এক ফ্রেমে সেই চারমূর্তি। বাঁ দিক থেকে ইয়ান চ্যাপেল, রিচি বেনো, টনি গ্রেগ ও বিল লরি।
সিডনি মাঠের বড় ম্যাচে খেলা দেখতে যে সাড়ে বারো হাজার টাকার ওপর খরচা হয়ে যায় তাঁর কোনও ধারণাই ছিল না!
আসলে টিকিটের দাম সম্পর্কেই কোনও ধারণা ছিল না। জন্ম থেকেই তো কমপ্লিমেন্টরি টিকিটে খেলা দেখা আর কমেন্ট্রি বক্সের পাশে বসা অভ্যেস। বারবার বলছিলেন, এত টাকা খরচা করাটা নয়। ওই যে গ্যালারিতে গিয়ে বসব, কমেন্ট্রি বক্সের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক থাকবে না ভাবতেই কেমন লাগছে।
তাঁর নাম মার্ক গ্রেগ, অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটমহল একডাকে চেনে। ভারত-সহ অন্য দেশে অবশ্য একেবারেই পরিচিত নাম নয়। তাঁর বাবাকে অবশ্য একডাকে সবাই চেনেন। টনি গ্রেগ। সওয়া দু’বছর আগে ক্যানসারের কোপে ঢোলে পড়া প্রাক্তন ক্রিকেট অধিনায়ক এবং চ্যানেল নাইনের উজ্জ্বল তারা।
গ্রেগ মারা যাওয়ার পর সিডনিতে এই প্রথম এত বড় ক্রিকেট ম্যাচ হচ্ছে। তা তিনি তো শুধুই প্রাক্তন ক্রিকেটার ছিলেন না, চ্যানেল নাইনের প্রবর্তিত নানা প্রযুক্তির পিছনেই গ্রেগ। কেরি প্যাকার-ক্রিকেটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, তাই গ্রেগ মারা যাওয়ার পর জেমস প্যাকার শোকবার্তায় বলেন, “আমার বাবা যখন প্রচণ্ডতম চাপের মধ্যে তখন অ্যান্টনি আঙ্কল ওঁর সঙ্গে ছিলেন, এটা আমরা প্যাকার পরিবার চিরকাল মনে রাখব।”
কিন্তু নতুন জমানায় প্যাকারের হাতে আর চ্যানেল নাইন নেই। জেমস ওটা বিক্রি করে দিয়েছেন। যাঁরা চ্যানেল নাইন এখন চালাচ্ছেন তাঁরা টনি গ্রেগের পরিবারে টিকিট পাঠানোর কোনও কারণ দেখেননি। আইসিসিও পাঠাবে না কারণ শ্রীনির ডিআরএস নীতির চূড়ান্ত সমালোচক ছিলেন টনি। শেষ দিকে তাই ভারতীয় বোর্ড তাঁকে ধারাভাষ্য দিতে ডাকত না। তাই অনলাইনে টিকিট কেনা ছাড়া মার্ক গ্রেগের উপায়ই বা কী! অথচ এসসিজিতে বড় ম্যাচ যারাই খেলুক তাঁর বাবার স্মৃতি সেখানে একবারও উচ্চারিত হবে না এটা ভাবাই যায় না।
টনি গ্রেগ। বিল লরি। রিচি বেনো। ইয়ান চ্যাপেল।
এই চতুষ্টয় হলেন অস্ট্রেলিয়ায় ক্রিকেট ধারাভাষ্যের যুগপুরুষ। আর সিডনি ক্রিকেট মাঠ এঁদের কর্মকাণ্ডের সবচেয়ে উজ্জ্বলতম শো-কেস। গত তিরিশ বছরে সিডনি বা অস্ট্রেলিয়ার মাঠের কোনও বড় ম্যাচ এঁদের উপস্থিতি ছাড়া কল্পনা করাই অসম্ভব। বাংলায় যেমন মহালয়ার দিন ভোরবেলা তর্পণের আগে যা দেবী সর্বভূতেষু...চলবে না ভাবাটাই অচিন্তনীয়—এঁরাও ধারাভাষ্যে তেমনই। প্রবাদপ্রতিম হয়ে গিয়েছেন প্রত্যেকেই।
বৃহস্পতিবার এমন আশ্চর্য পরিস্থিতি যে এই প্রথম তাঁদের কেউ মাঠে থাকছেন না।
গ্রেগ—মারাই গিয়েছেন।
বেনো—ত্বকের ক্যানসারে ভুগছেন। পঁচাশি বছর বয়স হল। শরীর খুব খারাপ। চ্যানেল নাইনের ক্রয়কারীরা বেনোকে ব্ল্যাঙ্ক চেকও দিয়ে রেখেছেন কমেন্ট্রির জন্য। ভারতের সঙ্গে সিডনি টেস্টের সময়ও বলেছিলেন। কিন্তু তিনি স্বাস্থ্যজনিত কারণে আর পেরে উঠছেন না। গত কয়েক মাসে নিয়মিত হসপিটাল-বাড়ি চলছে তাঁর।
লরি—মেলবোর্ন টেস্টে এ বার বহু অনুরোধ-উপরোধে কমেন্ট্রি করেছিলেন। কিন্তু এমসিজিতে বিশ্বকাপের আর কোনও ম্যাচে মাঠেই আসেননি। এবিপিকে ফোনে বললেন, ফাইনালেও কমেন্ট্রি করবেন না। সিডনি টেস্টের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত রয়েছে লরির কণ্ঠস্বর, ইটস অল হ্যাপেনিং রাইট হিয়ার অ্যাট দ্য সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ড। কিন্তু আর কখনও আটাত্তর বছরের তাঁকে সিডনিতে দেখা যাবে বলে মনে হয় না।
চ্যাপেল—তিনি একাত্তর বছরেও সম্পূর্ণ সুস্থ এবং প্রাণবন্ত। কিন্তু গ্রেগ চ্যাপেলের দাদা একরকম বাধ্য হয়ে বিশ্বকাপ কমেন্ট্রি থেকে নাম তুলে নিয়েছেন। ওয়ার্ল্ড ফিডে যে সব ভাষ্যকারের নাম রয়েছে তার মধ্যে চ্যানেল নাইনের মার্ক টেলর বা শেন ওয়ার্ন দু’জনেই আছেন। কিন্তু ইয়ান চ্যাপেল নাম লেখাতে রাজি হননি। স্টার টিভির হয়ে ধারাভাষ্য দিতে হলে তাঁকে ভারতীয় বোর্ডের শর্ত মেনে কমেন্ট্রি করতে হত। চিরবিদ্রোহী চ্যাপেল যা মানতে রাজি নন। তাই তিনি সিডনি হারবার ব্রিজের কাছে চ্যানেল নাইনের স্টুডিও থেকে চ্যানেল নাইন প্রোডাকশনের জন্য কমেন্ট্রি দেবেন। তার জন্য মাঠে আসার দরকার নেই।
শ্রীনির জমানায় ভারতীয় বোর্ডের ভাষ্যকারদের ওপর চাপানো শর্ত হল,
১) বোর্ডবিরোধী কোনও সমালোচনা করা যাবে না।
২) ডিআরএস নিয়ে কোনও আলোচনা করা যাবে না।
৩) ক্যাপ্টেনকে কড়া সমালোচনা করা যাবে না। যেমন বলা যাবে না ভুল ক্যাপ্টেন্সির জন্য টিম হারল।
৪) দল নির্বাচন সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ চলবে না যে, অমুকের জায়গায় তমুক এলে ভাল হত।
চিরবিদ্রোহী চ্যাপেলের মনে হয়েছে এটা কার্যত দাসখত লিখে দেওয়া। এত নিষেধাজ্ঞা নিয়ে তাঁর কোনও দায় পড়েনি কমেন্ট্রি করবেন। আর দাসখত অনুযায়ী তাঁর তো ব্যক্তিত্বশালী ভাষ্যকার থেকে অবনমন ঘটছে বল বাই বল কমেন্টেটরে। তাতে তিনি রাজি নন। তাই অস্ট্রেলিয়া বাদে অন্য কোনও দেশের কমেন্ট্রিতে তিনি এই প্রথম বিশ্বকাপে নেই। অস্ট্রেলিয়ার খেলা দেখানোর এক্সক্লুসিভ স্বত্ব চ্যানেল নাইনের। তাদের প্রোডাকশনে একমাত্র তাঁকে এ বার তাই পাওয়া যাচ্ছে। সেটাও স্টুডিও থেকে। রাতে চ্যাপেলকে আর একপ্রস্ত বোঝানোর চেষ্টা হয়। তিনি মাঠে থাকা মানে ধারাভাষ্যের গরিমাই বেড়ে যাওয়া। তা ছাড়া বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল ভেবে তিনি কি একটা ব্যতিক্রম করতে পারেন? চ্যাপেল তাতেও রাজি নন। যেমন নিষেধাজ্ঞা মানতে রাজি হননি মাইকেল হোল্ডিং।
সব মিলিয়ে এমন অভাবনীয় পরিস্থিতি যে, ক্রিকেট ধারাভাষ্যের স্বর্ণযুগের চার জনের এক জনও কাল সিডনি মাঠে নেই। মিলিত ভাবে এঁরা টেস্ট খেলেছেন ২৬৩। সচিনই সেখানে ২০০। তার সঙ্গে রবি শাস্ত্রীর টেস্ট ম্যাচ খেলার সংখ্যা যোগ করলেই এঁদের টেস্ট অভিজ্ঞতা ছাপিয়ে যাওয়া যায়।
কিন্তু সংখ্যায় কী আসে যায়! এঁরা সেই প্যাকার সিরিজের সময় থেকে চলতে চলতে এক-একজন আইকন সদৃশ হয়ে গিয়েছেন। লরির সেই বিখ্যাত মন্তব্য, ইটজ অল হ্যাপেনিং আউট দেয়ার ইন দ্য মিডল। গ্রেগের নাটকীয় কন্ঠস্বর। কথায় কথায় বিতর্ক তৈরি করা। চ্যাপেলের আক্রমণাত্মক বিশ্লেষণ। বেনোর মার্জিত কম শব্দের মন্তব্য। এই কম্বিনেশন জনপ্রিয় ক্রিকেটগাথার মতো ঢুকে গিয়েছে মানুষের মনে।
চারমূর্তির এমনই গ্রহণযোগ্যতা যে মাঝে শেন ওয়ার্ন, মার্ক টেলরদের মতো নতুন যুগের ভাষ্যকার এনেও জনমানসে তাঁদের আবেদনে ঘাটতি পাওয়া যায়নি। চ্যানেল নাইন বাধ্য হয়ে আবার ফিরে গিয়েছে চারমূর্তির কাছে।
চার জনের কারও না থাকা সময়ের নিয়মে একদিন না একদিন ঘটতই। কিন্তু কে জানত সেটা যে এত তাড়াতাড়ি বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের মতো ম্যাচে ঘটবে তিন জনের জীবিত অবস্থাতেই! ক্রিকেটকে অনেকে ট্র্যাজিক বলে। কে জানত ক্রিকেট ধারাভাষ্যও যে ট্র্যাজিক হতে পারে খেলাটার মতোই!