(বাঁ দিকে) বিরাট কোহলি এবং যশপ্রীত বুমরা (ডান দিকে)। ছবি: এএফপি।
নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে ঘরের মাঠে ০-৩ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজ় হারা ভারতীয় দলকে অস্ট্রেলিয়া স্বাগত জানিয়েছে পার্থের ২২ গজে। হঠাৎ নয়। অধিনায়ক রোহিত শর্মা প্রথম টেস্ট খেলতে পারবেন না, তা-ও জানা ছিল আগে। নিঃসন্দেহে কঠিন পরিস্থিতি। ভারতের ব্যাটিং তাকিয়ে ছিল বিরাট কোহলির দিকে। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ব্যাটার কোহলির সাফল্য আত্মবিশ্বাসী করেছিল গৌতম গম্ভীরদের। সেই বিরাটকে আশাহতই হতে হল। তবু দিনের শেষে ভাল কিছুর আশায় ভারতীয় শিবির। যশপ্রীত বুমরা, মহম্মদ সিরাজদের পাল্টা লড়াইয়ের জন্য।
স্টান্স বদলেও রান নেই কোহলির
কোহলি নিজে কি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন? সম্ভবত না। রানে না-থাকা কোহলি স্টান্স বদলে নেমেছিলেন পার্থে ব্যাট করতে। তাতেও রান এল না। ফর্মে ফেরার জন্য ব্যাটারেরা অনেক সময় স্টান্স পরিবর্তন করেন। উইকেটের সামনে একটু অন্য ভাবে দাঁড়ান ব্যাট হাতে। অনেকে সুফল পেয়েছেন। কোহলিও রানে ফেরার জন্য অস্ট্রেলিয়া সফরে নিজের স্টান্স বদলেছেন। কোহলি ব্যাট করার সময় সাধারণত মিডল এবং অফ স্টাম্প পরিষ্কার দেখা যায়। শুক্রবার ব্যাট করার সময় তাঁর শুধু অফ স্টাম্প দেখা যাচ্ছিল। মিডল স্টাম্প চলে গিয়েছে পায়ের আড়ালে। কোহলির ডান পা থাকে পপিং ক্রিজ়ের লাইনের উপরে বা ঠিক বাইরে। পার্থে কোহলি দাঁড়ালেন পপিং ক্রিজ়ের বেশ খানিকটা বাইরে। ব্যাটিংয়ে এত কিছু বদলেও ব্যাটে রানের জোয়ার ফেরাতে পারলেন না। করলেন ৫ রান।
আত্মবিশ্বাসের অভাব
কোহলির শরীরী ভাষায় আত্মবিশ্বাসের অভাব ফুটে উঠছে একটু বেশিই। ব্যাটিংয়ের সময় তো বটেই। ফিল্ডিংয়ের সময়ও। চনমনে থাকার চেষ্টা করলেও লাভ হচ্ছে না। দ্বিতীয় স্লিপে দাঁড়িয়ে বুমরার বলে মার্নাস লাবুশেনের ক্যাচ ধরেও ফেলে দিলেন। কঠিন ছিল না ক্যাচটি। সতীর্থেরা নিশ্চিত সাফল্যের আনন্দে মেতে উঠতেই কোহলি নিজেই শুকনো মুখে হাতের ইশারায় জানিয়ে দেন লাবুশেন আউট নন। পার্থ টেস্টে ভারতীয় দলের অধিনায়ক বুমরা নিজেও বিশ্বাস করতে পারেননি, কোহলি সহজ ক্যাচ ধরেও ফেলে দিয়েছেন।
কোহলির স্টান্স বদলানোয় প্রশ্ন
এ বারের অস্ট্রেলিয়া সফরের শুরুতে ব্যাট হাতে প্রতিপক্ষ শিবিরে লড়াই পৌঁছে দেওয়ার প্রধান কারিগর হতে পারতেন কোহলি। পারলেন না। রানে ফেরার তাড়নাই কোহলিকে সাফল্যের রাস্তায় ফিরতে দিল না। পার্থের দ্রুত গতির উইকেটে অসি জোরে বোলারদের সুইং ভাঙতে গিয়ে পরিস্থিতি কঠিন করলেন বাউন্সের মুখে পড়ে। কোহলির পরিবর্তন সমর্থন করতে পারেননি চেতেশ্বর পুজারা। প্রথম দিনের মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে পুজারার বিশ্লেষণ, ‘‘ক্রিজ় থেকে এগিয়ে দাঁড়ানোয় কোহলির পক্ষে উঁচুতে ওঠা বল সামলাতে সমস্যা হচ্ছে। বলের উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার সময় কম পাচ্ছে। ক্রিজ় থেকে এগিয়ে দাঁড়ালে বল উপরের দিকে ওঠার সময় খেলতে হয়। পার্থের মতো বাউন্সি পিচে এটা সঠিক কৌশল নয়।’’ আউটও হল সে ভাবে। উপরের দিকে ওঠার সময় বল কোহলির ব্যাটে ছুঁয়ে চলে যায় ফিল্ডারের হাতে। ক্রিজ়ের ভিতরে থাকলে বলটি সামলানোর সুযোগ পেতেন। বাংলার প্রাক্তন অধিনায়ক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘কোহলি স্টান্সে তেমন কোনও পরিবর্তন করেনি। সুইং ভাঙার জন্য পপিং ক্রিজ় থেকে খানিকটা এগিয়ে দাঁড়াচ্ছে। এতে বাউন্স সামলাতে সমস্যা হয়। বোলারের সঙ্গে দূরত্ব কমে যাওয়ায় ব্যাটার খেলার সময় কম পায়। কিছুটা আগে খেলতে হয়। অস্ট্রেলিয়ার বোলারেরা কোহলিকে সমানে খাটো লেংথের বল করে গিয়েছে। যে বলটায় আউট হল, তাতেও সময়ের অভাবে ব্যাট দিয়ে ফেলল।’’
অধিনায়ক বুমরার সিদ্ধান্ত
পার্থ টেস্টের প্রথম দিন শুধুই কোহলিময় নয়। আরও কিছুটা চিত্তাকর্ষক উপাদানে ভরা থাকল। ভারতের ব্যাটিং ব্যর্থতা। ৪৯.৪ ওভারে শেষ বুমরার দলের প্রথম ইনিংস। ঋষভ পন্থ (৩৭) এবং নীতীশ কুমার রেড্ডি (৪১) ছাড়া কেউ দাঁড়াতে পারলেন না। ওপেন করতে নামা লোকেশ রাহুলের (২৬) আউটের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন থাকল। বাকিরা ২২ গজের গতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারলেন না। ১৫০ রানে শেষ হল ভারতের ইনিংস। বর্ডার-গাওস্কর ট্রফির প্রথম চার ঘণ্টাতেই কোণঠাসা ভারত। টস জিতে বুমরা কার ভরসায় প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকল। কোহলির মুখের দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকলে বড় ভুল করেছেন। অধিনায়ক হিসাবে তাঁর কঠোর এবং বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল। অধিনায়ক হিসাবে আরও সাহসী হওয়া দরকার ছিল। বিশেষ করে যে ম্যাচে নিয়মিত টপ অর্ডারের দু’জন ব্যাটার নেই।
পাল্টা লড়াই বুমরাদের
ভারতের ইনিংসের শেষে বুমরার সিদ্ধান্তকে যতটা খারাপ দেখাচ্ছিল, দিনের শেষে ততটা খারাপ মনে হল না। মিচেল স্টার্ক, জশ হ্যাজলউড, প্যাট কামিন্সেরা অস্ট্রেলিয়াকে সুবিধাজনক জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। দিনের শেষে বুমরা, হর্ষিত রানা, সিরাজদের পাল্টা দাপটে সেই সুবিধা ধরে রাখতে ব্যর্থ অস্ট্রেলিয়া। কোহলি সহজ ক্যাচ ফেলে না দিলে, আরও সুবিধাজনক জায়গায় থাকতে পারত অস্ট্রেলিয়া। লাবুশেন ৫২ বল খেলে ২ রান করে আউট হলেন প্রায় শেষ বেলায়। ভারতের জোরে বোলারদের বিরুদ্ধে অস্বস্তিতে থাকলেও মাটি কামড়ে পড়েছিলেন। রান করার ঝোঁক ছিল না তাঁর ইনিংসে। বলের পালিশ তুলে দ্রুত পুরনো করে ফেলাই যেন ছিল তাঁর লক্ষ্য। লাবুশেন সম্ভবত দ্বিতীয় দিন সকালের কথা মাথায় রেখে খেলছিলেন। সেই সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য উইকেট বাঁচিয়ে রাখতে হত অস্ট্রেলিয়াকে। পারলেন না উসমান খোয়াজা, স্টিভ স্মিথ, ট্র্যাভিস হেডরা। ফলে দিনের শেষে অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংসে ৭ উইকেটে ৬৭। এখনও ভারতের থেকে ৮৩ রানে পিছিয়ে অস্ট্রেলিয়া। আয়োজকদের পক্ষে সর্বোচ্চ রান অ্যালেক্স ক্যারের অপরাজিত ১৯।
‘রং রুট’-এ স্মিথও
কোহলির মতোই দশা স্মিথের। নাম আছে, রান নেই। চোট-আঘাতে জর্জরিত কেন উইলিয়ামসনও। স্বমহিমায় কেবল জো রুট। বিশ্ব ক্রিকেটের ফ্যাব ফোরের তিন জনই যেন ‘রং রুট’এ। ডেভিড ওয়ার্নার অবসর নেওয়ার পর চারটি টেস্টে স্মিথকে দিয়ে ওপেন করানো হয়েছিল। রান পাননি। চোটের জন্য ক্যামেরন গ্রিন ছিটকে যাওয়ায় স্মিথকে তাঁর পছন্দের চার নম্বর জায়গা ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সিরিজ় শুরুর অনেক আগে ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে স্মিথের মতামত জেনে নিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার টিম ম্যানেজমেন্ট। প্রায় এক বছর পর পছন্দের জায়গায় ব্যাট করতে নেমেও স্মিথের অবদান শূন্য। বুমরার বলে উসমান খোয়াজা আউট হওয়ার পরের বলেই আউট স্মিথ। এক বলের বেশি ২২ গজে থাকতে পারলেন না। কোহলির মতোই দলকে চাপে ফেলে দিলেন অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন অধিনায়কও।
বোলারে বোলারে লড়াই
শনিবার পার্থ টেস্টের ভবিষ্যৎ লিখন হয়ে যেতে পারে। দু’দলের জোরে বোলারদের দাপটে ব্যাটারদের আত্মসমর্পণ বর্ডার-গাওস্কর ট্রফির প্রথম টেস্টকে সম্ভবত পাঁচ দিন গড়াতে দেবে না। ঘরের মাঠে অস্ট্রেলীয় ইনিংসের বেহাল দশা দেখে বুমরার সিদ্ধান্তকে ঠিক মনে হতে পারে। আসলে দলের ব্যাটিং ভরাডুবির পর নিজের সিদ্ধান্তকে সঠিক প্রমাণ করার দায় ছিল তাঁরই। বল হাতে সেই দায়িত্ব পালনও করলেন। ১৭ রানে ৪ উইকেট নিলেন। হ্যাজলউডও ৪ উইকেট নিয়েছেন ২৯ রান খরচ করে। কামিন্স, স্টার্কেরা যেমন হ্যাজলউডকে সঙ্গ দিলেন, তেমনই বুমরাকে সিরাজ, হর্ষিতেরা। সেয়ানে সেয়ানে নয়। লড়াই হচ্ছে বোলারে বোলারে।