সরোবরে রাজায়-রাজায়। শুক্রবার। ছবি: উৎপল সরকার।
কলকাতা-০
পুণে-০
হাবাস তা হলে নিজের ব্র্যান্ড-ই বদলে ফেললেন! সেটাও তাঁর ছেড়ে যাওয়া শহর আর টিমের বিরুদ্ধে। কলকাতায় প্রথম প্রত্যাবর্তনেই!
ম্যাচের দিন সাদা শার্টে অভ্যস্ত হাবাস কিনা ছাই রঙের টি শার্ট গায়ে রবীন্দ্র সরোবরের রিজার্ভ বেঞ্চে বসে আছেন! যে আউটফিটে স্প্যানিশ কোচকে কখনও দেখেনি কলকাতা। কিন্তু ওই পর্যন্তই। এফসি পুণে সিটির কোচ পোশাকের ব্র্যান্ড বদলালেও রিজার্ভ বেঞ্চের তিনি, হাবাস একই রকম রয়ে গিয়েছেন।
সেই রেগে গিয়ে হাত-পা ছোড়া। দল খারাপ খেললে মাথা চাপড়ানো। ফুটবলারদের চিৎকার করে তাতানো। সাইডলাইনে আগ্রাসী শরীরী ভাষা নিয়ে ঘোরাফেরা— আইএসএলে শহর এবং টিম পাল্টেও নিজের মেজাজ পাল্টাতে পারেননি হাবাস। বরং মস্তানিটা মনে হল প্রাক্তন টিমের বিরুদ্ধে একটু বেশিই প্রয়োগ করলেন শুক্রবারের ম্যাচে। জেদ, না, অভিমান নাকি ক্রোধ— কী কারণে হাবাসই জানেন। কিন্তু তাঁকে বেশ কয়েক বার চতুর্থ রেফারি সতর্ক করে গেলেন। যা কলকাতার জার্সিতে গত দু’মরসুম দেখা গিয়েছে আকছার।
বেঞ্চের হাবাস না বদলাললেও তাঁর সম্পর্কে কলকাতার দর্শকদের মনোভাবে কী বদল ঘটে গিয়েছে? নিতান্তই নিয়মরক্ষার ছিল এ দিনের এটিকে-পুণে ফিরতি লিগ ম্যাচ। যা দেখতে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো সেলিব্রিটি ফুটবল-ফ্যানও আসেননি, সেই ম্যাচেই স্টেডিয়াম প্রায় ভর্তি!
এটিএমের সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা লাইন দিয়ে শেষ পর্যন্ত হাতে টাকা না পেলেও বেশিরভাগ মানুষ শান্ত থাকছেন। একটা সামান্য ঘটনার পরেও যাঁরা ভাঙচুরে অভ্যস্ত সেই লোকেদের মনোভাবের এই বদল কেন, তা বুঝতে গত কয়েক দিন সমীক্ষা চালিয়েছিল একটি বড় ব্যাঙ্কিং সংস্থা। তাতে উঠে এসেছে, কালো টাকা ধরা পড়বে এটা ভেবে বহু মানুষ সব কষ্ট সহ্য করছেন। ভাবনাটা এই, আমার কষ্ট হয় হোক, কালো টাকার কারবারিরা তো ধরা পড়বে।
রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামের এ দিন হাজার বারো দর্শককে দেখে মনে হচ্ছিল এটিএমের সামনে দাঁড়ানো সেই লোকগুলোর মনোভাবের সঙ্গী। সেমিফাইনালে এটিকে আগেই চলে যাওয়ায় এ দিন প্রিয় দলের হার-জিতে তাঁদের কিছু এসে-যেত না। তা জেনেও টিকিট কেটে, কষ্ট করে ঢেলে এসেছিলেন কলকাতা সমর্থকেরা। যাঁদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে মনে হল, শুক্র-সন্ধেয় তাঁদের মাঠে আসার বড় উদ্দেশ্য ছিল হাবাসের টিমের হার দেখা। এ বারের আইএসএলেই একটা সময় যাঁরা কিনা এটিকে ম্যাচে আওয়াজ তুলতেন ‘মলিনা হটাও, হাবাস ফেরাও!’
ম্যাচের আগের দিন পুণের এক কর্তার মুখে শুনেছিলাম, রাজভবনের উল্টো দিকের যে হোটেলে এ বার ঘাঁটি গড়েছেন তাঁরা, সেখানে বুধবার রাতে যখন নারায়ণ দাস-সঞ্জু প্রধানদের টিমবাস ঢুকছে পাশ দিয়ে তখন একটা মিছিল যাচ্ছিল। হঠাৎ-ই নাকি সেই মিছিল থেকে জনা দশেক লোক বেরিয়ে এসে ‘হাবাস হাবাস’ চিৎকার করেছিলেন। জানালার ধারে বসে থাকা স্প্যানিশ কোচের দিকে হাতও নেড়েছিলেন তাঁদের কেউ কেউ। যা দেখে সেই পুণে কর্তা এতটাই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন যে, বলে দেন ‘এখনও হাবাস এত জনপ্রিয় কলকাতায়?’
কিন্তু সেটা যে প্রাক্তন কলকাতা কোচকে নিছক চোখে দেখার বহিঃপ্রকাশ সেটা বোঝা গেল এ দিন মাঠে। একেবারে ঠিক উল্টো ছবি সেখানে। মাইক্রোফোনে ডিজে সুর করে যত বার বলেছেন, ‘জিতবে কে?’’ ততবারই সমস্বরে ‘এ-টি-কে’ বলে গর্জে উঠেছে স্টে়ডিয়াম। পুণের গোলে বেলেনকোসো, পিয়ারসনদের একের পর এক গোল নষ্টের প্রদর্শনী দেখে মাথা চাপড়েছে গ্যালারি। আফসোসের লাভাস্রোত বয়েছে সেখানে। ম্যাচ শেষে তা আরও বাড়ে। হাবাস-বধের মরিয়া মনোভাবটা কেন এমন ভাবে আছড়ে পড়ল এটিকে সমর্থকদের মধ্যে তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। গত দু’বছর যে কোচ কলকাতাকে ঝলমলে করে দিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর প্রতি প্রথম বারেই শহরের এই ‘নিষ্ঠুর’ মনোভাব নিয়ে চলতে পারে নিরন্তর বিতর্ক।
হাবাসের বিরুদ্ধে মলিনার টিমের ফুটবলারদের মধ্যেও মনে হচ্ছিল সমর্থকদের ভাবনা সংক্রামিত। জিততে না পারলেও জোসে মলিনার টিমকে দেখে মনে হচ্ছিল হাবাসের পুণেকে পিষে মারার জন্য জীবন দিতে পারেন সবাই। সেমিফাইনালের কথা মাথায় রেখে জাভি লারাকে ছাড়া প্রথম এগারোয় বিদেশি তারকাদের কাউকে এ দিন রাখেননি মলিনা। অবিনাশ রুইদাস, বিদ্যানন্দ সিংহ, প্রবীর দাসের মতো কিছু রিজার্ভ ফুটবলারকে নামিয়েছিলেন। সম্মানের ম্যাচেও। পস্টিগা, বোরহা, দেবজিৎ, প্রীতম, ডিকা কেউ নেই। হিউম-পিয়ারসন নেমেছেন একেবারে শেষ বেলায়। তাতেও কলকাতা যা খেলল তাতে গর্ব করতেই পারেন মলিনা। হাবাসের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে না পারলেও ভাল একটা বেঞ্চ সঙ্গে নিয়ে শেষ চারের লড়াইতে যেতে পারছেন এটিকে কোচ। তবে দিল্লি হোক বা মুম্বই, যারাই সেমিফাইনালে সামনে পড়ুক, দুটো ব্যাপার মলিনাকে স্বস্তি দেবে, আবার আশঙ্কাতেও রাখবে। স্বস্তিতে রাখবে রিজার্ভ বেঞ্চ। আর রাতের ঘুম কাড়বে এ দিনের গোল নষ্টের প্রদর্শনী। সাংবাদিক সম্মেলনে এসেও যা স্বীকার করলেন পস্টিগাদের কোচ।
কত গোলের সুযোগ পেয়েছিল কলকাতা? দু’টো হাফ চান্স ধরলে হাফডজন তো হবেই। তার মধ্যে মাথা বা পা ছোঁয়ালেই হতে পারত তিনটে। কী আসাধারণ ফুটবল খেললেন মলিনার টিমের দুই উইং হাফ। বজবজের বছর একুশের বঙ্গসন্তান অবিনাশ আর সদ্য উনিশে পা দেওয়া মণিপুরের বিদ্যানন্দ সিংহ যেন হয়ে উঠেছিলেন দুই টাট্টু ঘোড়া। তাঁদের দৌড় আর দাপটে হাবাসের টিমের সব অঙ্ক ওলটপালট হয়ে গেল। এটিকের গোলের আশি শতাংশ সুযোগ এসেছিল দুই তরুণের দৌরাত্ম্যে। সোদপুরের ছেলে অরিন্দম ভট্টাচার্য বেশ কিছু ভাল সেভ করলেন পুণের গোলে দাঁড়িয়ে। এডেল বেটের মতো কিপারকে বসিয়ে খেলছেন এই বঙ্গসন্তান। সন্দীপ-সুব্রতদের সঙ্গে অরিন্দমও প্রমাণ করে দিয়েছেন বঙ্গ ব্রিগেড এ বার আইএসএলে চমকে দিচ্ছে।
তাঁর টিম বিদায় নিয়েছে আগেই তা সত্ত্বেও ম্যাচটা জিততে চেয়েছিলেন হাবাস। কিছুটা মরিয়া হয়ে। শেষ পর্যন্ত সেটা করতে না পেরে মাথা চুলকোতে চুলকোতে সটান ঢুকে গেলেন ড্রেসিংরুমে। বিড়বিড় করে কিছু বলতে বলতে। মাদ্রিদে যে ‘বন্ধু’র পাশের ঘরে থেকেছেন বহু দিন, নিয়মিত আড্ডাও দিতেন সেই স্বদেশীয় মলিনার সঙ্গে হাত মেলানোরও প্রয়োজন মনে করেননি সৌজন্য দেখিয়ে। টিমবাসে ওঠার আগে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গিয়ে শুনতে হল, ‘‘বন্ধু, পরের বারও আমি থাকছি পুণেতে। আবার আসব। তখন দেখা হবে সবার সঙ্গে,’’ চোখে তখনও আগুন।
পোশাকের ব্র্যান্ড বদলে বহিরঙ্গে বদলালেও আন্তোনিও লোপেজ হাবাস যে বদলাননি। তাঁকে পাল্টাবে কার সাধ্যি?
আটলেটিকো দে কলকাতা: ড্যানিয়েল, প্রবীর, তিরি, কিংশুক, কিগান, নাতো (হিউম), জুয়েল (পিয়ারসন), জাভি, বিদ্যানন্দ (বিক্রমজিৎ), অবিনাশ, বেলেনকোসো।