আমি টেস্ট খেলা শুরু করেছিলাম ১৯৮৮ সালে। সচিনের টেস্ট অভিষেক হয় ঠিক তার এক বছর পর। কিন্তু এটা সত্যিই খুব অদ্ভূত যে আমরা দু’জনে ১৯৯৭-এর আগে টেস্টের ময়দানে একে অপরের মুখোমুখি হইনি।... তাই ভারত ক্যারিবিয়ান সফরে আসায় অবশেষে সচিনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামার সুযোগ পেয়ে দারুণ খুশি হয়েছিলাম। ... ক্যারিবিয়ান সফরে তেন্ডুলকরের চ্যালেঞ্জটা শুধু আমার আর কোর্টনি ওয়ালশের বিরুদ্ধে ভাল খেলাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। আর এক ব্যাটিং গ্রেট ব্রায়ান লারার সঙ্গে তুলনাটাও টানা সহ্য করতে হয়েছিল। সমান্তরাল কেরিয়ারে এই তুলনাটায় অবশ্য ওদের দু’জনকেই ক্রমশ অভ্যস্ত হতে হয়েছিল।
দু’জনে কিন্তু একেবারে দু’ধরনের প্লেয়ার। দু’জনেই মহান এবং দু’জনকেই আমি যে কোনও সময় আমার টিমে রাখব। তবে কে সেরা, এই তুলনাটায় কখনও ঢুকব না। কারণ ব্যাটসম্যান হিসাবে ওরা এতটাই আলাদা। ব্রায়ান লারা ছিল শোম্যান, ব্যাট করার সময় অনেক বেশি ঝুঁকি নিত। শোম্যান অবশ্য কোনও খারাপ অর্থে নয়। ও দর্শকদের মনোরঞ্জনকে গুরুত্ব দিত। গ্যালারির বিনোদনটা মাথায় রেখে খেলত। লারার ব্যাটিংয়ের ধরনটাই ছিল, বেশি শট, বেশি ঝুঁকি, স্ট্রোক খেলায় বেশি অ্যাডভেঞ্চার। তেন্ডুলকরও আপনাকে সমান বিনোদন উপহার দেবে। এমন সব শট খেলবে যা দেখে আপনি তড়াক করে লাফিয়ে উঠে পিঠ টানটান করে বসবেন। তবে তেন্ডুলকরের খেলায় লারার দেখনদারিটা ছিল না কারণ ও ঝুঁকি নেওয়া পছন্দ করত না। দু’জনেই অবশ্য সমান বিধ্বংসী। ব্যক্তিত্বেও বিশাল পার্থক্য। তেন্ডুলকরের চেয়ে ব্রায়ানকে আমি অনেক বেশি কাছ থেকে চিনি। কিন্তু তেন্ডুলকরের বৈশিষ্ট, সাফল্য ওকে বদলাতে পারেনি। এতগুলো বছরের এত রেকর্ড, এত প্রাপ্তির পরেও ও বরাবর বিনীত। এটা বিশাল গুণ। যে উচ্চতায় পৌঁছেছে, সেখানে দাম্ভিক হয়ে ওঠাটাই বরং সহজ ছিল। কিন্তু সফল্য ওর মাথা ঘোরাতে পারেনি। কখনও অন্য কাউকে ছোট করতেও দেখিনি। ওর পা সর্বদা মাটিতে। আর এই জন্যই তেন্ডুলকরকে আমি শ্রদ্ধা করি। ব্রায়ান আবার ঠিক উল্টো। ফুর্তি করতে, পার্টি করতে, দু-চার পাত্র পান করতে ভালবাসে। ও খুব বেশি দায়দায়িত্ব নেওয়ার মানুষ নয়। বরং জীবনটা উপভোগ করায় বিশ্বাসী। তবে ব্রায়ানের ব্যাপারে একটা কথা জোর দিয়ে বলতে পারি: একবার দড়ি টপকে মাঠে ঢুকে পড়ার পর ব্রায়ানের মাথায় জেতা আর বড় রান করার বাইরে দ্বিতীয় কোনও চিন্তা কাজ করত না। ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন্য ব্রায়ান প্রতিবার নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে।
লারা আর আমি একসঙ্গে থাকলে নেট সেশন দারুণ জমত। একে অপরকে টেক্কা দিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা চলত আমাদের মধ্যে।... নেট প্র্যাকটিস নিয়ে লারার কোনও দিন কোনও সমস্যা ছিল না। কিন্তু আমরা খুব বেশি শর্ট বল করা শুরু করলে প্রতিবাদ করত। অভিযোগের সুরে বলত, ‘‘সব শর্ট বল আমাকেই কেন?’’ আমি বলতাম খেলতে নেমে প্রতিপক্ষ পরপর শর্ট করলে ও তো আর এত শর্ট বল কেন বলে প্রশ্ন করতে পারবে না। বরং নিয়মিত নেটে শর্ট বল খেলার প্র্যাকটিস থাকলে ম্যাচে সুবিধে হবে। তাতে ও পাল্টা প্রতিবাদ করত, ‘‘মাঠে যা-ই হোক নেটে কেন? বরং আমাকে আরও বেশি পিচড আপ ডেলিভারি দাও।’’
বিরক্ত করে ব্যাটসম্যানের মনঃসংযোগ নষ্টের কয়েকটা কৌশল আমরা বোলাররা ব্যবহার করি। কিন্তু তেন্ডুলকরকে টলানো যেত না। ওর দিকে আমার কটমটে দৃষ্টিটা দিয়ে নিয়মমাফিক তাকাতাম ঠিকই কিন্তু জানতাম লাভ নেই, ও এতটাই সংযত। মনঃস্তাত্বিক লড়াইয়ে ওকে হারানো অসম্ভব ছিল। মনঃসংযোগের অবিশ্বাস্য ক্ষমতা সচিনের। ওকে ক্রিজে কখনও আবেগতাড়িত হতে দেখিনি।
(কার্টলে অ্যামব্রোজের আত্মজীবনী ‘টাইম টু টক’ থেকে নির্বাচিত অংশ। প্রকাশক ম্যাকমিলান)