স্বপ্নপূরণ: রবিবার মুম্বইয়ে কিংবদন্তি জিমন্যাস্ট নাদিয়া কোমানেচের সঙ্গে দীপা কর্মকার। নিজস্ব চিত্র
ভয়ঙ্কর ঝুঁকির প্রোদুনোভা ভল্ট কী ভাবে এত পারফেক্ট করেন? দীপা কর্মকারের কাছে জানতে চাইলেন নাদিয়া কোমানেচ।
বিশ্ব জিমন্যাস্টিক্সের সর্বকালের সেরা মেয়ে নাদিয়া একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে রবিবার দুপুরে মুম্বই এসেছেন। সেই অনুষ্ঠানেই গিয়েছেন ভারতের এক নম্বর মেয়ে জিমন্যাস্ট দীপা। দুই সেরা-ই উঠেছেন একই হোটেলে। সেখানেই বিকেলে ঘণ্টাখানেকের আ়ড্ডা। যেখানে নাদিয়া বিস্ময়ভরা চোখে নাকি দীপাকে প্রশ্ন করেন, ‘‘তোমার প্রোদুনোভা ভল্ট আমি রিও-র স্টেডিয়ামে বসে দেখেছি। পারফেক্ট ল্যান্ডিং করতে পারো। তোমার কোমর, হাতের জয়েন্ট, পায়ের জয়েন্ট সব ঠিক আছে তো?’’
নাদিয়ার প্রশ্নের উত্তরে ঘাড় নাড়েন দীপা। ‘‘অনুশীলনের সময় সতর্ক থাকি। কোচ যে ভাবে বলেন সে ভাবে তৈরি হচ্ছি। যাতে চোট না পাই তার জন্য নানা ব্যায়াম করি,’’ বলে দেন রিও-তে চতুর্থ হয়ে ইতিহাস তৈরি করা জিমন্যাস্ট। শুধু দীপা নন, পাশে বসা তাঁর কোচ বিশ্বেশ্বর নন্দীর কাছেও জিমন্যাস্টিক্সের মহাতারকা জানতে চান, প্রোদুনোভার মতো কঠিন ভল্ট ছাত্রীর জন্য বাছলেন কেন? ভল্ট শুরুর সময় ফোম পিট পেয়েছিলেন তো? দীপার কোচ তাঁকে বলে দেন, ‘‘ওর চেষ্টা আর শারীরিক গঠনের জন্য প্রোদুনোভা বেছেছি। ফোম পিটেই অনুশীলন করি।’’ নাদিয়া বলেন, ‘‘পারফেক্ট। কোচের ভাবনাটা সঠিক না হলে জিমন্যাস্টদের সাফল্য পাওয়া কঠিন।’’
প্রোদুনোভা নিয়ে অলিম্পিক্সের সোনার মেয়ের এত প্রশ্নে হতবাক বিশ্বেশ্বর ও তাঁর ছাত্রী। ফোনে মুম্বইয়ের হোটেল ম্যারিয়ট থেকে বিস্ময়াবিষ্ট দীপা বলছিলেন, ‘‘জীবনে প্রথম দেখলাম ওঁকে। ছবিতে অনেকবার দেখেছি। আমার সঙ্গে সব সময় থাকে ওঁর ছবি। ইউ টিউবে ওঁর ল্যান্ডিং দেখে অবাক হয়েছি কত বার! উনি তো জিমন্যাস্টিক্সের ঈশ্বরী। কথা বলব কী, শরীরের ভিতরটা কেমন যেন শিরশির করছিল। জীবনে প্রথমবার দেখলাম সামনে। ভাবছিলাম স্বপ্ন দেখছি না তো?’’ বলতে বলতে উচ্ছ্বাস ঝরে পড়ে এদেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা মেয়ে ক্রীড়াবিদের। বিশ্বেশ্বরও বলছিলেন, ‘‘উনি যে দীপার প্রোদুনোভা দেখেছেন এবং নানা প্রশ্ন করছেন এটা দেখে আশ্চর্য লাগছিল। ভল্টের, অনুশীলনের খুঁটিনাটি জিজ্ঞাসা করছিলেন।’’
আরও পড়ুন: কোহালির কাঁধের কাণ্ড থামছে না
পাঁচটি সোনা-সহ ন’টি অলিম্পিক্স পদক। দু’টি সোনা-সহ চারটি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের পদকজয়ী নাদিয়ার বয়স এখন পঞ্চান্ন। স্বপ্নের মানবীকে সামনে পেয়ে দীপা চমকিত এবং আপ্লুত হবেন স্বাভাবিক। নাদিয়া প্রশ্ন করে যাচ্ছিলেন একের পর এক। নাদিয়ার প্রশ্ন ছিল, ‘‘ছিয়াত্তরে আমি মন্ট্রিওল অলিম্পিক্সে পারফেক্ট টেন করেছিলাম। বিশ্বের প্রথম জিমন্যাস্ট হিসাবে তুমি জানো?’’ দীপা ঘাড় নেড়ে জানান, তিনি জানেন। যা শুনে হেসে ফেলেন নাদিয়া। জানতে চান, ‘‘মন্ট্রিওলেই অক্টোবরের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে আসছ তো?’’ দীপা তাঁকে জানান, ‘‘সব ঠিকঠাক চললে যাচ্ছি। তৈরি তো হচ্ছি। আমি কমনওয়েলথ ও এশিয়ান গেমসেও নামব।’’ নাদিয়া তখন তাঁকে বলেন, ‘‘বিশ্ব জিমন্যাস্টিক্স থেকে পদক পেলে অলিম্পিক্সের ব্যর্থতার কথা কেউ মনে রাখবে না। ওখানে পদক জেতার চেষ্টা কর।’’
রোমানিয়ার সোনার মেয়ে নাদিয়া এখন থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। বিয়ের পর নিজের দেশ ছেড়ে চলে এসেছেন পাকাপাকি। দীপাকে তিনি বলেছেন এটা ভারতে তাঁর প্রথম আসা। দীপা ফোনে বলছিলেন, ‘‘এত ভাল ব্যবহার, কী বলব! মা যেমন মেয়ের কাছে নানা প্রশ্ন করেন সেরকম ভাবে নানা প্রশ্ন করছিলেন। জড়িয়ে ধরে আদর করলেন। সেলফি তুললেন। আমি তো ওঁর সমুদ্রের মতো বিশাল পারফরম্যান্সের পাশে কিছুই নই। তাও কী ভাবে আমার সম্পর্কে এত জানলেন ভেবে অবাক হচ্ছিলাম।’’
নাদিয়ার মতো জিমন্যাস্টকে এতক্ষণ সামনে পেলেন কোনও পরামর্শ নিলেন না? ভারতীয় জিমন্যাস্টিক্সের সোনার মেয়ের উত্তর, ‘‘উনি বলছিলেন প্রোদুনোভা কঠিন ভল্ট। অনুশীলনের সময় শরীরের হাড়ের জয়েন্টগুলো নিয়ে সতর্ক থেকো। আর পরিশ্রম করে যাও। কঠোর অনুশীলন করো। ল্যান্ডিংটা যতটা সম্ভব পারফেক্ট করো।’’ বিশ্বেশ্বরবাবুর সঙ্গেও দীর্ঘক্ষণ দীপার অনুশীলন নিয়ে খোঁজখবর নেন ‘পারফেক্ট টেন’ নাদিয়া।
দিল্লির জাতীয় শিবির থেকে দু’দিনের ছুটি নিয়ে মুম্বই এসেছেন দীপা। বলছিলেন, ‘‘প্রোদুনোভার সঙ্গে দ্বিতীয় ভল্ট হিসাবে কোনটা বাছব সেটা সারপ্রাইজ হিসাবেই থাক।’’ এখন দিনে সাত-আট ঘণ্টা অনুশীলন করছেন ভারতে ইতিহাস তৈরি করা দীপা। অপ্রত্যাশিত ভাবে পাওয়া নাদিয়ার পরামর্শ এবং ছোঁয়ায় আগরতলার বঙ্গ কন্যা রিওর ব্যর্থতা মুছে ফেলে ঘুরে দাঁড়াতে পারেন কি না সেটাই দেখার।