বিরাট কোহলির সঙ্গে হিমাংশু সাঙ্গওয়ান। ছবি: সংগৃহীত।
বিরাট কোহলিকে আউট করেছেন তিনি। হিমাংশু সাঙ্গওয়ানের নাম এখন সকলেই জেনে গিয়েছেন। তারকা হলে কেমন লাগে তা বুঝতে পারছেন তিনি। দিল্লির ভাড়াবাড়িতে বসে তা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছেন হিমাংশু। আনন্দবাজার অনলাইনকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় বলছিলেন তাঁর ফোন সব সময় ব্যস্ত থাকছে। বন্ধুরাও ফোন করে ৩০ মিনিট কথা বলছেন। কেউ তাঁকে ছাড়তেই চাইছে না। একটি উইকেট তাঁর গোটা জীবন বদলে দিয়েছে।
হিমাংশুর জন্ম দিল্লির নজফগড়ে। যে শহর থেকে বীরেন্দ্র সহবাগ, প্রদীপ সাঙ্গওয়ানের মতো ক্রিকেটারেরা উঠে এসেছিলেন। তবে বাবা কর্মসূত্রে চলে যান রাজস্থানে। হিমাংশুও তাঁর সঙ্গে যান। সেখানেই ক্রিকেট খেলা শুরু। কিন্তু এক কোচ তাঁকে বলেছিলেন ক্রিকেট খেলতে হলে দিল্লি ফিরে যেতে। কারণ রাজস্থানের থেকে দিল্লিতে ক্রিকেট খেলার সুযোগ বেশি পাওয়া যায়। সেটাই করেছিলেন হিমাংশু। ফিরে গিয়েছিলেন দিল্লিতে। শুরু করেছিলেন ক্লাব ক্রিকেট খেলা। সুযোগও পান। ঋষভ পন্থ এবং তাঁর একসঙ্গে অভিষেক হয়েছিল দিল্লির অনূর্ধ্ব-১৯ দলে। কিন্তু একটাই ম্যাচ। আর সুযোগ হয়নি দিল্লির হয়ে খেলার। এই কারণেই রেলওয়েজ়ের দলে ট্রায়াল দিয়েছিলেন।
হিমাংশু গড়গড় করে বলছিলেন তাঁর বেড়ে ওঠার গল্প। কিন্তু তাঁর কাছ থেকে সকলে তো শুনতে চাইছে কোহলিকে আউট করার কাহিনি। হিমাংশু বললেন, “বিরাট ব্যাট করতে নামতেই আমাদের সকলের মধ্যে বাড়তি তাগিদ কাজ করছিল। কখনও এত লোকের সামনে খেলিনি। মাঠে এত লোক, মনে হচ্ছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। যে কারণে সকলেই বাড়তি কিছু করার তাগিদ অনুভব করছিল। এই জন্য আমাদের বোলারেরা নো বলও করে। বিরাট আমাকে যে বলটাতে চার মেরেছিল, ওটাই আমাকে তাতিয়ে দেয়। পরের বলটা আমি ব্যাকস্পিন করেছিলেন। মহম্মদ শামিকে আমি ওই রকম বল করতে দেখেছি। সেটাই করার চেষ্টা করেছিলাম। দেখবেন বলটা মাটিতে পড়ার পর সোজা যাচ্ছিল। ব্যাটের কাছে গিয়ে ভিতর দিকে ঢোকে, যে কারণে ব্যাট আর পায়ের মাঝখান দিয়ে গিয়ে উইকেট ভেঙে দেয়।”
বিরাটকে আউট করা বলেই তাঁর সই নিয়েছেন হিমাংশু। ছবি: সংগৃহীত।
শামির অসম্ভব ভক্ত হিমাংশু। তাঁর সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা রয়েছে। শামির সঙ্গে তাঁর তুলনা হলে খুব আনন্দ পান। ২০১৯ সালে মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে ৫ উইকেট নেওয়ার পর তাঁর একটা ছবি উঠেছিল বল হাতে। সেই ছবি দেখে অনেকে তাঁর সঙ্গে শামির সাদৃশ্য পেয়েছিলেন। হিমাংশু তা দারুণ উপভোগ করেন। শামির জার্সি নম্বর ১১। সেই কারণে তিনিও ১১ নম্বর জার্সি পরেন। শামির সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়নি তাঁর। বললেন, “আমি শামির বিরাট ভক্ত। ওঁর মতো বোলিং করতে চাই। শামির মতো সিম পজিশন কোনও বোলার রাখতে পারে না। আমি চেষ্টা করি করার। কিন্তু শামির মতো হয় না। অনুশীলন করে যাই।”
বিরাটকে উইকেট নিয়ে যেমন তাঁর জীবন বদলে গিয়েছে, তেমনই শনিবার মাঠের পরিবেশ এক বলে বদলে দিয়েছিলেন হিমাংশু। বললেন, “সকলে বিরাটকে দেখতে এসেছিল। কিন্তু আমরাও তো খেলতেই নেমেছিলাম। উইকেট নেওয়ার পরেই মাঠ থেকে বেশির ভাগ দর্শক বেরিয়ে গিয়েছিল। খারাপ লেগেছিল। তবে যাঁরা মাঠে ছিলেন, তাঁরা প্রশংসা করছিলেন। বিরাটও আমার প্রশংসা করে।”
দিল্লির ইনিংস শেষে সাজঘরে ফিরছিলেন হিমাংশু। সেই সময় দেখা হয় বিরাটের সঙ্গে। এগিয়ে এসে কথা বলেন বিরাটই। ভারতের প্রাক্তন অধিনায়ক কী বলেছিলেন? হিমাংশু বললেন, “বিরাটকে আমার খুবই পছন্দ। ওর থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। দিল্লির অনুশীলন শুরু হওয়ার ১৫ মিনিট আগে এসে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল। দলের আগে মাঠে চলে এসেছিল ও। এত বড় মাপের একজন ক্রিকেটারের থেকে এটা শেখার। নিজে থেকে এগিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেছিল। বিরাট ভাই বলল, ‘দারুণ বল। তুমি প্রদীপ সাঙ্গওয়ানের ছোট ভাই?’ আমি বলি, ‘প্রদীপ ভাই আমার দাদার মতো। একই শহরে থাকি আমরা।’ আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম একটা সই পাব কি না। বলেছিল মধ্যাহ্নভোজের সময় দেখা করতে।”
বিরাটকে যে বলে আউট করেছিলেন, সেই বল নিয়েই তাঁর কাছে গিয়েছিলেন হিমাংশু। তিনি বললেন, “আমি ওই বলটা নিয়েই গিয়েছিলাম সই নিতে। বিরাট ভাই সই দেওয়ার সময় জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এটা কি ওই বলটাই?’ আমি হ্যাঁ বলি। হেসে বিরাট ভাই বলল, ‘এটা ভাল করেছ।’ আমার সঙ্গে ছবিও তোলে।”
হিমাংশুর ক্রিকেটার হওয়ার নেপথ্যে পরোক্ষ ভাবে রয়েছেন বিরাটও। ২০০৮ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জিতেছিল ভারত। সেই দলের অধিনায়ক ছিলেন বিরাট। হিমাংশুর তখন ১৩ বছর বয়স। বিরাটের সেই দলে ছিলেন প্রদীপ সাঙ্গওয়ান। হিমাংশু বাবার সঙ্গে খেলা দেখছিলেন। সেই সময় সাঙ্গওয়ান পদবির এক জন বোলারকে বল করতে দেখে ক্রিকেট খেলার কথা ভেবেছিলেন তিনি। বিরাটের দলের সেই বিশ্বকাপ জয়টাই হিমাংশুর ক্রিকেট খেলার অনুপ্রেরণা।
দিল্লিতে ভাড়াবাড়িতে থাকেন হিমাংশু। সেটাই এখন তাঁর বাড়ি। বললেন, “প্রায় ১৫ বছর আগে রাজস্থানে মা-বাবাকে ছেড়ে চলে এসেছি। এখন দিল্লিতে থাকি। যে বাড়িতে ভাড়া থাকি, তাঁরাই আমার পরিবার। শ্রীকৃষ্ণের দু’জন মা-বাবা ছিল। আমারও দু’জন মা-বাবা। রাজস্থানে আমার জন্মদাতারা থাকে, আর দিল্লিতে আমার পালক পিতা-মাতা। ওরাই আমার খেয়াল রাখে।”
বিরাটকে আউট করার পর থেকেই বাড়ির পরিবেশ বদলে গিয়েছে। সকলে আনন্দ করছে। বন্ধু, প্রতিবেশীরা দেখা করতে আসছে। হিমাংশু বললেন, “শনিবার মাঠ থেকে বেরিয়ে দেখি ফোনে ৩০০ জনের মিস্ড কল। তার পর থেকে আমার ফোন সব সময় ব্যস্ত। কেউ না কেউ ফোন করছে। ৩০-৪০ মিনিট কথা বলছে। আমার পৃথিবীটা বদলে গিয়েছে। সমাজমাধ্যমে আমার নামে কত ভুয়ো অ্যাকাউন্ট। একটা ভুয়ো অ্যাকাউন্ট থেকে আমার ছবি, ভিডিয়ো পোস্ট করে ১৮ হাজার ফলোয়ার পেয়ে গিয়েছে। কী ভাবে সেটা বন্ধ করা যায় দেখছি।”
২০১৯ থেকে রঞ্জি ট্রফি খেলছেন হিমাংশু। রেলের হয়ে অনূর্ধ্ব-২৩ দলে খেলে নজর কেড়েছিলেন। সেখান থেকেই রঞ্জির দলে সুযোগ। পাঁচটি রঞ্জিতে ২৪ ম্যাচ খেলে ৮১টি উইকেট নিয়েছেন ডানহাতি পেসার। তিনটি ইনিংসে পাঁচ উইকেট রয়েছে তাঁর। লিস্ট এ ক্রিকেটে ১৭ ম্যাচে ২১টি উইকেট নিয়েছেন। স্বপ্ন দেখেন ভারতের হয়ে খেলার। তবে তারকার সম্মান পাওয়া হিমাংশুর পা এখনও মাটিতেই। জানেন আরও ভাল বল করতে হবে নির্বাচকদের নজরে আসার জন্য। আইপিএলে সুযোগ না পাওয়া হিমাংশু এখন অপেক্ষায় পরের মরসুমের।