হেরেছে ত্রাসের স্মৃতি, চ্যাম্পিয়ন ফুটবল

আমেরিকা, ওরা বরাবর ছোট মনের। সেরা আমরা, আমাদের ফ্রান্স। এই যে, আপনাদের সামনে আইফেল টাওয়ার একটা সময় কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং ছিল। কিন্তু আমেরিকান তো, সহ্য হবে কেন? ওরা সঙ্গে সঙ্গে আইফেলের চেয়ে মাত্র পঞ্চাশ মিটার উঁচু একটা টাওয়ার বানাল।

Advertisement

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়

প্যারিস শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৬ ১০:১০
Share:

আমেরিকা, ওরা বরাবর ছোট মনের। সেরা আমরা, আমাদের ফ্রান্স। এই যে, আপনাদের সামনে আইফেল টাওয়ার একটা সময় কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং ছিল। কিন্তু আমেরিকান তো, সহ্য হবে কেন? ওরা সঙ্গে সঙ্গে আইফেলের চেয়ে মাত্র পঞ্চাশ মিটার উঁচু একটা টাওয়ার বানাল। জবাবে আমরা শুধু একটা অ্যান্টেনা বসিয়ে দিলাম, ব্যস! কিন্তু মার্কিন দম্ভের কাছে ওটাও যে হেরে যাবে, বুঝিনি। ওরা এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং বানাতে আমরা ছেড়ে দিলাম। লড়িনি আর। কিন্তু আমাদের আইফেলের মাদকতা ওদের এম্পায়ারে আছে তো? ক’জন যায় দেখতে? আমাদের কিন্তু বছরে সত্তর লক্ষ লোক আসে। বললাম না, ফ্রান্সই সেরা...।

Advertisement

মাথা দুলিয়ে, হাত নেড়ে, ব্যাখ্যা দিতে-দিতে ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন যে বছর পঁচিশের তরুণী, তাঁর পেশা জিজ্ঞেস না করেও লিখে ফেলা যায়। গাইড ইনি। দরকার পড়লে মোনালিসার দেশের হয়েও অনর্গল ইংরেজি বলতে পারেন পেশার দাবিতে। সত্যি-মিথ্যে যাচাইয়ের ইচ্ছে চাপা দিলে, বেশ লাগে শুনতে। প্রেক্ষাপট, পরিবেশ দেখলে ভাল লাগাটা বেড়ে যায় আরও। তরুণীর ঠিক পিছনেই নদী। নদীর উপর প্রমোদতরণী। টিকিট ডাকে হাতছানি দিয়ে।

বাঁ দিকে তাকালে চোখে পড়ে হুডখোলা ট্যুরিস্ট বাস, প্যারিসের পঞ্চাশ দ্রষ্টব্য দেখতে খরচ পড়বে কুড়ি ইউরো। আর্ক দ্য ত্রিয়ম্ফ, ল্যুভ্‌র, নত‌রদাম গির্জা— সব ঘুরে আসা যাবে। আবার তরুণীকে ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে যান, দেখবেন বিশাল একটা স্টেজ। জায়ান্ট স্ক্রিনের সামনে পরপর সাজানো কয়েকটা ফুটবল। ওটা আসলে আইফেল টাওয়ারের ফ্যান জোন, যার নীচে লেখা— প্যোর নস সি সঁ লে সার্পোতেরা কুই ফন্ত লে ফুটবল। আমাদের কাছে ফ্যানরাই সব। ফ্যানরাই ফুটবলের জন্ম দিয়েছে। ফুটবলকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

Advertisement

সন্ত্রাস কোথায়, সন্ত্রাস?

জিজ্ঞেস করলে ফরাসি মুখচোখ শক্ত হয়, চরম তাচ্ছিল্য মিশে থাকে কথাবার্তার স্রোতে। বাকি ইউরোপীয় দেশ, আন্তর্জাতিক মিডিয়া কম তো বলেনি! যন্ত্রণার ক্ষতে অপমানের নুন কম তো ছিটিয়ে যায়নি। ছিদ্রান্বেষী মনোভাব দেখিয়ে মিনিট-পিছু তুলে এনেছে ফুটবল-মহাযজ্ঞের নিরাপত্তা নিয়ে কয়েক হাজার প্রশ্ন। যার নির্যাস— এরা পারবে তো? পারবে তো শেষ পর্যন্ত? নভেম্বরের জঙ্গি হানায় একশো তিরিশ ফরাসির মৃত্যু ভুলতে পারেনি প্যারিস। ভুলতে পারবেও না কোনও দিন। কিন্তু আজ ইউরোর প্রাক-নকআউট পর্বের মোহনায় দাঁড়িয়ে নির্দ্বিধায় বলে দেবে, আইএস তাদের দেশের প্রতিরোধকে পঙ্গু করে দিতে পারেনি।

ফ্রান্স আঘাত পেয়েছে, বারবার আঘাত পেয়েছে। কখনও জঙ্গি হানা, কখনও বন্যা, কখনও ধর্মঘটীদের বিক্ষোভে। কিন্তু আঘাত পেলেও চূর্ণ হয়ে যায়নি। ফুটবল দিয়ে জিতিয়েছে নিজেকে। বাকি ইউরোপকে বার্তা দিয়ে যে, তোমরা সন্দেহ করেছিলে আমাদের প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর। ভেবেছিলে, ইউরোয় সন্ত্রাসই শিরোনাম হবে। ভুল করেছিলে। দিদিয়ের দেশঁর টিম ইউরো জিতবে কি জিতবে না, সময় বলবে। কিন্তু সম্মানের মহার্ঘ্য ইউরো-টা আমাদেরই থাকছে। ওটা আমরা জিতছি ফুটবলের ভাষা দিয়ে।

আইফেল টাওয়ারের প্রায় গায়েই যে স্যুভেনির কিয়স্ক, তার মালিক দিনোশিও যেমন। পোগবার নাম লেখা জার্সি পরে দোকানের চেয়ে বেশি দোকানের বাইরে ঘুরছিলেন। এবং ক্ষমতা থাকলে বোধহয় বাকি ইউরোপীয় দেশগুলোকে নিজেই দেখে নিতেন। “কোন দেশে আতঙ্ক নেই? কোন দেশে সন্ত্রাস নেই? লন্ডনে মারেনি ওরা? আপনাদের ভারতে মারেনি? শুধু ফ্রান্সেই হয়েছে?”

ফর্সা মুখ রাগে রক্তবর্ণ হতে থাকে ক্রমশ। শুক্রবার সকালে অন্তত এই আত্মপ্রত্যয়ী চেহারা দেখব বলে ভাবিনি। কিছুক্ষণ আগেই তো নতুন মূর্তিমান আতঙ্ক এসে উপস্থিত হয়েছে— ব্রেক্সিট। টিভিতে ফরাসি অ্যাঙ্করের উদ্বিগ্ন ছবি, সাংবাদিকদের ছুটোছুটি, কর্মব্যস্ত ফরাসি জনতাকে দাঁড় করিয়ে অনর্গল ‘বাইট’ নেওয়া, সবই তো ঘটছিল। কোনও কোনও ফরাসি কাগজে দেখা গেল, ব্রেক্সিটের প্রভাবে ফরাসি ফুটবলারদের ইংল্যান্ডে খেলা কতটা বিপন্ন হবে, তা নিয়ে চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে।

কিন্তু এঁরা— আইফেল টাওয়ার পার্শ্ববর্তী দোকান মালিক বা সঁজেলিজের বার্গার-বিক্রেতা হুগো, কেউ বুঝতে চাইবেন না ব্রেক্সিট কী। কেউ শুনতে চাইবেন না, নিরাপত্তা নিয়ে এখনও নিঃসংশয় হওয়া যায় না। এঁরা মনে করিয়ে দেবেন, ফ্রান্স কতটা রক্তাক্ত, তা নিয়ে না ভেবে লেখা উচিত আগামী রবিবার সাঁ দেনির আয়ার্ল্যান্ড বনাম ফ্রান্স ম্যাচটা নিয়ে। এঁরা বলে দেবেন, ছ’বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে ফ্রান্স কোয়ালিফাই করেছিল এই ম্যাচটা জিতে। থিয়েরি অঁরির হাত গিয়ে করা গোলে! ভাঙা ইংরেজিতে ঝাঁঝিয়ে উঠবেন, “ফ্রান্সের সমস্যা নিয়ে এত বলছেন। কোথাও কিছু চোখে পড়ল? ফ্রান্স সামলে নিয়েছে। পরে কিছু হলে আবার সামলে নেবে,” অদ্ভুত বিশ্বাসের সঙ্গে ভেসে আসে কথাগুলো।

বেয়োনেট তা হলে কি নেই? ভারী বুট, জলপাই রঙের পোশাক, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল দেখা গিয়েছে। অতি নিঃশব্দে, প্রায় ছায়ার মতো তারা আছে প্যারিসের সঙ্গে। কিন্তু তার উত্তরে ঠোঁটে ঠোঁট রেখে চুম্বনও আছে। ব্রেক্সিট-আতঙ্কের জবাবে একই দোকানের দু’পাশে ফ্রান্স-জার্মানির পতাকা উড়িয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বৈরিতাকে ভুলে যাওয়া আছে।

ওই তরুণী ঠিকই বলছিলেন। ফ্রান্সই পারে, আর পারে বলেই বোধহয় ফ্রান্স সেরা!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement