সেই দশ নম্বর লকার। সেই লাল-হলুদ তাঁবু। সময়টা শুধু এগিয়ে গিয়েছে। ছবি: উৎপল সরকার।
মহম্মদ হাবিব। ইস্টবেঙ্গল তাঁবু। দুইয়ের যোগফল, তাও এক যুগ পরে! ঘটলে যে কী মহাবিস্ফোরণ হয়, তার জলজ্যান্ত সাক্ষী বৃষ্টিভেজা শুক্র-সন্ধের লাল-হলুদ। হামলে পড়া কর্তা-সমর্থক-মিডিয়ার থিকথিকে ভিড় থেকে ঘণ্টাখানেক পর কোনওক্রমে বেরোতে পারা যে বড়েমিঞা মধ্য কলকাতার হোটেলের ঘরে আনন্দবাজারকে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন তাঁর মনের অবস্থাও ঠিক যেন দুইয়ের যোগফল! একটা মহম্মদ হাবিব পুরোদস্তুর নস্ট্যালজিক। অন্যটা সেই ফুটবলার জীবনের মতোই টগবগ করে ফুটছে। একটা হাবিবের চোখে আবেগের জল টলটল করছে তো অন্যটার চোখে সেই পুরনো জোশের আগুন!
প্রশ্ন: ইস্টবেঙ্গল টেন্টে ঢুকে ঠিক কোন সময়টা মনের ভেতর সবচেয়ে বেশি আবেগ ঠেলে উঠছিল? গেট পেরনোর সময়? না, মাঠে পা রেখে? নাকি ড্রেসিংরুমে ১০ লেখা ওয়া়র্ডরোবের নীচে বসে?
হাবিব: চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর আগে আমাদের সময় শুধু ইস্টবেঙ্গল কেন, ময়দানের কোনও ক্লাবের ড্রেসিংরুমেই এ সব ওয়ার্ডরোব-ফোবের অস্তিত্ব ছিল না। ভাবতেই পারতাম না আমরা। ইস্টবেঙ্গল ড্রেসিংরুমে আমার আর আকবরের একটাই ড্রয়্যার ছিল। মাঝেসাঝে গৌতমও (সরকার) তাতে ভাগ বসাত। ওরও হোর্স, প্যান্টফ্যান্ট রেখে দিত। তবে হ্যাঁ, এত বছর পরে আমার ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের ড্রেসিংরুমে বসে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছিল! ওই কয়েক মিনিটেই কত টুকরো টুকরো সব পুরনো কথা মনে পড়ে গেল। যেগুলো হায়দরাবাদের বাড়িতে বসে কয়েক মাসেও আমার মনে পড়বে না।
ইস্টবেঙ্গল গেট পেরনোর সময় আবেগের চেয়ে আনন্দই হচ্ছিল বেশি। যাক গে, অনেক বছর পরে হলেও আমার পুরনো ক্লাবে শেষমেশ এলাম— এটাই ভাবছিলাম তখন।
তবে যদি সবচেয়ে বেশি আবেগের কথা বলেন তো সেটা ইস্টবেঙ্গল মাঠে পা দিয়ে হল আজ। চোখে জল এসে গিয়েছিল। ওহ! কী সব গোল করেছি, কী সব পাস দিয়েছি এই মাঠে! স্বপন (বল) আর নীতুর (দেবব্রত সরকার) সঙ্গে মাঠে পা রেখেই বাঁ দিকের গোলপোস্টের দিকে চোখটা চলে গেল। ফস্ করে মনে এল, লিগে কোনও একটা রেল ম্যাচে আজ মাঠে ঢুকে সেন্টার লাইনের যেখানটায় দাঁড়িয়েছিলাম ঠিক অত দূর থেকে প্রচণ্ড ভলিতে ওই গোলপোস্টে বল ঢুকিয়েছিলাম। এই সব স্মৃতি, আবেগের আলাদা দাম!
প্র: দেখলাম মাঠে ঢুকেই আপনি সাইডলাইনে জমা বৃষ্টির জল একটু তুলে কপালে ঠেকালেন!
হাবিব: ওটা কোনও মসজিদে ঢুকলে আমি করি। আল্লাহকে স্মরণ করে নেওয়া ওটা। ইস্টবেঙ্গল মাঠ আমার কাছে মসজিদের সমান! (দু’হাতে চোখের জল চাপতে চাপতে) ফুটবলকা কোই আল্লা হ্যায় তো উসকা দুয়া ম্যায় ইসি ক্লাবমে হি পায়া থা।
প্র: তা হলে সেই ক্লাবের তাঁবুতে বসে সাংবাদিক সম্মেলনে এ দিন কেন বললেন, আপনার জীবনে সেরা ম্যাচ মোহনবাগান ভার্সাস কসমস!
হাবিব: সেটা তো হতেই পারে। সেরা ম্যাচ আর প্রিয় ক্লাব তো আর এক জিনিস নয়। আমার জীবনের সেরা ম্যাচ হয়তো মোহনবাগান জার্সি পরে খেলা। কিন্তু বহু স্মরণীয় ম্যাচ আমি খেলেছি ইস্টবেঙ্গল জার্সি পরে।
প্র: ২০১৫-র ইস্টবেঙ্গল টেন্ট দেখে কেমন লাগল? ঝাঁ-চকচকে জিম, জাকুজি, ড্রেসিংরুম, প্রেস কর্নার, কাফেটেরিয়া...!
হাবিব: বিয়েবাড়ি-বিয়েবাড়ি মনে হচ্ছিল আমার। নীতুদের বললামও— এখনকার ফুটবলারদের কত সুযোগসুবিধে। আর আমরা কেবল ডাম্বেল ভেঁজে আর ডাল-ভাত খেয়ে খেলেছি।
প্র: র্যান্টি মার্টিন্স-অর্ণব মণ্ডলদের দেখে কি তা হলে মহম্মদ হাবিবের হিংসে হয়?
হাবিব: মোটেই নয়। বরং আনন্দ হয়। তবে পাশাপাশি অন্য একটা কথাও কিন্তু সত্যি— ভুখা পেট কা জোশ জাদা হোতা হ্যায়। সব কিছু সহজে পেয়ে গেলে আসল খিদেটা কমে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে একটা। তবে হ্যাঁ, এখনকার ইস্টবেঙ্গল টেন্ট দেখে প্রাক্তন ফুটবলার হিসেবে আমার গর্ব হচ্ছে। আমার ছেলে হাসিব বিদেশে থাকে। আজই জীবনে প্রথম বার ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে এল। হোটেলে ফেরার সময় বলছিল, পাপা, তোমার ক্লাবের টেন্ট তো ইউরোপিয়ান ক্লাবের মতো!
আর একটা কথা। আজ ইস্টবেঙ্গলে এত অফিশিয়াল, সাপোর্টার, প্রেসের সঙ্গে সঙ্গে কারেন্ট ফুটবলারদেরও দেখতে পেলে আমার আরও ভাল লাগত। দু’টো বিদেশি প্লেয়ারের সঙ্গে শুধু দেখা হল। তাও শুনলাম ওরা নাকি এসেছিল নিজেদের কী সব কাজে।
প্র: এ বারের ইস্টবেঙ্গল টিমকে সামনে পেলে কী বলবেন?
হাবিব: বলব, দেখো মেরা সিধা বাত— এত সুযোগসুবিধে পাচ্ছ যখন, তখন তোমাদের ট্রফি দিতেই হবে ক্লাবকে। সত্তরের দশকে একবার সন্তোষ ট্রফিতে সব টিম ট্রেনে চেপে খেলতে গিয়েছিল। আমরা বাংলা টিম গিয়েছিলাম প্লেনে। তো আমি সুধীর-গৌতম-ভৌমিকদের বলেছিলাম, আমাদের এত সুবিধে দিচ্ছে আইএফএ, ট্রফি জিতেই কিন্তু ফিরতে হবে। নইলে আর কলকাতাই ফিরব না। এবং বাংলাই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।
প্র: ‘মহমেডান কা শান’-এর চার বছর পর ইস্টবেঙ্গলের সর্বোচ্চ সম্মান ‘ভারত গৌরব’ পাচ্ছেন শনিবার। সত্যি করে বলুন, এর পরেও কোনও আক্ষেপ আছে?
হাবিব: সামনের চার বছরের মধ্যে মোহনবাগান থেকে এ রকম কোনও সম্মান পেলে ভীষণ খুশি হব (হাসি)।
প্র: ধরুন, পরের বছর ‘ভারত গৌরব’ বাছার ভার ইস্টবেঙ্গল আপনাকে দিল? কাকে বাছবেন?
হাবিব: (বেশ খানিকটা ভেবে) সুধীর কর্মকার। যদি না আগেই পেয়ে থাকে। তা হলে গৌতম সরকার।
প্র: বড়েমিঞাকে ময়দানে ধরা হয় সংযম-শৃঙ্খলার প্রতীক আর চিরকালের চ্যালেঞ্জার হিসেবে। প্রৌঢ় হাবিবও কি ময়দান থেকে কোনও চ্যালেঞ্জ এলে নিতে তৈরি?
হাবিব: জরুর। একেবারে বুড়ো হয়ে যাওয়ার আগে যদি ইস্টবেঙ্গল আমাকে একবার কোচিংয়ের সুযোগ দেয় তা হলে আমি আমার প্রিয় ক্লাবকে কিছু ফিরিয়ে দিতে চাই। মহমেডান-মোহনবাগানে কোচিং করেছি। বাকি আছে শুধু ইস্টবেঙ্গল!