প্রত্যয়ী: দুঃসময় পেরিয়ে লড়াই চলছে আনোয়ারের। ফাইল চিত্র।
ভারতীয় ফুটবলের মূলস্রোতে জীবনযুদ্ধে জয়ী এক প্রতিভার প্রত্যাবর্তনের রোমাঞ্চকর কাহিনি। হৃদ্যন্ত্রে জন্মগত ত্রুটির কারণে আনোয়ার আলির ফুটবলজীবনই শেষ হয়ে যেতে বসেছিল। চিকিৎসকরা পরিষ্কার বলে দিয়েছিলেন, খেলতে খেলতে যে কোনও মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। এমনকী মৃত্যুও অসম্ভব নয়। সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনও জারি করেছিল নিষেধাজ্ঞা।
আনোয়ার লড়াই থামাননি। এক দিকে ফেডারেশনের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে দিল্লি আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। অন্য দিকে মিনার্ভা অ্যাকাডেমিতে নীরবে চালিয়ে গিয়েছিলেন অনুশীলন। আনোয়ার শুধু মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে মাঠেই ফিরে আসেননি, চলতি আইএসএলে চেন্নাইয়িন এফসির বিরুদ্ধে এফসি গোয়ার হয়ে অভিষেক ম্যাচেই সেরা হন। অকুতোভয় আনোয়ার ফোনে আনন্দবাজারকে বলছিলেন, ‘‘মরতে তো এক দিন হবেই। তার জন্য ভয় পেয়ে মাঠের বাইরে বসে থাকতে পারব না। জীবনে সমস্যা আসবেই। হাল না ছেড়ে তার মোকাবিলা করতে হবে। যা হবে দেখা যাবে।’’ আজ, শুক্রবার নর্থ ইস্ট ইউনাইটেড এফসি-র বিরুদ্ধে নিজেকে প্রমাণ করতে মরিয়া আনোয়ার।
যাঁর ফুটবলজীবন শুরুই হয়েছিল প্রবল লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে, তাঁকে আটকে রাখার সাধ্য কার? বছর একুশের আনোয়ারের জন্ম পঞ্জাবের আদমপুরে। ছোটবেলা থেকে লক্ষ্য ছিল ক্রিকেটার হওয়া। ক্লাস সেভেনে ওঠার পরেই স্বপ্নভঙ্গ। বাবার হুকুম— ফুটবলারই হতে হবে। ক্রিকেট বন্ধ। ছেলেকে তিনি ভর্তি করে দেন প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরের মাহিলপুর অ্যাকাডেমিতে।
শুরুর সেই দিনগুলি ছিল আনোয়ারের কাছে যন্ত্রণার। রোজ রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবতেন, অ্যাকাডেমি ছেড়ে পালিয়েই যাবেন। কিন্তু বাবার রাগি মুখটা মনে পড়তেই সব বীরত্ব উবে যেত। পরের দিন সকালে উঠে অনিচ্ছা সত্ত্বেও নেমে পড়তেন অনুশীলনে। আনোয়ার তখন খেলতেন স্ট্রাইকারে। অল্প দিনের মধ্যে পঞ্জাব দলে ডাক পান আনোয়ার। জাতীয় প্রতিযোগিতায় দুর্দান্ত খেলে নির্বাচিত হন ভারতীয় দলেও। তত দিনে ক্রিকেটার হওয়ার ভূত ঘাড় থেকে নেমে গিয়েছে। আনোয়ারের তখন একটাই স্বপ্ন— সুনীল ছেত্রীর মতো জাতীয় দলের হয়ে গোল করে ম্যাচ জেতাবেন। কিন্তু ফের ধাক্কা খেল আনোয়ারের স্বপ্ন।
অনূর্ধ্ব-১৭ ভারতীয় দলের কোচ ছিলেন তখন নিকোলাই অ্যাডাম। তিনি আনোয়ারকে পরামর্শ দেন রক্ষণে খেলার। হতাশ হয়ে পড়লেও তাঁর আর পিছন দিকে তাকানোর উপায় ছিল না। সামনেই অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপে খেলার হাতছানি। নতুন জায়গায় মানিয়ে নেওয়ার জন্য অনুশীলনে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। বিশ্বকাপে দুর্দান্ত খেলে ডাক পান মুম্বই সিটি এফসিতে। তার পরে লোনে সই করেন ফেডারেশনের দল ইন্ডিয়ান অ্যারোজ়ে। তত দিনে আনোয়ারকে ভারতীয় ফুটবলের ভবিষ্যতের তারকা হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলেছেন বিশেষজ্ঞরা। এক বছরের মধ্যেই সঙ্কটে পড়ে যায় তাঁর ফুটবলজীবন।
ডাক্তারি পরীক্ষায় আনোয়ারের হৃদ্যন্ত্রে জন্মগত ত্রুটি ধরা পড়ে। চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন, পেশাদার ফুটবল আর খেলতে পারবেন না তিনি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ নিতে ফ্রান্সেও গিয়েছিলেন আনোয়ার। সেখানেও একই কথা শুনতে হয়েছে তাঁকে। এই পরিস্থিতিতে বাদ পড়েন জাতীয় দল থেকে। মহমেডানে সই করেছিলেন। খেলা তো দূরের কথা, অনুশীলন করার অনুমতিও দেয়নি এআইএফএফ। আনোয়ারকে কোচিং করানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল ফেডারেশনের তরফে। রাজি হননি তিনি। বলছিলেন, ‘‘ফুটবল ছাড়তে পারব না। চিকিৎসকরা বলে দিয়েছিলেন, পেশাদার ফুটবল খেলতে পারব না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করতাম, আবার খেলতে পারব। অবশেষে আমার পুনর্জন্ম হল। এফসি গোয়া ও আইএসএলের কাছে কৃতজ্ঞ আমাকে সুযোগ দেওয়ার জন্য। এ বার আমার লক্ষ্য জাতীয় দলের হয়ে খেলা।’’
দুঃসময়ে বাবা-মা ছাড়াও আনোয়ারকে উৎসাহ দিয়েছেন মিনার্ভা এফসি-র কর্ণধার রঞ্জিত বজাজ। বলছিলেন, ‘‘বাবা বলতেন, দুঃসময় সকলের জীবনেই আসে। লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। রঞ্জিত স্যরও সব সময় উৎসাহ দেন।’’
আনোয়ারের লড়াই এ বার জাতীয় দলে জায়গা করে নেওয়া।’