চেন্নাই জয়ের নায়ক। রবিবার বারাসতে ওয়েডসন। ছবি: উৎপল সরকার।
ইস্টবেঙ্গল ৩ : চেন্নাই সিটি এফসি ০
(ওয়েডসন, প্লাজা, ডিকা)
‘মাছেতে ইলিশ রাজা। খেলাতে ফুটবল। সেখানে সেরা আমার ইস্টবেঙ্গল।’ ম্যাচের আগে স্টেডিয়াম জুড়ে বাজছে এই গান। সঙ্গে গর্জন, গো ওয়েডসন। কাম অন প্লাজা।
গ্যালারিতে কোথাও মাথায় লাল হলুদ ফেট্টি পরা সমর্থক। কোথাও আবার ব্যানার ঝুলছে— আমরা সিংহের দল।
বারাসত স্টেডিয়ামের রং তখন লাল-হলুদ। বিভিন্ন মুহূর্তের কোলাজ নতুন প্রাণ যোগাচ্ছিল রবিবাসরীয় সন্ধ্যায়।
শিলিগুড়ির মহারণের আগে মোহনবাগান এক প্রকার অদৃশ্য চ্যালেঞ্জটা ছুঁড়ে দিয়েছিল। চব্বিশ ঘণ্টা আগে রবীন্দ্র সরোবরে আইজল এফসির বিরুদ্ধে জিতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীকে যেন বলেছিল, আ দেখে জরা। কিস মে কিতনা হ্যা দম! যার জবাবটাও চলে এলো গোল ও তিন পয়েন্টে। ওয়েডসনের প্রতিভার সৌজন্যে লাল হলুদ অর্কেস্ট্রা করল জয়ের ডাবল হ্যাটট্রিক। লিগ শীর্ষে উঠে মর্গ্যানের যে অশ্বমেধ ঘোড়ার থামার নাম নেই।
ম্যাচ শেষে তখন সাংবাদিক সম্মেলনের ঘরের বাইরে ভিড়। লাল হলুদ সমর্থকরা চেঁচিয়ে যাচ্ছেন, ‘ওয়েডসন ওয়েডসন’। গত দুই মরসুমে মোহনবাগান সমর্থকরা তো কম বলেনি, ‘আমাদের সনি নর্ডি আছে।’
এ বার লাল হলুদ সমর্থকরাও পেয়ে গিয়েছে তাঁদের ক্যারিবিয়ান তারকাকে। যিনি এখন মাঠে থাকা মানে বিপক্ষ কোনও উত্তর খুঁজে পায় না। যাঁর দুই পা হার মানতে জানে না। ম্যাড়ম্যাড়ে প্রথমার্ধের পরেও এ দিন যাঁর প্রতিভা তিন পয়েন্ট তুলে আনল। যাঁর ‘ক্যালিপসোয়’ আবার লিগ শীর্ষে উঠল লাল হলুদ।
কিন্তু মাঠে তিনি যতই ভয়ঙ্কর হন সাংবাদিক সম্মেলনে যেন পুরো উল্টো। মাথা ঠান্ডা। মুখ গুরুগম্ভীর। দেখে যেন মনে হচ্ছে তাঁর শরীরটাই শুধু এখানে বসে, মন পড়ে আছে এক সপ্তাহ পড়ে ডার্বিতে। বর্তমানে চোটে জর্জরিত সনি নর্ডি। কিন্তু এখন থেকেই শিলিগুড়ি ডার্বির ট্যাগলাইন— হাইতি বনাম হাইতি। সনি বনাম ওয়েডসন। নিজের ‘বন্ধু’ সনি নর্ডির বিরুদ্ধে খেলার আশায় ওয়েডসন বলছেন, ‘‘ম্যাচটা আমি বনাম সনি নয়। ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগান। আমি আর ও গোল করলে দুই ক্লাবই জিতবে। সনির সঙ্গে আমার প্রায়ই কথা হয় হোয়াটসঅ্যাপে। কিন্তু ফুটবল নিয়ে কিছু কথা বলি না। যা কথা হয় ফুটবলের বাইরে।’’
বারাসত স্টেডিয়াম মানেই সাম্প্রতিক কালে হয়ে উঠেছে লাল হলুদ দুর্গ। খুব কম দলই হাসিমুখে ও পয়েন্ট নিয়ে মাঠ ছাড়তে পারছে। আইজল একমাত্র সেই বীর সৈনিক যারা সাহস দেখিয়ে এক পয়েন্ট নিয়ে গিয়েছিল লাল হলুদের ডেরা থেকে।
রবিবার প্রথমার্ধে মনে হচ্ছিল সেই তালিকায় হয়তো যোগ হবে চেন্নাইও। গ্যালারির উন্মাদনার সঙ্গে তখন পাল্লা দিতেই পারছিল না মাঠের এগারো। মাঠের বাইরে যদি বোধনের আনন্দ হয় তখন মাঠে যেন বিসর্জনের আমেজ। গোলশূন্য চলছে। খেলায় কোনও চ্যাম্পিয়নশিপ দাবিদারের ছাপ নেই।
এক কথায়, ছন্দহীন লাল হলুদ। একটাও মুভ সঠিক তৈরি করতে পারছে না। ফাইনাল থার্ডে গিয়ে সমস্ত কিছু নষ্ট হচ্ছে। বল পজেশন বেশি রাখতে পারছে না। যেন গত পাঁচ ম্যাচের ফর্ম বাইরেই ফেলে এসেছে।
বিরতির পর যেন অন্য এক ইস্টবেঙ্গল নামল। যাঁরা অনেক বেশি ধারাল। অনেক বেশি ডিরেক্ট। যারা পাসিং ফুটবল খেলে মুভ তৈরির চেষ্টায় ছিল। গোল করার সুযোগ খুঁজছিল।
দুই অর্ধের লাল হলুদের খেলার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত থাকতে পারে। কিন্তু একটা জিনিস পাল্টায়নি— ওয়েডসন। শুরু থেকে শেষ যিনি একার হাতে টানলেন দলকে। প্রতিটা মুভ তৈরি করার চেষ্টায় ছিলেন। প্রতিটা মুভের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন। ডার্বির আগে সনির দেশজ তারকা থাকলেন কিন্তু পূর্ণ মেজাজে।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে লালরিন্দিকার চিপ করা পাস থেকে ওয়েডসনের গোলটা ছিল নিঁখুত প্লেসমেন্ট আর সঠিক টাইমিংয়ের যোগসূত্র। আবার প্লাজাকে বাড়ানো পাসটাও ছিল সেই ট্রেডমার্ক থ্রু বল। যে পাস থেকে উইলিস প্লাজা একটা জায়গায় বলটা পাঠাতে পারতেন। আর সেখানেই পাঠালেন— গোলে। ম্যাচের সেরা পারফরম্যান্স দিয়ে সাধারণত কোনও তারকার মুখে হাসি থাকে। কিন্তু এটা যে ওয়েডসন। যাঁর কাছে ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের কোনও নম্বর নেই। যিনি জানেন, আই লিগ শেষে ট্রফিটা না আসলে তাঁর এই সমস্ত পারফরম্যান্স যে কেউ মনে রাখবে না। ‘‘ফুটবলে আসল জিনিস হচ্ছে ট্রফি জেতা। নিজে পাঁচটা গোল করলাম সেটা নিয়ে ভাবছি না। চাই ট্রফিটা জিততে। না হলে কেউ মনে রাখবে না,’’ বলে দিলেন তিনি।
লালরিন্দিকার পেনাল্টিতে তিন গোেল জিতল ইস্টবেঙ্গল। ওয়েডসনের পাশে বসা ট্রেভর জেমস মর্গ্যান তবুও নির্লিপ্ত। টানা ছ’ম্যাচ জিতেও যাঁর মুখে উচ্ছ্বাস নেই। বরং চিন্তা যাতে ডার্বিতে প্রথমার্ধের ফুটবলটা না খেলে তাঁর দল। ‘‘আমরা প্রথমার্ধে ভাল খেলতে পারিনি। বিরতির পর অবশ্য দারুণ খেলেছি। এখনও উন্নতির আরও জায়গা আছে। কিন্তু জিততে পেরে খুব ভাল লাগছে,’’ বললেন মর্গ্যান।
সত্যিই তো উন্নতির আরও জায়গা আছে। ৪-৪-২-তে নামা ইস্টবেঙ্গল জিতল ঠিকই কিন্তু এখনও তিনটে জিনিস শোধরাতে হবে। এক, নড়বড়ে ডিফেন্স। বিশেষ করে বুকেনিয়া। এ দিনও যাঁর দুই একটা ভুলের মাসুল গুনতে হতেই পারত। দুই, ওয়েডসনের উপরেই সব কিছু করার চাপ পড়ে যাচ্ছিল। তিন, ফাইনাল থার্ডে অসংখ্য ভাল সুযোগ নষ্ট।
তবে কথায় আছে, একটা লিগে প্রতিটা ম্যাচে সুন্দর খেলে জিততে হবে এমন কোনও কথা নেই। সাত ম্যাচের পর তো শীর্ষেই লাল হলুদ। সঙ্গে ওয়েডসন প্রাপ্তিও তো রইলই। যিনি ডার্বির চাপ সামলাতেও এক প্রকার তৈরি। বললেন, ‘‘আমি আগেও অনেক ডার্বির আবহে খেলেছি। এই ডার্বিতে প্রথম বার খেলব। কিন্তু চাপের কিছুই নেই। শুধু চাই জিততে।’’
ইস্টবেঙ্গল: রেহনেশ, গুরবিন্দর, বুকেনিয়া, নারায়ণ, রাহুল(গুরুং), ওয়েডসন(রবার্ট), রওলিন, লালরিন্দিকা, নিখিল, প্লাজা, রবিন(হাওকিপ)।