বাবা বিধু বিনোদ চোপড়ার সঙ্গে তাঁর ছেলে অগ্নিদেব চোপড়া। —ফাইল চিত্র।
গত বছর রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক হয়েছে। প্রথম চারটি ম্যাচে পাঁচটি শতরান। এ রেকর্ড স্যর ডন ব্র্যাডম্যানেরও নেই। ২৫ বছরের তরুণ ব্যাটার মিজ়োরামের হয়ে এ বারও ফর্মে। পর পর দু’টি ম্যাচে দ্বিশতরান। সব মিলিয়ে আট ম্যাচে সাত সেঞ্চুরি। তিনি অগ্নিদেব চোপড়া। বাবার নাম বিধু বিনোদ চোপড়া।
বলিউডের চিত্র পরিচালকের পুত্র বুধবার মুখোমুখি আনন্দবাজার অনলাইনের। মিজ়োরামকে তৃতীয় ম্যাচ জিতিয়ে এখন তিনি মুম্বইয়ে। সেখান থেকেই ফোনে জানালেন, এ বার লক্ষ্য আইপিএলের গ্রহে ঢুকে পড়া। ‘থ্রি ইডিয়টস’, ‘টুয়েল্ভথ ফেল’-এর মতো সিনেমা যিনি উপহার দিয়েছেন, তাঁর ছেলের তেমন উৎসাহ নেই রুপোলি পর্দায়। তাঁর ধ্যান-জ্ঞান শুধুই ক্রিকেট।
শেষ ম্য়াচটির আগে পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আটটি ম্যাচ খেলেছেন অগ্নি। ১৬টি ইনিংসের সাতটিতে শতরান। অর্ধশতরান চারটি। গড় ৯১.১৩। অভিষেকের পর থেকে টানা চারটি ম্যাচে শতরানের নজির আর কারও নেই বলেই মনে করা হচ্ছে। ক্রিকেটের পরিসংখ্যান নিয়ে যাঁরা ঘাঁটাঘাঁটি করেন তাঁরা জানিয়েছেন, এটি বিশ্বরেকর্ড।
মিজ়োরামের হয়ে এ বারও ফর্মে অগ্নিদেব চোপড়া। —ফাইল চিত্র।
বিধু বিনোদের পরিচালনায় ‘টুয়েল্ভথ ফেল’ সিনেমা আলোড়ন ফেলেছিল। বহু মানুষ প্রশংসা করেছিলেন সেই সিনেমার। বাবার সেই ছবি মুক্তির পরেই অভিষেক ম্যাচে অগ্নির শতরানের কথা প্রকাশ্যে এসেছিল। তার পর বিশ্বরেকর্ড গড়েছিলেন। সেই কথা প্রথম জানিয়েছিলেন অগ্নির মা, চলচ্চিত্র সমালোচক অনুপমা চোপড়া।
অগ্নির জন্ম আমেরিকায়। তাঁর বাবা ‘থ্রি ইডিয়েটস’, ‘লাগে রাহো মুন্না ভাই’, ‘পিকে’, ‘সঞ্জু’র প্রযোজক। সেই সঙ্গে ‘খামোশ’, ‘১৯৪২: আ লভ স্টোরি’, ‘টুয়েল্ভথ ফেল’এর পরিচালক। মা-ও যেখানে চলচ্চিত্র সমালোচক, তাঁদের ছেলে হয়ে অগ্নি ক্রিকেটকে নিজের জীবিকা হিসাবে বেছে নিয়েছেন। সেটা কাকাকে দেখে। আনন্দবাজার অনলাইনকে অগ্নি বললেন, “মনে হয় বীর পাপার (বিধু বিনোদ চোপড়ার ভাই) থেকে ক্রিকেট খেলার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। তিনি আমার কাকু। কাশ্মীরে বড় হয়েছেন তিনি। তাঁর ক্রিকেটে আগ্রহ ছিল। তিনি জম্মু-কাশ্মীরের হয়ে খেলেছেন। উত্তরাঞ্চলের হয়ে খেলেছেন। বিষাণ সিংহ বেদীর বিরুদ্ধে খেলেছেন। বাবার কাছে গল্প শুনেছি। বীর পাপার সঙ্গে ক্রিকেট নিয়ে কথা হত। আমার পরিবারে একমাত্র তিনিই ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কয়েক বছর আগে কোভিডের সময়ে তিনি মারা গিয়েছেন।”
একেবারেই সিনেমাপ্রেমী নন। তাই খুব একটা সিনেমা দেখেনও না। অগ্নি বললেন, “সিনেমা দেখতে ভাল লাগে। তবে খুব একটা হলে যাওয়া হয় না। বাড়ি বসেই দেখি মাঝেমাঝে। আমি সিনেমা খুব যে ভালবাসি তেমনটা নয়।” তবে বাবার একটি সিনেমা খুব পছন্দ অগ্নির— ‘থ্রি ইডিয়েটস’। অনেক বার দেখেছেন। অগ্নি বললেন, “থ্রি ইডিয়েটস আমার খুব ভাল লেগেছিল। আমি অনেক বার দেখেছি সিনেমাটা। অনেক সময় ওই ছবির কোনও কোনও মজার দৃশ্যগুলো দেখি।”
মাত্র পাঁচ বছর বয়সে অগ্নিকে মুম্বইয়ের শিবাজি পার্কে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর মা। সেই শুরু ব্যাট ধরা। এর পর সাত বছর বয়সে এমআইজি ক্রিকেট ক্লাবে তাঁকে নিয়ে যান বিধু। সেখানে ছোট্ট অগ্নিকে দেখে কোচ বিশ্বাস করতে পারেননি তিনি ক্রিকেট শিখতে এসেছেন। কোচ বলেছিলেন, “তোমার দাদা কোথায়?” বিধু তখন বলেছিলেন, “ওর কোনও দাদা নেই। ও-ই ক্রিকেট শিখবে।” ছোট্ট অগ্নিকে নিতে রাজি ছিলেন না কোচ। কিন্তু নাছোড় অগ্নি কোচকে রাজি করানোর জন্য ক্লাবের মাঠে দৌড়তে শুরু করেন। দু’পাক দৌড়নোর পর কোচ রাজি হন তাঁকে নিতে। অগ্নি বললেন, “সেখান থেকেই আমার ক্রিকেট জীবন শুরু।”
মুম্বইয়ে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে খেলেছেন। কিন্তু সরফরাজ় খান, শ্রেয়স আয়ার, মুশির খানদের টপকে মুম্বই দলে জায়গা করে নিতে পারেননি। সেই কারণেই মুম্বই ছেড়ে ক্রিকেট খেলতে মিজ়োরাম চলে গিয়েছেন। বেঙ্গালুরুতে গত বছর ট্রায়াল নিতে এসেছিল মিজ়োরাম। সেখানে অগ্নিকে দলে নেওয়ার কথা ভাবে মিজ়োরাম ক্রিকেট সংস্থা।
গত মরসুমে রঞ্জি ট্রফিতে প্রথম ম্যাচে সিকিমের বিরুদ্ধে ১৬৬ রান করেছিলেন অগ্নি। দ্বিতীয় ইনিংসে করেন ৯২। দ্বিতীয় ম্যাচে নাগাল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম ইনিংসে ১৬৬ রান করার পর দ্বিতীয় ইনিংসে ১৫ রান করেছিলেন। তৃতীয় ম্যাচে অরুণাচল প্রদেশের বিরুদ্ধে দুই ইনিংসে যথাক্রমে ১১৪ এবং ১০ রান করেছিলেন তিনি। তবে নিজের সেরা পারফরম্যান্সটা দিয়েছিলেন মেঘালয়ের বিরুদ্ধে চতুর্থ ম্যাচে। দুই ইনিংসেই শতরান করেছিলেন তিনি। প্রথম ইনিংসে ১০৫ রানের পর দ্বিতীয় ইনিংসে ১০১ রান করেছিলেন। যে রেকর্ড ব্র্যাডম্যানেরও নেই। যদিও এই তুলনা শুনে লজ্জায় পড়ে গেলেন অগ্নি। তিনি বললেন, “ব্র্যাডম্যানের সঙ্গে আমার তুলনা করাটাই সম্ভব নয়। বিশ্বের সর্বকালের সেরা ব্যাটারদের এক জন তিনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ওঁর গড় ৯৯.৯৪। উনি যে পর্যায় খেলেছেন, আমি তো সেটা খেলিনি। তাই ওঁর সঙ্গে আমার তুলনাটা খুবই হাস্যকর লাগে আমার।”
রঞ্জির প্লেট গ্রুপে আলোচনার কেন্দ্রে এখন অগ্নিই। অনেকেই বলছেন প্লেট গ্রুপে থাকা দুর্বল দলের বিরুদ্ধে রান করেছেন তিনি। যে কথায় কান দিতে নারাজ অগ্নি। বললেন, “লোকেরা অনেক কথাই বলবে। কিন্তু দিনের শেষে আমি পারফর্ম করছি এবং এই প্লেট গ্রুপে খেলা অনেক ক্রিকেটারই সেটা করতে পারছে না। সকলে তো একই মানের বোলারের বিরুদ্ধে খেলছে। আমি বাস্তববাদী। আমার লক্ষ্য এখন একটাই, মিজ়োরামকে এলিট গ্রুপে তোলা। সেখানে খেললে কেউ বোলারের মান নিয়ে প্রশ্ন করতে পারবে না। সেখানে আমি মিজ়োরামের হয়েই খেলতে চাই।” মিজ়োরাম এলিট গ্রুপে না উঠলে তিনি অন্য কোনও দলের হয়ে খেলতে চাইবেন? অগ্নি বললেন, “আপাতত মিজ়োরামের হয়ে এই মরসুমে খেলা নিয়েই ভাবছি। বেশি দূরের কথা ভাবছি না।”
(বাঁ দিক থেকে) বিধু বিনোদ চোপড়া, অনুপমা চোপড়া এবং অগ্নিদেব চোপড়া। ছবি: সমাজমাধ্যম।
সামনেই আইপিএলের নিলাম। ভারতের বহু ঘরোয়া ক্রিকেটার সেখানে নাম লেখাবেন। গত বারের মতো অগ্নি এ বারেও নাম লিখিয়েছেন। নিজের যোগ্যতায় সেই লিগে সুযোগ পেতে চান তিনি। তবে অগ্নি বললেন, “হয়তো আমি এখনও সেই পর্যায়ে খেলতে পারিনি, তাই আইপিএলে সুযোগ পাইনি। নিজের যোগ্যতায় সুযোগ পেতে চাই।’’ খ্যাতনামী বাবার সাহায্য এ ক্ষেত্রে একেবারেই চান না। বললেন, ‘‘আমার বাবা কখনও কাউকে ফোন করে বলবে না আমাকে দলে সুযোগ দেওয়ার জন্য। আমাকে ভাল খেলতে হবে, যাতে আমার বাবাকে ফোন করে লোকে বলে দলে নেওয়ার কথা। যদি বাবার কারণে কেউ আমাকে দলে নেয়, তা হলে প্রথম একাদশে সুযোগ পাব না। আমি এমন কোনও দলে থাকতে চাই না, যারা আমাকে নিয়ে বসিয়ে রাখবে।”
কোন দলের হয়ে খেলতে চাইবেন আইপিএলে? উত্তরে অগ্নি বললেন, “দর্শক হিসাবে আমার প্রিয় দল মুম্বই ইন্ডিয়ান্স। যে হেতু আমি মুম্বইয়ের ছেলে তাই মুম্বইকেই সমর্থন করি। কিন্তু আইপিএলে সুযোগ পেলে যে দল নেবে তাদের হয়েই নিজের সেরাটা দেব।”
এ বারের রঞ্জিতে সিকিমের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচে অর্ধশতরান করেছিলেন অগ্নি। তবে সেই ম্যাচ জিততে পারেনি মিজ়োরাম। দ্বিতীয় ম্যাচে অরুণাচলের বিরুদ্ধে প্রথম ইনিংসে শতরানের পর দ্বিতীয় ইনিংসে দ্বিশতরান করেন অগ্নি। সেই ম্যাচ জিতে নেয় মিজ়োরাম। তৃতীয় ম্যাচেও দ্বিশতরান করেন অগ্নি। তাঁর ২১৮ রানের উপর ভর করেই মণিপুরের বিরুদ্ধে প্রথম ইনিংসে ৫৩৬ রান তোলে মিজ়োরাম। পর পর দু’টি ইনিংসে দ্বিশতরান করে আবার চর্চায় অগ্নি। মুম্বইয়ে জায়গা না পাওয়া ‘টুয়েল্ভথ ফেল’ অগ্নি এখন সাফল্যের শিখরে।