রোমিয়ো নাথ। নিজস্ব চিত্র।
তুরস্কের জাতীয় ক্রিকেট দলে এক বাঙালি। নাম রোমিয়ো নাথ। আদতে উত্তর ২৪ পরগনার গোবরডাঙার বাসিন্দা। গত এক দশক ধরে তুরস্কের নাগরিক।
তুরস্কের হয়ে গোবরডাঙার রোমিয়ো খেলবেন ২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইউরোপ বিভাগের যোগ্যতা অর্জন পর্বে। এর আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কখনও দেখা যায়নি তুরস্ককে। ক্রীড়াবিশ্বে তুরস্কের পরিচয় মূলত ফুটবলের দেশ হিসেবেই। তারাই এখন আগ্রহী ক্রিকেটে। ২০ ওভারের বিশ্বকাপের জন্য প্রথম বার জাতীয় দল তৈরি করেছে তুরস্কের ক্রিকেট সংস্থা। রোমিয়ো জাতীয় দলের উইকেটরক্ষক-ব্যাটার। দলের সব থেকে ভাল ব্যাটারও তিনি।
দশ বছর আগেও ক্রিকেট নিয়ে কিছুই জানতেন না তুরস্কের মানুষ। এখনও খুব কম মানুষই জানেন। খেলেন না প্রায় কেউই। ২০১১ সালে পাকাপাকি ভাবে তুরস্কে চলে যাওয়া রোমিয়োরা সেখানে কী করে খেলেন ক্রিকেট! ইস্তানবুল থেকে আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি ঝরঝরে বাংলায় বললেন, ‘‘এখানে ব্যাট, বল, প্যাড, হেলমেট কিছুই পাওয়া যায় না। ভারত, পাকিস্তান, লন্ডন থেকে নিজেদের পরিচিতদের মাধ্যমে ক্রিকেট সরঞ্জাম আনাতে হয় আমাদের। ইস্তানবুলের হাতে গোনা কয়েক জন বাসিন্দা খেলেন। জাতীয় দলে একমাত্র ভারতীয় আমি। বাকিরা পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের। দু’তিন জন তুরস্কের ছেলে আছে। ওরাও তেমন খেলতে পারে না। তুরস্কের জাতীয় দল বলে কয়েক জনকে রাখা হয়েছে।’’
ভারতে থাকতে অবশ্য কখনও প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট খেলেননি পেশায় যোগব্যায়ামের শিক্ষক রোমিয়ো। আর পাঁচ জন বাঙালি ছেলের মতো গোবরডাঙার গলিতে টেনিস বলে ক্রিকেট খেলতেন। চামড়ার বলে প্রথম খেলেন বেঙ্গালুরুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়। সুযোগ পান বিশ্ববিদ্যালয়ের দলেও।
সেই বেঙ্গালুরুই রোমিয়োর তুরস্কে যাওয়ার কারণ। রোমিয়োর স্ত্রীও বেঙ্গালুরুর ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসেন। তিনি তুরস্কেরই বাসিন্দা। বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রেম। প্রেমের টানেই সটান ইস্তানবুলে ঘাঁটি। বন্ধুহীন সেই ঘাঁটিতে বিনোদনের খোঁজে শুরু ক্রিকেট খেলা। প্রথমে সেখানেই বসবাস করা কয়েক জন ভারতীয়ের সঙ্গে। পরে জুটে যান কয়েক জন পাকিস্তানি এবং আফগান। আরও পরে কয়েক জন তুর্কিও। রোমিয়ো বললেন, ‘‘এখানে ক্রিকেট বললে কেউ বুঝবে না। আমরা বেসবলের কথা বলে বোঝানোর চেষ্টা করি।’’
টিম বাসে সতীর্থের সঙ্গে রোমিয়ো নাথ (ডান দিকে)। নিজস্ব চিত্র।
ইউরোপের দেশগুলিতে গত কয়েক বছর ধরেই আইসিসি ক্রিকেটকে জনপ্রিয় করার কাজ করেছে। তারই অংশ হিসেবে তুরস্কেও ক্রিকেটের প্রসারে সচেষ্ট বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থা। সেই সুযোগ কাজে লাগান রোমিয়োরা। তুরস্ক প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। নতুন, অপরিচিত খেলা নিয়ে আগ্রহ দেখায় প্রশাসনও। রোমিয়ো বললেন, ‘‘আইসিসি এখন ক্রিকেটের উন্নতির জন্য প্রচুর টাকা দিচ্ছে। তাতে কাজ হয়েছে। ইস্তানবুলের ক্রীড়া প্রশাসকরা ক্রিকেট নিয়ে উৎসাহ পাচ্ছেন।’’
বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন করলে ভারতের বিরুদ্ধেও খেলতে হতে পারে। রোমিয়ো বললেন, ‘‘বিশ্বকাপ নিয়ে আমরা ভাবছি না। অত দূর যাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। ইউরোপের মধ্যেও খুবই দুর্বল দল আমাদের। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলার সুযোগ পাচ্ছি, এটাই আমাদের জন্য অনেক। আমাদের কয়েক জনের হাতেই তুরস্কে ক্রিকেট শুরু। এখন আমার বয়স ৪১। বুঝতেই পারছেন আমরা কোন পর্যায়ের! তাও চেষ্টা করব, যতটা আমাদের পক্ষে সম্ভব। প্রতিযোগিতার আগে প্রস্তুতি শিবিরও হবে আমাদের।’’
এখন ইস্তানবুলে রয়েছে তিনটি ক্রিকেট ক্লাব। তাদের মধ্যেই হয় প্রতিযোগিতা। জাতীয় দলের সব সদস্যই সেই তিনটি দলের সদস্য। রোমিয়োর ক্লাব ইন্ডিয়ান ক্রিকেট বডি থেকেই ১০জন রয়েছেন দলে। ইউরোপের দুই নম্বর গ্রুপের প্রথম পর্বের যোগ্যতা অর্জন পর্বে খেলবে তুরস্ক। আগামী ১২ জুলাই থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত খেলাগুলি হবে ফিনল্যান্ডে। তুরস্কের প্রতিপক্ষ সাইপ্রাস, রোমানিয়া, সার্বিয়া এবং আইল অব ম্যান। তুরস্কের প্রথম জাতীয় ক্রিকেট দলে সুযোগ পেয়ে খুশি রোমিয়ো। ভাল খেলে ক্রিকেটবিশ্বে তুরস্ককে পরিচিত করতে চান তাঁরা। রোমিয়োর এমন সাফল্যে উচ্ছ্বসিত মফস্সল শহর গোবরডাঙার মানুষও।
কখনও ভারতের বিরুদ্ধে খেলার সুযোগ পেলে পেশাদার ক্রিকেটারের মতোই খেলতে চান বিরাট কোহলী, হার্দিক পাণ্ড্যর ভক্ত রোমিয়ো। আইপিএল দেখেছেন। ভারত, পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার খেলা থাকলে টিভিতে দেখার চেষ্টা করেন। শেখার চেষ্টা করেন। ২০১৮ সালের পর আর বাড়ি আসা হয়নি রোমিয়োর। নিয়মিত কথা হলেও মায়ের হাতের রান্নার অভাব অনুভব করেন। ইচ্ছে আছে আগামী অক্টোবরে অধ্যাপক স্ত্রীকে নিয়ে গোবরডাঙার বাড়িতে আসার। দশটা বছর দুর্গাপুজো দেখা হয়নি যে। পুজোর পরেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। দুই মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে দেশে ফিরতে চান রোমিয়ো।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।