রক্ষা: দুই মেয়েকে নিয়ে কলকাতায় কিছুটা স্বস্তিতে আমনা। নিজস্ব চিত্র
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ কেড়ে নিয়েছে তাঁর খুড়তুতো ভাইকে।
শৈশবে যে সঙ্গীদের সঙ্গে খেলে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই ভয়াবহ যুদ্ধে নিহত।
প্রাণ বাঁচাতে সিরিয়া ছেড়ে মিশরে চলে গিয়েছিলেন তিনি। এই মুহূর্তে দক্ষিণ কলকাতার ২৫ তলার বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। তা সত্ত্বেও প্রত্যেকটা রাত কাটে আতঙ্কে। স্বজন হারানোর দুঃস্বপ্নে।
তিনি— ইস্টবেঙ্গলের নতুন তারকা মহম্মদ আল আমনা।
‘‘সিরিয়ার আলেপ্পোয় জন্ম আমার। আমাদের শৈশব খুব সুন্দর ছিল। সাত বছর আগে হঠাৎ করেই বদলে গেল পরিস্থিতি। পুরো দেশটাই মৃত্যু-উপত্যকা হয়ে উঠল,’’ বলতে বলতে শিউরে উঠলেন আমনা।
গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই অবশ্য ইরানের রাহ আহান ক্লাবে চলে গিয়েছিলেন আমনা। গত সাত বছরে একবারের জন্যও সিরিয়া ফেরেননি তিনি। তা হলে? আমনা বললেন, ‘‘সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয় ২০১১ সালে। তার ঠিক এক বছর আগেই আমি ইরানে চলে যাই। কিন্তু আমার বাবা, মা, ভাই ও আত্মীয়স্বজনরা তো সিরিয়াতেই ছিলেন। যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ায় কারও কোনও খবর পেতাম না। উল্টে টিভির নিউজ চ্যানেলে সিরিয়ার অবস্থা দেখে দুশ্চিন্তা আরও বাড়ত। মোবাইল ফোন বাজলেই দুঃসংবাদের আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠত। যন্ত্রণা ভুলতে ফুটবলই ছিল আমার ভরসা।’’ সঙ্গে যোগ করলেন, ‘‘আমার খুড়তুতো ভাইয়ের প্রাণ যে কেড়ে নিয়েছে যুদ্ধ, সেটাও জেনেছিলাম অনেক পরে।’’
কী ভাবে? আমনার কথায়, ‘‘আমার স্ত্রী নাদিম মিশরের নাগরিক। প্রাণ বাঁচাতে আমিও ওর দেশে পাকাপাকি ভাবে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। বাবা, মা ও এক ভাইকেও মিশরে নিয়ে যাই। ওঁদের কাছেই খুড়তুতো ভাইয়ের মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর শুনেছিলাম।’’
বাবা-মাকে মিশরে নিয়ে যাওয়ার পরেও অবশ্য স্বস্তি ফেরেনি আমনার জীবনে। এখনও তাঁর এক ভাই ও বোন আলেপ্পোয় থাকেন। বলছিলেন, ‘‘আমার বোনের বাড়ি বোমার আঘাতে ধুলোয় মিশে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও দেশ ছাড়তে রাজি নয় ও। আর আমার ভাইয়ের যুক্তি, মরতে হলে নিজের দেশেই মরব।’’
আরও পড়ুন:'আমনার বিপক্ষে দু’টো গোলও কিন্তু করেছি', বললেন ডিকা
সাত বছর ধরে চলতে থাকা গৃহযুদ্ধের প্রভাবে সিরিয়ার আর্থিক পরিকাঠামো ভেঙে পড়েছে। কী ভাবে বেঁচে রয়েছেন সিরিয়াবাসী? আমনা বলছিলেন, ‘‘যাঁরা সেনাবাহিনীতে আছেন, তাঁদের দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু বাকিদের ভরসা দেশের বাইরে থাকা আত্মীয়স্বজনরাই। তাঁদের আর্থিক সাহায্যেই সুদিন ফেরার আশায় দেশের মাটি আঁকড়ে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ওঁরা। তবে বেশি অর্থ পাঠানোও বিপদ। যে কোনও মুহূর্তে লুট হয়ে যাবে।’’
আর শিক্ষাব্যবস্থা, চিকিৎসা ও খেলাধুলো? করুণ হাসি হেসে আমনা বললেন, ‘‘রাতে শুতে যাওয়ার আগে সিরিয়ার মানুষ জানেন না, আগামী কাল সূর্যোদয় দেখার সৌভাগ্য তাঁদের হবে কি না। এই অস্থির পরিবেশে সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর ঝুঁকি কেউ নেন না। তবে রাজধানী দামাস্কাসের পরিস্থিতি কিছুটা হলেও ভাল। মাঝেমধ্যে যখন স্কুল-কলেজগুলো খোলে, ছাত্র-ছাত্রীরা যায়।’’
নিরাপত্তার কারণেই সিরিয়া প্রিমিয়ার লিগের সব খেলাই এখন রাজধানীতে হয়। আর জাতীয় দলের শিবির হয় বিদেশের মাটিতে। আমনা বললেন, ‘‘জাতীয় দলের ফুটবলাররা সকলেই বিদেশের বিভিন্ন ক্লাবে খেলে। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে কেউ সিরিয়ায় আসতে চায় না। তাই কোনও টুর্নামেন্টের আগে বিদেশেই প্রস্তুতি নেওয়া হয়।’’
জাতীয় দলের প্রস্তুতি শিবিরেই বদলে গিয়েছিল আমনার জীবন! ইস্টবেঙ্গল তারকা শোনালেন সেই কাহিনি, ‘‘বছর পনেরো আগে মিশরে আমাদের জাতীয় শিবির চলছিল। ওখানেই প্রথম দেখি নাদিমকে। আর প্রথম দর্শনেই প্রেম। চার বছর পরে আমরা বিয়ে করি। সিরিয়া অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠার পরে নাদিমের পরিবারই আমাকে আশ্রয় দিয়েছিল বলে বেঁচে আছি। এখন অবশ্য কায়রোতে নিজের ফ্ল্যাট রয়েছে। প্রচুর বন্ধুও আছে। কিন্তু সেই সময় শুধু নাদিম ছিল পাশে।’’
আমনা মনে করেন, নাদিম শুধু তাঁর স্ত্রী নন, মেন্টরও! বললেন, ‘‘প্রথমে ফুটবলের প্রতি ওর খুব একটা আগ্রহ ছিল না। অথচ এখন নাদিমই আমার প্রেরণা। ওর পরামর্শেই আমি এখন অনেক পরিণত হয়ে উঠেছি।’’
পরিণত হয়ে ওঠার প্রমাণ আমনা দিলেন মহমেডান ম্যাচ নিয়ে আলোচনাতেই। বললেন, ‘‘মহমেডান দারুণ দল। আর দিপান্দা ডিকা তো এই মুহূর্তে দুর্ধর্ষ ফর্মে। ওরা খেতাবি লড়াই থেকে ছিটকে গেলেও হাল্কা ভাবে নেওয়া যাবে না। নিজেদের সেরাটা দিতে হবে।’’
নিজের দেশে ফিরতে ইচ্ছে করে না? আমনা বললেন, ‘‘স্বপ্ন দেখি, এক দিন নিশ্চয়ই যুদ্ধ থামবে। আর আমার দুই মেয়ে রিদেশ ও তালিনের হাত ধরে আলেপ্পোর রাস্তায় নিশ্চিন্তে হাঁটছি।’’