দু’শোর কীর্তির পরে মাঠের বাইরে দুই স্পিনারের লড়াই

ডান দিক থেকে বাঁ দিক। বাঁ দিক থেকে ডান দিক। চড়চড়ে রোদের গ্রিন পার্কে হাতের ব্যাটটাকে ডান দিক, বাঁ দিক ক্রমাগত তলোয়ারের মতো ঘোরাচ্ছিলেন যিনি, লোকে তাঁকে চেনে রবীন্দ্র জাডেজা নামে। ধমনীতে রাজপুত রক্ত বইছে যাঁর, খোলা তলোয়ার নিজের বিয়ের ‘সঙ্গীতে’ অক্লেশে ঘোরান যিনি, তাঁর পক্ষে ব্যাটকে তলোয়ার ভেবে ঘোরানো আর আশ্চর্য কী?

Advertisement

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়

কানপুর শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৪:০১
Share:

ডান দিক থেকে বাঁ দিক। বাঁ দিক থেকে ডান দিক।

Advertisement

চড়চড়ে রোদের গ্রিন পার্কে হাতের ব্যাটটাকে ডান দিক, বাঁ দিক ক্রমাগত তলোয়ারের মতো ঘোরাচ্ছিলেন যিনি, লোকে তাঁকে চেনে রবীন্দ্র জাডেজা নামে। ধমনীতে রাজপুত রক্ত বইছে যাঁর, খোলা তলোয়ার নিজের বিয়ের ‘সঙ্গীতে’ অক্লেশে ঘোরান যিনি, তাঁর পক্ষে ব্যাটকে তলোয়ার ভেবে ঘোরানো আর আশ্চর্য কী? ঠিক তখনই ব্রডকাস্টারের ক্যামেরা জাডেজার পার্টনারকে ধরল। কী ভেবে যেন, প্যাড-হেলমেট পরে তিনি বাইরেটায় এসে বসলেন।

তিনি রবিচন্দ্রন অশ্বিন।

Advertisement

কে জানত, রবীন্দ্র জাডেজা নন। আগামী তিন ঘণ্টা আসল অসিচালনা করে যাবেন কোনও এক রবিচন্দ্রন অশ্বিন! করে যাবেন এক অদৃশ্য তলোয়ার নিয়ে। আর অশ্বিনের অসিহানায় বাইশ গজের প্রতিপক্ষ শুধু লুটিয়ে পড়বে না, আক্রান্ত হবে বাইশ গজের বাইরের পৃথিবীও।

রবিচন্দ্রন অশ্বিন বনাম হরভজন সিংহ তো লেগে গেল। লেগে গেল, অশ্বিনের টেস্টে দু’শো উইকেট নেওয়ার মহাকীর্তির দিনে। অশ্বিন বলে ফেললেন হরভজনের পূর্ব টার্নার-মন্তব্য নিয়ে। আর হরভজন শুনেটুনে পাল্টা বলে ফেললেন অশ্বিন নিয়ে, আনন্দবাজারে।

রবিবার সাংবাদিক সম্মেলনে অশ্বিন আসা পর্যন্ত হরভজন সিংহকে ঘিরে মেঘ সৃষ্টির ন্যূনতম আন্দাজ ছিল না। পুরোটাই বরং ছিল লম্বা-চওড়া, স্মিত হাসির ভারতীয় অফস্পিনারের কীর্তি নিয়ে। টেস্টে দ্রুততম দু’শো উইকেটের রেকর্ড ক্ল্যারি গ্রিমেটের। অশ্বিন নিলেন গ্রিমেটের চেয়ে একটা টেস্ট বেশি খেলে। ভারতীয় অফস্পিনারের সঙ্গে বরং ইয়ার্কি চলছিল যে, পোর্ট অব স্পেনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে শেষ টেস্টটা বৃষ্টিতে বারোটা না বাজলে, দ্রুততম দু’শো উইকেটের মালিক তিনিই হয়ে যেতেন! শুনে হেসে ফেললেন অশ্বিন। “ক্ল্যারি গ্রিমেট সম্ভবত আমার চেয়ে একটু বেশি ভাল মনের মানুষ। তাই রেকর্ডটা ওঁরই থাকল। সিরিয়াসলি, এতে আমার কোনও অসুবিধে নেই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আমার প্রচুর ভাল স্মৃতি আছে। আশা করি, পরেও থাকবে।”

টেনশনের চিহ্ন নেই। নেই বিতর্কের জঙ্গিহানা। না থাকাটাই স্বাভাবিক। একটু আগে যিনি নিউজিল্যান্ড ব্যাটিংয়ের ‘টাওয়ার অব প্রাইড’ কেন উইলিয়ামসনকে স্পিন-মায়ায় বন্দি করে ফেলেছেন, তুলে নিয়েছেন মোক্ষম তিন, তাঁকে ঘিরে এ সব ভাবনা আসে? বরং তখন তিনি বলছেন যে, একটা সময় বহু দিন টেস্ট ক্রিকেটের বাইরে থাকার যন্ত্রণা কী ভাবে তাঁকে আরও পরিণত করে তুলেছিল। “পরে অনেক বার বলেছি, ওই সময়টা আমাকে অনেক শিখিয়ে গিয়েছিল। তার পর নেমে পড়েছিলাম স্কিল আরও ধারালো করতে।”

অশ্বিন তখন দু’শো উইকেটের রাজপথে হেঁটে তুলে আনছেন সেরা মণি-মানিক্য। গত বছর নাগপুরে এবি ডে’ভিলিয়ার্সের উইকেট, যার পিছনে তাঁর ধুরন্ধর ফিল্ড সেট আপ ছিল। শ্রীলঙ্কা সফরে কুমার সঙ্গকারা। চলতি কানপুর টেস্টের প্রথম ইনিংসে কেন উইলিয়ামসন। যে বলটা নাকি অশ্বিনের অসম্ভব ভাল লেগেছে। “দু’শোটাও কিন্তু উইলিয়ামসন। খারাপ নয়, কী বলেন?” দু’শোর আবহে মেজাজ অসম্ভব ফুরফুরে।

হরভজন সিংহ নিয়ে প্রশ্নটা এল যখন, অশ্বিন রাগ বা বিরক্তি দেখাননি। ঘটনা হল, দিন কয়েক আগে ভারতীয় টার্নারের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন ‘টার্বুনেটর’। চারশো টেস্ট উইকেটের মালিক বলেছিলেন যে, ঘরের মাঠের র‌্যাঙ্ক টার্নার বানিয়ে নামলে, আদতে তাতে টেস্ট ক্রিকেটের ক্ষতি। তিনি আশা রাখেন যে, কোহালি-কুম্বলে জমানায় এটা পাল্টাবে। রবিবার যা নিয়ে অশ্বিনের মতামত জানতে চাওয়া হয়। প্রথমে ঠাট্টাচ্ছলে তিনি প্রশ্নকর্তাকে পাল্টা জিজ্ঞেস করেন, আমি না হয় আমার মতামত বলব। কিন্তু কী ভাবে লিখবেন আপনি? তার পর বলতে শুরু করেন, “আমি সত্যিই জানি না, মিডিয়ায় ব্যাপারটা কী ভাবে আসবে। তবে এটা বলব, এ সব পড়ার সময় আমাদের নেই। সত্যি বলতে, আমরা কেমন উইকেটে খেলব, তা আমরা ঠিক করি না। কুম্বলে বা কোহালি উইকেট রোল করে না, তাতে জলও দেয় না। দুর্ভাগ্যজনক লোকে এটা বোঝে না। আমাদের ক্রিকেটীয় ব্র্যান্ডকে উপভোগ করতে দেওয়া উচিত। ইংল্যান্ডে যখন টেস্ট দু’দিনে শেষ হয়ে যায়, কেউ তো কিছু বলে না। ভারতে হলেই দোষ?”

হরভজনের নাম সরাসরি কোথাও নেই। তবু হরভজন সিংহ প্রবল ভাবে আছেন। ভারতীয় স্পিনের বর্তমানের মন্তব্য শোনার পর পূর্বসূরিকে যোগাযোগ করা হলে, তিনি সরাসরি অশ্বিনের নাম আনলেন না। কিন্তু ঠিক অশ্বিনকে ‘টার্গেট হিট’ বানিয়ে দিলেন! হরভজন এই মুহূর্তে দেশে নেই। কিছুটা হোয়াটসঅ্যাপ, কিছুটা ফোনে অশ্বিনের মন্তব্য প্রসঙ্গে তাঁর পাল্টা যা এল, তা এ রকম:

‘‘ও কে?’’

“হা হা হা। ও সাফল্য উপভোগ করুক।”

‘‘ইস, আমরা যদি এ রকম উইকেট পেতাম বল করার জন্য!’’

“আমি আগের ইন্টারভিউয়ে যা বলেছি, সেটা এখনও বলব। তা থেকে সরে আসছি না।”

পরে ফোনে হরভজন বলছিলেন, বড় প্রেক্ষাপটের কথা ভেবেই তিনি কথাগুলো বলেছিলেন। এবং আজও বলবেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল যে, আপনারা যখন খেলতেন তখন এ সব টার্নারের সুযোগ-সুবিধে কি নিতেন না? শুনে পঞ্জাব-পুত্তর পরিষ্কার বলে দিলেন, তাঁদের সময়ে যা হত তাকে ‘লিটল ফেভার’ বলে। আর আজ যা হয়, তাকে অনায়াসে ‘লট অব ফেভার’ বলা যায়। “দু’টোয় তফাত আছে। এখন যা হয়, তা তো আর অল্পস্বল্প ফেভারের জন্য হয় না। ব্যাট এবং বলের মধ্যে একটা ব্যালান্স থাকা উচিত। এমন হওয়া উচিত নয় যেখানে ব্যাটসম্যান বা বোলার, কেউ একজন বেশি সুবিধে পেয়ে গেল।” রাতে আবার হোয়াটসঅ্যাপে প্রতিক্রিয়া পাঠালেন হরভজন, ‘‘পরিবেশ-পরিস্থিতির চেয়ে স্কিলটা ভাল হওয়া দরকার। কিন্তু কন্ডিশন বড় হয়ে গেলে স্কিল তখন পিছনে পড়ে যায়।’’

সব শুনলে, আবহ দেখলে, যে কোনও ক্রিকেটপ্রেমীর মন খারাপই হয়ে যাবে। কী হওয়ার ছিল, আর কী হল। কোথায় ‘অশ্বিন টু হান্ড্রেডের’ মধুচন্দ্রিমায় নেশাতুর থাকার কথা ছিল সমগ্র পারিপার্শ্বিকের, তা না হয়ে লেগে গেল দুই স্পিনারে। রক্তাক্ত হয়ে পড়ল মহাকীর্তির প্রেক্ষাপট, দু’শোর ঘোর ছিন্নভিন্ন করে দিল বিতর্কের অসি-চালনা।

ডান দিক থেকে বাঁ দিক। বাঁ দিক থেকে ডান দিক!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement