Badru Banerjee

Badru Banerjee: সবুজ-মেরুনের হয়ে তুমুল সাফল্য, তবে বদ্রু মনে থাকবেন অলিম্পিক্সের জন্যেই

মোহনবাগান ক্লাবকে দিয়েছেন বহু ট্রফি। তবে অলিম্পিক্সে দেশকে নেতৃত্ব দেওয়া তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা সাফল্য হয়ে থাকবে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০২২ ১২:০৭
Share:

বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল ছবি

শনিবার ডুরান্ড কাপের ম্যাচ খেলতে নামছে এটিকে মোহনবাগান। সেই দিন ভোরেই এল দুঃসংবাদ। সবুজ-মেরুনকে যিনি প্রথম ডুরান্ড কাপ জিতিয়েছিলেন, সেই সমর (বদ্রু) বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণের খবর এল। মোহনবাগানের হয়ে আট বছর খেলেছেন বদ্রু। অধিনায়কত্বও করেছেন। তাঁর সময়কালে ভারতীয় ফুটবলে এমন কোনও ট্রফি নেই যা মোহনবাগান জেতেনি। বাংলাকেও সন্তোষ ট্রফি জিতিয়েছেন। পরে নির্বাচক হন। জাতীয় দলেও তাঁর সাফল্য কম নয়। ১৯৫৬ মেলবোর্ন অলিম্পিক্সে ভারতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিলেন। কোয়ার্টার ফাইনালে হারলেও বদ্রুর ফুটবল-দক্ষতা নজর কেড়ে নিয়েছিল। ভারতীয় ফুটবল দল আরও তিনটি অলিম্পিক্সে খেললেও, বদ্রু যে সাফল্য এনে দিয়েছিলেন, তা আর কেউ পারেননি।

Advertisement

হাওড়ার বালিতে ১৯৩০ সালের ৩০ জানুয়ারি জন্ম বদ্রুর। বাড়িতে ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের চর্চা ছিল। বাবা শশাঙ্ক শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় ফুটবল ভালবাসতেন। প্রতি বিকেলেই বাড়ির উঠোনে ফুটবল নিয়ে আড্ডা হত। ছোট বদ্রু বসে বসে ময়দানি গল্প শুনতেন। বাবা প্রচণ্ড কড়া ছিলেন। ফলে পড়াশোনায় ফাঁকি মারার কোনও প্রশ্নই ছিল না। তবু ফাঁক পেলেই সেই আড্ডায় কান পাততেন বদ্রু। বাবা দেখতে পেলেই তাঁকে চলে যেতে বলতেন। তত দিনে বদ্রুর মাথায় মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহমেডান স্পোর্টিংয়ের মতো ক্লাবের নাম ঢুকে গিয়েছে।

ছোটবেলা থেকেই বালি হিন্দু স্পোর্টিং ক্লাবে খেলা শুরু। মাঝেমাঝে ফুটবল খেলতে যেতেন বালি ওয়েলিংটন ক্লাবে। স্কুল থেকে ফেরার পর ফুটবল পেটাতে যাওয়া এক প্রকার নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়। মোহনবাগানের ওয়েবসাইটে এক সাক্ষাৎকারে বদ্রু সেই প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “তখন থেকেই বুট পরে খেলা শুরু করেছিলাম। ফলে পরের দিকে যখন বুট পরে খেলার সুযোগ এল, তখন সতীর্থদের অসুবিধা হলেও আমার কোনও দিন হয়নি।”

Advertisement

অমল দত্ত, পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বদ্রু। তিন জনেই এখন চিরঘুমের দেশে। ছবি আনন্দবাজার আর্কাইভ

১৯৪৮-এ প্রথম বার পেশাদার চুক্তিতে সই বালি প্রতিভা ক্লাবে। কলকাতা ফুটবল লিগে তৃতীয় ডিভিশনে খেলতেন। প্রথম মরসুমেই নজর কেড়ে নেন। উঁচু ডিভিশনের বেশ কিছু ক্লাবের চোখে পড়ে যান। পরের মরসুমে বালি প্রতিভা ছেড়ে বিএনআরে যোগ দেন। সেখানে দুর্দান্ত খেলে ক্লাবকে চ্যাম্পিয়ন করেন এবং প্রিমিয়ার ডিভিশনে তুলে দেন।

তার পরেই যোগ মোহনবাগানে। প্রথম মরসুমে রাজস্থান ক্লাবের সঙ্গে যুগ্ম ভাবে আইএফএ শিল্ড জেতে সবুজ-মেরুন। প্রথম ম্যাচ গোলশূন্য হওয়ার পর রিপ্লে-তে ২-২ অমীমাংসিত হয়। পরের মরসুম, অর্থাৎ ১৯৫৩ সালে প্রথম বার ডুরান্ড কাপ জেতে মোহনবাগান। নকআউট পর্বে দুর্দান্ত খেলেন বদ্রু। সেমিফাইনালে বাগান ২-১ হারায় হায়দরাবাদ পুলিশকে। বদ্রু জয়সূচক গোল করেন। ফাইনালে জাতীয় প্রতিরক্ষা অ্যাকাডেমিকে ৪-০ গোলে হারায় মোহনবাগান। বদ্রু একটি গোল করেন।

১৯৫৪ সালে প্রথম বার দ্বিমুকুট জেতে মোহনবাগান। কলকাতা লিগের পাশাপাশি আইএফএ শিল্ড জেতে তারা। শিল্ডের ফাইনালে গোল করেন বদ্রু। তত দিনে সৈয়দ আবদুল রহিমের কোচিংয়ে জাতীয় দলে নিয়মিত খেলা শুরু করে দিয়েছেন। পরের মরসুমে মোহনবাগানকে প্রথম বার রোভার্স কাপ জেতান। আবার ফাইনালে গোল করেন বদ্রু। মোহনবাগান ২-০ হারায় মহমেডানকে। সে বছরই বাংলার হয়ে সন্তোষ ট্রফি জেতেন।

জীবনের সেরা সাফল্য বোধহয় ১৯৫৬ সালে। মেলবোর্ন অলিম্পিক্সে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ আসে বদ্রুর কাছে। হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচে ওয়াকওভার পাওয়ার পর, আয়োজক দেশকে ৪-২ গোলে উড়িয়ে দেয় ভারত। কোয়ার্টারে তৎকালীন যুগোশ্লাভিয়ার কাছে হেরে গেলেও অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ভারতের খেলা গোটা বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল। বদ্রু বলেছিলেন, “আমরা দ্রুতগতির ফুটবল খেলেছিলাম। প্রথমার্ধে অস্ট্রেলিয়া কিছুই করতে পারেনি। রাইট ইনসাইড ফরোয়ার্ড হিসাবে ওই ম্যাচে খেলেছিলাম। নেভিলের সঙ্গে (নেভিল ডি’সুজা, সেই ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেছিলেন) আমার বোঝাপড়া দারুণ কাজে লেগেছিল। রহিম সাহেব ব্যাপক কড়া ছিলেন। সকাল এবং সন্ধে প্রায় ক্রীতদাসদের মতো অনুশীলন করাতেন। উনি আমাদের মানসিকতা জানতেন। আমরা ওঁর আস্থার দাম রেখেছিলাম।”

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকে জীবনকৃতি সম্মান পাওয়ার সময়। ছবি আনন্দবাজার আর্কাইভ

সে বছর ক্লাবস্তরে আবার দ্বিমুকুট জেতে মোহনবাগান। গোলদাতার তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন বদ্রু। পরের বছর ক্লাবের অধিনায়ক করা হয় বদ্রুকে। তবে কোনও ট্রফি জিততে পারেনি মোহনবাগান। তিনটে ট্রফিতে রানার্স হয় তারা। মোহনবাগানের হয়ে খেলার সময় ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে চারটি এবং মহমেডানের বিরুদ্ধে পাঁচটি গোল করেন বদ্রু। ১৯৫৯ সালে বার্মা শেল কোম্পানিতে চাকরি পান। শিলিগুড়িতে পোস্টিং ছিল। তবু খেলার প্রতি ভালবাসা এতটাই ছিল যে কলকাতায় ট্রেনে করে এসে সপ্তাহান্তে অনুশীলন করতেন। কিন্তু বেশি দিন সে ভাবে চালাতে পারেননি। সে বছরই বুটজোড়া তুলে রাখেন।

ফুটবল থেকে অবসরের পর বড়িশা স্পোর্টিং ক্লাব এবং বাংলা দলকে কোচিং করানো শুরু করেন। ১৯৬১ সালে বাংলা সন্তোষ জেতে তাঁরই কোচিংয়ে। পরে কয়েক বছর নির্বাচক ছিলেন। বছর দুয়েক আগে বদ্রুর নামে মোহনবাগানের তরফে পোস্টাল স্ট্যাম্প প্রকাশ করা হয়। বয়স হয়েও গেলেও মাঝেমাঝেই মোহনবাগান ক্লাবে আসতেন। ক্লাব অন্তপ্রাণ ছিলেন।

২০১৭ সালে রাজ্য সরকারের তরফে তাঁকে জীবনকৃতি সম্মান তুলে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার আগে, ২০০৯ সালে তাঁকে ‘মোহনবাগান রত্ন’ সম্মান দেওয়া হয়। ফুটবল ছাড়াও তিনি ডাক্তারি পড়েছেন আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে। তবে ফুটবল এবং ডাক্তারির মধ্যে প্রথমটিই বেছে নিয়েছিলেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement