গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
আগামী বছরের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি হবে হাইব্রিড মডেলে। ভারত ছাড়া সব দেশ খেলবে পাকিস্তানের মাটিতে। রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলিরা খেলবেন নিরপেক্ষ দেশে। ভারতের ম্যাচগুলি কোন দেশে হবে, তা চূড়ান্ত হয়নি। তবে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির হাইব্রিড মডেলে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডকে (পিসিবি) রাজি করাতে তাদের একটি শর্ত মেনে নিতে হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিলকে (আইসিসি)। ঠিক হয়েছে, ২০২৮ সাল পর্যন্ত আইসিসির সব প্রতিযোগিতায় ভারত এবং পাকিস্তান তাদের ম্যাচগুলি খেলবে নিরপেক্ষ কেন্দ্রে। অর্থাৎ, ভারতে দল পাঠাতে হবে না পিসিবিকে। ভারতীয় উপমহাদেশে ক্রিকেটীয় স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আইসিসির এই সিদ্ধান্তে কি অস্থির হতে পারে বাকি ক্রিকেট বিশ্ব? প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে ক্রিকেটমহলে।
ক্রিকেটমহলের আশঙ্কা, আইসিসির এই সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়তে পারে বাকি দেশগুলির উপর। ভারত এবং পাকিস্তান নিরপেক্ষ দেশে খেললে প্রতিযোগিতার অন্য দলগুলিকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সফর করতে হবে। একটি বা দু’টি ম্যাচ খেলার জন্য তাদেরও অন্য দেশে যেতে হবে। তাতে ক্রিকেটারদের উপর শারীরিক ধকল আরও বাড়বে। স্বভাবত ক্রিকেট বিশ্বের অন্য দেশগুলি আইসিসির এই সিদ্ধান্তে অখুশি হতে পারে। যেমন হয়েছিল ২০২৩ সালের এশিয়া কাপে। সে বারও পাকিস্তানে দল পাঠাতে রাজি হয়নি বিসিসিআই। ভারতের ম্যাচগুলি হয়েছিল শ্রীলঙ্কায়। ফলত প্রতিযোগিতার অন্য দলগুলিকে পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কায় যাতায়াত করে প্রতিযোগিতা খেলতে হয়েছিল। সফরের ক্লান্তি ছাড়া আরও একটা সমস্যায় পড়েছিল দলগুলি। তা হল, দু’দেশের আবহাওয়া পিচের চরিত্র ভিন্ন। তাই আবহাওয়া এবং পিচের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হয়েছিল বাংলাদেশ এবং নেপালকে। আফগানিস্তান শুধু তাদের দু’টি ম্যাচই পাকিস্তানে খেলার সুযোগ পেয়েছিল।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ তখনই আপত্তি জানিয়েছিল। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের এক কর্তা বিরক্তি নিয়ে বলেছিলেন, ‘‘এই পরিস্থিতিতে আমরা কার্যত অসহায়। প্রতিযোগিতায় প্রথম ম্যাচ আমরা খেললাম শ্রীলঙ্কায়। দ্বিতীয় ম্যাচ খেলতে যেতে হল পাকিস্তানে। আবার পরের দু’টি ম্যাচের জন্য ফিরতে হল শ্রীলঙ্কায়। এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের (এসিসি) সিদ্ধান্ত মানতেই হবে। দলের সফরে যাতে সমস্যা না-হয়, সে জন্য অবশ্য এসিসি বিশেষ বিমানের ব্যবস্থা করেছে। যে দলগুলিতে দু’দেশে ম্যাচ খেলতে হচ্ছে, তাদের সকলের জন্যই এই ব্যবস্থা করা হয়েছে।’’ তবু ক্রিকেটারদের বিমানযাত্রার ধকল বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল ক্রিকেটমহলের একাংশ। বিরক্তি গোপন করেনি বিসিবিও। তারা বলেছিল, ‘‘প্রয়োজনের বেশি যাতায়াতে সমস্যা তো বাড়েই। বিমান ধরার দু’ঘণ্টা আগে বিমানবন্দরে যেতে হয়। ব্যাগ, কিটস বয়ে নিয়ে যেতে হয়। শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তানের মধ্যে আকাশ পথে দূরত্ব খুব কম নয়। যথেষ্ট সমস্যা হলেও আমাদের কিছুই করার নেই। এসিসির সিদ্ধান্ত মেনে চলা ছাড়া উপায় কী!’’
২০২৩ সালের এশিয়া কাপে অংশগ্রহণ করেছিল ছ’টি দেশ। ২০২৬ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে থাকবে ২০টি দেশ। প্রতিযোগিতার কাঠামো অনুযায়ী ১২টি করে দেশকে খেলতে হতে পারে ভারত এবং পাকিস্তানের সঙ্গে। সেই সব দেশকেই দু’দেশে যাতায়াত করতে হবে। এতগুলি দেশ কি আইসিসির সিদ্ধান্ত বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেবে? প্রশ্ন উঠছে আইসিসির ঘোষণার পর থেকে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলবে এক দিনের ক্রিকেটে সেরা আটটি দেশ। তারা সকলেই আইসিসির পূর্ণ সদস্য। কিন্তু ২০২৬ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অনেক নতুন দেশ খেলতে পারে। নতুন দেশগুলি এমন নিয়ম কি মেনে নেবে? একাধিক দেশ অকারণ সফরে আপত্তি জানালে ধাক্কা খেতে পারে ক্রিকেটের বিশ্বায়ন নিয়ে আইসিসির চেষ্টা। নতুন দেশগুলি আগ্রহ হারাতে পারে এমন অবৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তের ফলে। আইসিসি কর্তারা যে বিষয়টি ভাবেননি, তা নয়। আগামী বছরের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির হাইব্রিড মডেল নিয়ে আলোচনার সময়ই তাঁদের মধ্যে আশঙ্কার দিকটিও আলোচিত হয়েছে। তবু আপাতত তাঁরা বিকল্প কোনও উপায় পাননি।
আঞ্চলিক রাজনীতির কারণে এই সমস্যা দীর্ঘায়িত হলে আইসিসির উচিত দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের খোঁজ করা। আইসিসির শেষ বোর্ড-বৈঠকে এমন সুর শোনা গিয়েছে একাধিক দেশের প্রতিনিধিদের মুখে। প্রতিযোগিতা আয়োজনের দায়িত্ব কোনও দেশকে দেওয়ার আগে সব সদস্য দেশের মতামত নেওয়া প্রয়োজন। আলোচনা করে নেওয়া দরকার সংশ্লিষ্ট প্রতিযোগিতার সম্প্রচার স্বত্ব পাওয়া টেলিভিশন সংস্থার সঙ্গেও। সব দেশের ক্রিকেট বোর্ড, বিজ্ঞাপনদাতা, টেলিভিশন সম্প্রচার সংস্থা এবং ক্রিকেটারদের মতামত জেনে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। না হলে প্রতিযোগিতা আয়োজনের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় সমস্যা হতে পারে বলে মনে করছে ক্রিকেট বিশ্বের একাংশ।
প্রশ্ন শুধু সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সহমত তৈরি নিয়ে নয়। প্রতিযোগিতার আর্থিক লাভ-ক্ষতির দিকটিও বিবেচনার মধ্যে রাখতে হচ্ছে। হাইব্রিড মডেলে প্রতিযোগিতা আয়োজন করতে বিপুল খরচ বাড়ে। তাতে আইসিসি এবং সংশ্লিষ্ট দেশের ক্রিকেট বোর্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রতিযোগিতার সম্প্রচারকারী টেলিভিশন চ্যানেলেরও লভ্যাংশ কমার বা ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। এ ছাড়া চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির জন্য অচলাবস্থার ফলে এখনও সূচি নিশ্চিত করা যায়নি। শুরু করা যায়নি টিকিট বিক্রি। ক্রিকেটারদের মতো ক্রিকেটপ্রেমীরাও অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। বার বার এমন হলে মাঠে গিয়ে খেলা দেখার আগ্রহ হারাতে পারেন ক্রিকেটপ্রেমীদের একটা অংশও।
সব মিলিয়ে ক্রিকেটের ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক বার্তা দিতে ব্যর্থ আইসিসি। এক দিকে আইসিসি কর্তারা চাইছেন, সারা বিশ্বে ক্রিকেটকে ছড়িয়ে দিতে। বিশেষ করে ইউরোপ এবং আমেরিকার বিভিন্ন দেশে ক্রিকেটের প্রসারের চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্ত আইসিসির প্রতিযোগিতাগুলিই এমন অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে হলে ক্রীড়াবিশ্বের উন্নত দেশগুলি ক্রিকেট নিয়ে আগ্রহ হারাতে পারে শুরুতেই। আবার অন্য দেশগুলিও এই উদাহরণকে সামনে রেখে নির্দিষ্ট কোনও কারণে নির্দিষ্ট কোনও দেশে গিয়ে খেলতে অস্বীকার করতে পারে। তাতে ভবিষ্যতে আরও বেশি চাপের সম্মুখীন হতে হবে আইসিসিকে।