জিদানের কোচিংয়ে নতুন রোনাল্ডোকে দেখা যাচ্ছে

ঘড়িতে তখন ক’টা বাজে... রাত আড়াইটে হবে। টিভি-তে চোখটা আটকে গেল। কয়েক সেকেন্ড আগে রোনাল্ডো গোলটা করেছে। কিন্তু তার জন্য নয়। গোলের পরের দৃশ্যটা এখনও ভুলতে পারছি না।

Advertisement

সুব্রত ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:৩১
Share:

বিরল মুহূর্ত। কোচ জিদানের সঙ্গে গোল উৎসব রোনাল্ডোর। ছবি: এএফপি।

রিয়াল মাদ্রিদ ২ (রোনাল্ডো, খেসে)

Advertisement

রোমা ০

ঘড়িতে তখন ক’টা বাজে... রাত আড়াইটে হবে। টিভি-তে চোখটা আটকে গেল। কয়েক সেকেন্ড আগে রোনাল্ডো গোলটা করেছে। কিন্তু তার জন্য নয়। গোলের পরের দৃশ্যটা এখনও ভুলতে পারছি না। যে ছেলেটা গোলের পর বেশিরভাগ সময় একা একা সেলিব্রেট করার জন্য সমালোচিত হয়, সে কিনা দৌড়ে গিয়ে একেবারে জড়িয়ে ধরল কোচকে!

Advertisement

রোনাল্ডোকে কি এতটাই বদলে দিলেন জিদান!

ফুটবলে একটা প্রচলিত কথা আছে— ফুটবলার আর কোচ কোনও দিন বেস্ট-ফ্রেন্ড হয় না। দু’জনের মধ্যে পেশাদার সম্পর্কটাই বেশি থাকে। আর এখানে তো একেবারে সুপারস্টার ফুটবলার তো প্রায় ততটাই ওজনদার কোচ। চূড়ান্ত ইগোর লড়াই দেখার আশঙ্কা যেখানে সবচেয়ে বেশি থাকে। তবুও রোনাল্ডো যখন জিদানকে জড়িয়ে ধরল, তখন দেখে মনে হল সত্যিই এটা একটা বিরল দৃশ্য। এই একটা দৃশ্যই বুঝিয়ে দিচ্ছে, জিদান এখন রিয়ালের শুধু মাত্র কোচ নন। দলের মনস্তাত্ত্বিকও। যিনি দলের মহাতারকাকে করে তুলেছেন টিমম্যান।

রোনাল্ডোর সম্পর্কে একটা অভিযোগ আমি মিডিয়ায় বার বার প়ড়েছি। ও নাকি নিজেরটা ছাড়া কিছু বোঝে না। দলের খেলা থেকেও নিজের উপর বেশি গুরুত্ব দেয়। নিজে গোল করতে না পারলে মুখ গোম়ড়া করে থাকে। সেলিব্রেট পর্যন্ত একা একা করে। রিয়ালের অনেক ম্যাচেই এ ধরনের টুকরো-টাকরা ছবি আমার চোখে পড়েছে। যা দেখে মিডিয়ার অভিযোগগুলো একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

বুধবার রাতে রোমের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে কিন্তু অন্য এক রোনাল্ডোকে দেখলাম। বল পাস দেওয়া থেকে নীচে নেমে ডিফেন্সকে সাহায্য করা, রোনাল্ডোকে সব সময় দেখলাম কোনও না কোনও ভাবে দলের কাজে আসতে। বেনিতেজের রোনাল্ডোকে দেখতাম, খুব বেশি নড়াচড়া করত না। বলটা জায়গা মতো পেলে গোলে ঢুকিয়ে দিত। জিদানের রোনাল্ডো এখন গোলও করছে, আবার ক্রমাগত উপর নীচ করে ডিফেন্স থেকে অফেন্স— সব কিছুই সামলাচ্ছে। টোটাল ফুটবল যাকে বলে। রোমার বিরুদ্ধে গোলটা তো অসাধারণ। যেমন ভাবে ডজ করে ফ্লোরেঞ্জিকে মাটিতে ফেলে বলটা প্লেস করল পুরো ‘ভিন্টেজ রোনাল্ডো’। ফ্রি-রোলে খেলায় বারবার পজিশনও বদলাচ্ছিল। অন্যদের খেলার জন্য জায়গাও তৈরি করছিল।

রোনাল্ডোকে দেখে মনেই হচ্ছিল আত্মবিশ্বাসে ফুটছে। যাকে কোচ তাঁর ‘ভোট অব কনফিডেনস’ দিয়ে রেখেছেন। বলে রেখেছেন, ‘তোমাকেই দলকে নেতৃত্ব দিতে হবে।’ জিদান খুবই ঠান্ডা মাথার কোচ। কোচ হওয়ার পরেই বুঝে গিয়েছেন, রিয়ালকে আবার চ্যাম্পিয়ন করতে হলে রোনাল্ডোকে গুরুত্ব দিতেই হবে। ওকে বোঝাতেই হবে, তুমি এই দলের লিডার। কিছুদিন আগে ইন্টারনেটেও দেখলাম রোনাল্ডোকে বিশ্বসেরা বলেছেন জিদান। মেসির চেয়েও উপরে রেখেছেন। এটাই তো একটা বুদ্ধিমান কোচের স্ট্র্যাটেজি। এই একটা কথা বলেই দলের আসল অস্ত্রকে অনেকটা তাতিয়ে দেওয়া যায়। আমি নিজেও মোহনবাগান কোচ থাকার সময় দলের তারকাদের সামলে রাখার আলাদা ছক কষতাম। প্রতিটা ম্যাচের আগে ব্যারেটো, ইগরদের সঙ্গে কথা বলতাম। কী রকম ভূমিকায় ওদের দেখতে চাই, পরিষ্কার করে দিতাম। বকাঝকা করলেও বলতাম সেটাকে মাথায় না রাখতে। বরং হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে আমায় ভুল প্রমাণ করতে। কোচকে ভুল প্রমাণ করাই তো কোনও বড় প্লেয়ারের লক্ষ্মণ।

জিদান কোচ হওয়ার পরে শুধু রোনাল্ডোই নয়, গোটা রিয়াল দলের চেহারাটাই বদলে গিয়েছে। গত কয়েক বছরে রিয়ালের খেলা দেখলে মনে হত এদের মধ্যে ব্যক্তিগত প্রতিভার অভাব নেই, কিন্তু দল হিসাবে খেলতে পারে না। ফুটবলারদের একে অন্যের সঙ্গে সে ভাবে কোনও যোগসূত্রও নেই। যদিও অল্প ক’দিন এসেছেন, কিন্তু জিদানের কোচিংয়ে রিয়ালকে দেখে এখন পরিপূর্ণ একটা দল মনে হচ্ছে। প্রতিটা ফুটবলার জানে তাকে কোথায় খেলতে হবে। মানসিক বোঝাপড়াটাও তৈরি হয়ে গিয়েছে। রোমার বিরুদ্ধে দেখলাম পাসিং মুভ তৈরি করে নির্দিষ্ট একটা গতি ধরে রেখে খেলল রিয়াল। ইস্কো, ক্রুসরাও ছন্দে ছিল। গ্যারেথ বেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ ফুটবলার না থাকলেও তার অভাব বুঝতে দিল না হামেস রদ্রিগেজ। মদ্রিচ পাসের পর পাস বাড়িয়ে গেল। ব্যাকফোরে র‌্যামোস-ভারানে-কারভাজাল-মার্সেলো পিনপয়েন্ট ট্যাকল করল। খেলা কখনও স্লো করেনি। খেসে রদ্রিগেজের মতো ফুটবলারও কী সুন্দর সোলো-রানে গোলটা করল। রোমা বেশ কিছু সুযোগ তৈরি করেছিল। কিন্তু রিয়াল ডিফেন্সের ফাঁদে পড়ে কোনওটাই কাজে লাগাতে পারেনি।

একটা ক্লাবের কোচিং দায়িত্ব যখন কোনও প্রাক্তনের হাতে পড়ে, তখন অনেক কিছু বদলে যায়। ফুটবলাররা বোঝে যিনি আমাদের কোচ তিনি নিজেও এক সময় ক্লাবের জন্য সর্বস্ব দিয়েছেন। আপনাআপনি তখন সম্মানবোধ চলে আসে। ফুটবলার আর কোচের মধ্যে তখন শিক্ষক-ছাত্রের মতো সম্পর্ক তৈরি হয়। ফুটবলাররা শিখতে চায়। আরও ভাল খেলতে চায়। রিয়াল ফুটবলাররা যখন টাচলাইনের দিকে তাকিয়ে জিদানকে দেখতে পাচ্ছে, তখন আপনা থেকেই ওরা চার্জড হয়ে যাচ্ছে।

এই রিয়ালের সামনে ফিরতি ম্যাচে রোমার আর সামান্যতম কোনও সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে জিদানের কোচিং কেরিয়ারের প্রথম ম্যাচ দেখার পর একটা কথা বলতে পারি। জিদান এমন এক জন ছাত্র যিনি মাধ্যমিকে যত নম্বর পাবেন, মাস্টার্সে তার থেকে আরও বেশি পাবেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement