সুপ্রীতি কাছাপ। ফাইল ছবি
১৯ বছর আগের কুয়াশামাখা সেই রাতের কথা এখনও ভুলতে পারেন না বালমতী দেবী। পাঁচ সন্তানকে নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন স্বামী রামসেবক ওঁরাওয়ের জন্য। ছোট মেয়েটার বয়স মাত্র কয়েক মাস। ভাল করে হাঁটতেও শেখেনি। স্বামী ছিলেন চিকিৎসক। পাশের গ্রামে এক রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়েছিলেন কয়েক জন গ্রামবাসীর সঙ্গে। আর ফেরেননি। পর দিন সকালে গাছে বাঁধা অবস্থায় তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। নকশালদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল দেহ।
১৯ বছর পরে মুখে হাসি ফুটল বালমতীর। বাবার মৃত্যুর সময়ে যে মেয়েটা হাঁটতে শেখেনি, সেই সুপ্রীতি কাছাপ দৌড়তে দৌড়তে গোটা পরিবারের মুখে ফুটিয়েছেন হাসি। খেলো ইন্ডিয়ায় ৩০০০ মিটার দৌড়ে সোনা জিতে ভেঙে দিয়েছেন জাতীয় যুব রেকর্ড। ৯ মিনিট ৪৬.১৪ সেকেন্ডে দৌড় শেষ করেছেন। চেষ্টা করেও বালমতী আবেগ চাপতে পারলেন না। এক ওয়েবসাইটে তিনি বলেছেন, “নক্সালরা ওর বাবাকে মেরে দেওয়ার সময় হাঁটতেও পারত না। এত বছর ধরে ছেলেমেয়েদের মানুষ করার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। এখন মনে হচ্ছে, স্বপ্ন স্বার্থক। ছোটবেলা থেকেই দৌড়তে ভালবাসত। সেই দৌড়ই ওর জীবনে খুশির কারণ হয়ে দাঁড়াল। ওর বাবা বেঁচে থাকলে গর্বিত হতেন।” সাফল্যের দিনে বাবার কথা কি মনে পড়ছে? সুপ্রীতি বলেছেন, “বাবার মুখটা এখন ভাল করে মনে নেই। খুব ছোট ছিলাম তখন। তবে এই পদক বাবাকেই উৎসর্গ করছি।”
স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই লড়াইটা শুরু হয়েছিল বালমতীর। পাঁচ ছেলেমেয়েকে মানুষ করার কাজটা সহজ ছিল না। ঝাড়খণ্ডের গুমলা জেলার বুরু গ্রামের বালমতী স্বামীর মৃত্যুর পর চতুর্থ শ্রেণির একটি চাকরি পান। সেই চাকরি সামলে পাঁচ সন্তানকে মানুষ করার কাজ সহজ ছিল না। স্থানীয় স্কুলে পড়ার সময় থেকেই নরম মাটিতে দৌড়তেন সুপ্রীতি। স্কুলের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন, পদক পেতেন। আন্তঃস্কুল একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গিয়েই তাঁর জীবন বদলে যায়। চোখে পড়ে যান প্রভাত রঞ্জন তিওয়ারির। ঝাড়খন্ড ক্রীড়া অনুশীলন কেন্দ্রে সুপ্রীতিকে অনুশীলন করাতে শুরু করেন।
ঝাড়খন্ডের আদিবাসী মেয়ে হওয়ায় শারীরিক শক্তিতে ছোট থেকেই এগিয়ে ছিলেন সুপ্রীতি। প্রথম দিকে ৪০০ এবং ৮০০ মিটারে দৌড়তেন। তাঁকে দিয়ে দূরপাল্লার দৌড় করিয়েও কোচ দেখলেন, শ্বাসপ্রশ্বাসে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। প্রথমে ১৫০০ মিটার, পরে ৩০০০ মিটারে দৌড় করাতে থাকেন সুপ্রীতিকে। ২০১৬-য় জুনিয়র জাতীয় অ্যাথলেটিক্সে ফাইনালে ওঠেন সুপ্রীতি। ২০১৮-য় সাইয়ের অ্যাকাডেমিতে জায়গা পান এবং প্রাক্তন জাতীয় রুপোজয়ী প্রতিভা টোপ্পোর অধীনে প্রশিক্ষণ নেন।
২০১৯-এ আসে প্রথম জাতীয় পদক। ক্রস কান্ট্রি চ্যাম্পিয়নশিপে ২০০০ মিটারের রুপো পান। সে বছরই জাতীয় জুনিয়র অ্যাথলেটিক্সে ৩০০০ মিটারে ব্রোঞ্জ পান। গত বছরও ৩০০০ মিটারে রুপো এবং জুনিয়র ফেডারেশন কাপে ব্রোঞ্জ পান। প্রতিভা জানিয়েছেন, প্রথম দিকে গতি নিয়ে একটু সমস্যা থাকলেও এখন তা কাটিয়ে উঠেছেন সুপ্রীতি। আগে সপ্তাহে ৮০ কিমি দৌড়তেন। এখন ১১০-১২০ কিমি দৌড়ন। ২০২৬ এশিয়ান গেমসের জন্য এখন থেকেই তাঁকে তৈরি করতে শুরু করেছেন প্রতিভা।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।