি,’’ বলছেন জামাইকান মহাতারকা।
১০০ মিটারের মতো বৃহস্পতিবারও তো বোল্ট নিয়ে উন্মাদনা ছিল তুঙ্গে। কিংবদন্তির দৌড় দেখতে দুপুর থেকে লম্বা লাইন পড়ে গিয়েছে। গ্যালারি দেখে মনে হচ্ছে যেন জামাইকাতেই হচ্ছে অলিম্পিক্স। প্রতি মুহূর্তেই ‘বোল্ট-বোল্ট’ চিৎকার। বোল্টের প্রতিটা পোজেই মোবাইল ফ্ল্যাশে ভরে যাচ্ছে স্টেডিয়াম। তাঁর দৌড়ের সময়েও তো সারা গ্যালারি জুড়ে টেনশনের চোরাস্রোত যেন অঘটন না ঘটে। দৌড় জেতার পরে তাঁর ছুড়ে দেওয়া জুতোতে চুমু দেয় ভক্ত।
১০০ মিটার দৌড়ে শুরুটা ভাল করেননি বোল্ট। গ্যাটলিন প্রায় ৭০ মিটার এগিয়ে থাকার পর শেষ মুহূর্তে গিয়ে বোল্ট টপকান তাঁকে। কিন্তু ২০০ মিটার ফাইনালে গ্যাটলিনকে নিয়ে তাঁকে ভাবতে হয়নি। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের স্প্রিন্টার কোয়ালিফাই করতে পারেননি। তাতেও কোনও ঝুঁকি না নিয়ে শুরুর থেকেই আক্রমণাত্মক মেজাজে ছিলেন বোল্ট। সেই যে লিড নেন আর ফিরে তাকাতে হয়নি।
‘ট্রিপল ট্রিপলের’ অলৌকিক স্বপ্নপূরণ থেকে আর এক সোনা দূরে। পুরুষদের রিলে। বাকি অ্যাথলিটরা যা কোনও দিন স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি সেটাই বাস্তবে হয়তো করে দেখাবেন বোল্ট। এ বার তো তাঁকে শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে রাখাই যায় মহম্মদ আলি, পেলের সঙ্গে এক আসনে? অন্তত বোল্ট তো তাই মনে করছেন। ‘‘আমিই সবার সেরা। বিশ্বের কাছে সেটা প্রমাণ করার জন্যই তো রিওতে এসেছিলাম। এই জন্যই বলেছিলাম এটাই আমার শেষ অলিম্পিক্স। কারণ আর কিছু প্রমাণ করা বাকি নেই,’’ বললেন বিশ্বের দ্রুততম মানব।
অ্যাথলেটিক্সের ইতিহাসে ‘অমরত্বের’ দোরগোড়ায় দাঁড়ানো বোল্টের মধ্যে অবশ্য আজও লুকিয়ে আছে এক ব্যর্থ প্রেমিক। যিনি ভুলতে পারেন না পপস্টার রিহানা-কে। কিছু মাস আগেই বোল্ট স্বীকার করেছিলেন, তিনি বান্ধবী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন রিহানাকে। কিন্তু কোনও জবাব পাননি। আজ আবার সেই প্রশ্ন ধেয়ে আসার পর হাসতে হাসতেই বোল্ট বলছেন, ‘‘রিহানার ‘কিস মি বেটার’ গানটা শোনার পরে ওর প্রেমে পড়ে যাই। কিন্তু আমার প্রস্তাবের জবাবে কোনও ফোন পাইনি রিহানার থেকে।’’ কিন্তু রিহানাকে না পাওয়ার দুঃখ তাঁকে নাকি ভুলিয়েছেন অসংখ্য খুদে ভক্ত। ‘‘আমি একটা স্কুলের প্রোগ্রামে একবার গিয়েছিলাম। ওখানে প্রতিটা বাচ্চাই বলে দেয়, আমার বান্ধবীর তালিকা। আমি দেখে খুশি হয়েছিলাম এরা এত কিছু জানে,’’ বলছেন বোল্ট।
অবসর পরবর্তী জীবনে কী করবেন, এখনও ঠিক করেননি। তবে ভবিষ্যতে আর এক বার ভারতে আসতে চান বোল্ট। ‘‘ভারত খুব ভাল দেশ। আবার যাওয়ার ইচ্ছা আছে,’’ বললেন বিশ্বের দ্রুততম মানব।
কিন্তু সে তো পরে। উসেইন বোল্টের চোখ এখন শুধু অমরত্বে। অমরত্বের নম্বর এখন ৯।