(বাঁ দিকে) আগ্রাসী মেজাজে সেমিফাইনালে লক্ষ্য। শুক্রবার ২৫ মিটার এয়ার পিস্তলে মনু (ডান দিকে)। ছবি: পিটিআই।
পদকহীন একটা দিন। হোক না। অন্ধকার নয়, তবু আলোকিত দিন। যা একাধিক পদকের আশা তৈরি করে দিয়ে গেল।
শুটার মনু ভাকের পদকের হ্যাটট্রিকের সামনে দাঁড়িয়ে। একই অলিম্পিক্সে তিনটি পদক আজ পর্যন্ত কোনও ভারতীয় পাননি। বাহান্ন বছরে এই প্রথম হকিতে অস্ট্রেলিয়াকে হারাল ভারত। আর রাতের দিকে সেরা চমক দিয়ে লক্ষ্য সেন পৌঁছে গেলেন ব্যাডমিন্টনের সেমিফাইনালে। এটাও তো কখনও ঘটেনি আগে। এই প্রথম কোনও ভারতীয় পুরুষদের ব্যাডমিন্টন সেমিফাইনালে উঠলেন। নানা ইতিহাস ছোঁয়ার হাতছানি তৈরি হল শুক্রবার। একটুর জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হল তিরন্দাজির মিক্সড টিম। কিন্তু ব্রোঞ্জের ম্যাচে আমেরিকার কাছে হেরে গেলেও দুর্দান্ত লড়াই করলেন কলকাতার মেয়ে অঙ্কিতা ভকত ও ধীরজ বোম্মাদেবরা। যদিও অঙ্কিতা ঝাড়খণ্ডের প্রতিনিধিত্ব করেন, বাংলার নয়। অলিম্পিক্সে এর আগে ভারতের কেউ তিরন্দাজির সেমিফাইনালে পৌঁছয়নি। এটাই সেরা ফল।
প্যারিসে বৃহস্পতিবার রাতে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হওয়ার পরেও গরম কমেনি। এ দিকে, গেমস ভিলেজে এয়ার কন্ডিশন নেই। প্রতিযোগীরা গরমে ঘুমোতে পারছেন না। এ দিন ভারত সরকারের সর্বোচ্চ স্তরে বৈঠক হয় এ নিয়ে। প্যারিসে ভারতীয় দূতাবাসকে জানানো হয়। শীর্ষ বৈঠকের পরে ভারতীয় দূতাবাস ৪০টি এসি কিনে প্রতিযোগীদের ঘরে লাগিয়ে দিয়েছে। আশা করা যায়, গরমে ছটফট করতে করতে আর গেমসে নামার ধকল নিতে হবে না।
ফরাসি বিপ্লবের দেশে ভারতের অলিম্পিক্স বিপ্লব চলছে শাতোরুতে। যেখানে শুটিং হচ্ছে। তিনটি পদকের তিনটিই দিয়েছে শাতোরু। দু’টি ব্রোঞ্জ জেতার পরে ২৫ মিটার এয়ার পিস্তল ইভেন্টেও ফাইনালে উঠেছেন মনু। শনিবার সেই ইভেন্টের ফাইনাল। শুধু শুটিং কেন, ভারতের অলিম্পিক্স ইতিহাসেই কেউ কখনও তিনটি পদক একই গেমস থেকে আনতে পারেননি। নর্ম্যান প্রিচার্ড ১৯০০-তে প্যারিসেই হওয়া অলিম্পিক্সে দুটি পদক জিতেছিলেন। মনু তাঁকে আগেই ছুঁয়ে ফেলেছিলেন। স্বাধীন ভারতে একই সঙ্গে দুটো অলিম্পিক পদক আনা তিনিই প্রথম ভারতীয়। এ বার আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় ভারতীয় শুটিংয়ের নতুন তারকা। শনিবারও যদি পদক পেয়ে যান, তা হলে এমন কৃতিত্ব গডবেন যা প্রিচার্ডেরও ছিল না। ভারতের শুটিংয়ের ইতিহাসে এক জনই শুধু অলিম্পিক্সে তিনটি ফাইনালে পৌঁছতে পেরেছেন। তিনি অভিনব বিন্দ্রা— ব্যক্তিগত ইভেন্টে ভারতের প্রথম সোনাজয়ী। কিন্তু পদকের হ্যাটট্রিক অভিনবেরও ছিল না। সোনা ছাড়া আর কোনও পদক জেতেননি তিনি।
মনু তৃতীয় ফাইনাল নিশ্চিত করার কাছাকাছি সময়ে হকিতে দুর্ধর্ষ জয় ছিনিয়ে নিলেন হরমনপ্রীত, সৃজেশরা। কোয়ার্টার ফাইনালের আগে যা মনোবল দারুণ ভাবে বাড়িয়ে তুলবে দলের। সাম্প্রতিক অতীতে অস্ট্রেলিয়ার কাছে রক্তাক্ত হতে হয়েছে ভারতীয় হকিকে। কমনওয়েলথে ০-৭ হারে। টোকিয়ো অলিম্পিক্সে ১-৭। সেই ক্ষত সারিয়ে তোলার পাশাপাশি পদকের দৌড়ে আত্মবিশ্বাসীও করে তুলবে ভারতীয় দলকে।
দিনের সেরা চমক অবশ্যই লক্ষ্য সেন। প্রথমবার অলিম্পিক্সে এসেই সোনার দৌড় চলছে আলমোড়ার নতুন তারকার। অল ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন জোনাটন ক্রিস্টিকে হারানোর পরে এ দিন পিছিয়ে পড়েও জিতলেন চিনা তাইপে-র চৌ তিয়েন চেনের বিরুদ্ধে। মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা আগে এই পোর্ত দে লা শ্যাপেল এরিনাতেই পতন হয়েছে সিন্ধুর। হেরে গিয়েছে ফেভারিট ডাবলস জুটি সাত্ত্বিক-চিরাগ। সেই অভিশপ্ত ইন্ডোর স্টেডিয়ামেই ফুল ফোটালেন লক্ষ্য। প্রথম গেম ১৯-২১ হেরেও পরের দুটি জেতেন ২১-১৫, ২১-১২। বিজয়ীর জৌলুস নিয়ে যখন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে এলেন, প্রথমেই জানতে চাওয়া হল যে, প্রথম ভারতীয় হিসেবে পুরুষদের ব্যাডমিন্টন সেমিফাইনালে ওঠার অনুভূতি কী? লক্ষ্য কিন্তু খুব উচ্ছ্বাস দেখালেন না। বললেন, ‘‘আমি খুশি যে, লড়াই করে ম্যাচে ফিরে জিততে পেরেছি।’’ যোগ করলেন, ‘‘আমার আসল কাজ এ বার শুরু হচ্ছে। অনেক রাস্তা অতিক্রম করা বাকি। ফিরে গিয়ে বিশ্রাম নিয়ে তরতাজা হয়ে ফিরতে হবে।’’ দু’টি সুযোগ পাচ্ছেন তিনি পদক জেতার। রবিবার সেমিফাইনালে যদি জিতে যান, তা হলে পদক নিশ্চিত। হেরে গেলে ব্রোঞ্জের জন্য আর একটি ম্যাচ পাবেন। এর আগে অলিম্পিক্সে ব্যাডমিন্টনের সেমিফাইনালে পৌঁছে পদক জিতেছেন দু’জন। সাইনা নেহওয়াল ও পি ভি সিন্ধু। পুরুষদের মধ্যে পারুপল্লি কাশ্যপ ও কিদম্বি শ্রীকান্ত হেরে যান কোয়ার্টার ফাইনালে। মিক্সড জ়োনে ফের এক সাংবাদিক বললেন, আপনি ইতিহাস গড়লেন। লক্ষ্য মনে হল আরও ক্ষুধার্ত। সত্যিই তো, পদক না পেলে আর কীসের ইতিহাস? বললেন, ‘‘এখনও কাজ বাকি।’’ তিনি পদক আনতে পারবেন কি না সময় বলবে। কিন্তু কথাবার্তা পদকজয়ীদের মতো, সন্দেহ নেই। প্রায় ৭৫ মিনিট লড়াই চলে চৌয়ের সঙ্গে। যিনি অলিম্পিক্সের জন্য ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে গিয়ে জানতে পারেন, একেবারে প্রাথমিক স্তরের ক্যানসার রয়েছে শরীরে। দ্রুত অস্ত্রোপচার করিয়ে চলে আসেন অলিম্পিক্সে। ২০২২ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জজয়ী চৌ। এখন বিশ্বের এগারো নম্বর। এর আগে লক্ষ্যের বিরুদ্ধে পাঁচটি দ্বৈরথে চার বার জিতেছেন তিনি। নিঃসন্দেহে জায়ান্ট কিলার লক্ষ্যের আর একটি বড় শিকার। ক্রিস্টির পরে চৌকে হারানোয় লক্ষ্যকে নিয়ে আশা বাড়বেসন্দেহ নেই।
লক্ষ্যভেদ করতে পারবেন তিনি? অপেক্ষায় সারা ভারত।