চর্চায়: নতুন মুকুট কি অপেক্ষা করছে মহারাজের জন্য? বাড়ছে সম্ভাবনা।
সদ্য পঞ্চাশতম জন্মদিন কাটিয়ে ওঠা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মুকুটে কি নতুন পালক যোগ হতে চলেছে? আরও বড় উপহার অপেক্ষা করছে তাঁর জন্য?
বেহালার রাজকীয় বাঁ হাতি, লর্ডসে স্বপ্নের টেস্ট অভিষেক, ভারত অধিনায়ক হিসেবে রূপকথার উত্থান, অধুনা দেশের ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট। এ বার কি দাদাকে দেখা যাবে আইসিসি প্রধান হিসেবে?
বার্মিংহামে চলতে থাকা আইসিসি মহাবৈঠকের যা গতিপ্রকৃতি, তাতে এমন সম্ভাবনা মোটেও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। বরং সব কিছু ঠিকঠাক চললে, অ্যাডভ্যান্টেজ সৌরভ। বাংলা থেকে জগমোহন ডালমিয়ার পরে দ্বিতীয় ক্রিকেট প্রশাসক হিসেবে সর্বোচ্চ মসনদে বসার দৌড়ে তিনি ভাল মতোই ঢুকে পড়েছেন। ভারতীয় প্রশাসকদের ধরলে, এখনও পর্যন্ত তিন জন আইসিসি প্রধান হয়েছেন। জগমোহন ডালমিয়া, শরদ পওয়ার এবং শশাঙ্ক মনোহর।
১৩ নভেম্বর মেলবোর্নে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল। মাঠে ঠিক হবে নতুন চ্যাম্পিয়ন। আর মাঠের বাইরে আইসিসি শীর্ষ বৈঠকে সে দিনই ঠিক হয়ে যাবে পরবর্তী চেয়ারম্যানের নাম। মনে করিয়ে দেওয়া যাক, মেলবোর্ন মানে সৌরভের শততম টেস্টের মাহেন্দ্রক্ষণের কেন্দ্র!
নীরজ চোপড়ারা আর কয়েক দিন পরে যেখানে কমওয়েলথ গেমসের জন্য নামছেন, সেই বার্মিংহামে আইসিসি মহাবৈঠক শুরু হয়েছে শনিবার থেকে। আলোচ্য সূচিতে অনেক কিছুই আছে। যেমন আইপিএলের বর্ধিত সময়ের জন্য দরবার করবেন ভারতীয় বোর্ডের কর্তারা। ২০২৪ থেকে ২০৩২, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সূচি তৈরি হবে। ২০২৩ থেকে ২০২৭-এর মধ্যে মেয়েদের চারটি বিশ্বকাপ কোথায় হবে, তা নিয়েআলোচনা হবে।
কিন্তু বড় আকর্ষণ, পরবর্তী আইসিসি চেয়ারম্যান কে হতে যাচ্ছেন? নভেম্বরে মেলবোর্নে নির্বাচন হলেও রূপরেখা হয়ে থাকবে বার্মিংহামেই। নিউজ়িল্যান্ডের গ্রেগ বার্কলে এখন আইসিসি চেয়ারম্যান। তাঁর মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে এ বছরেই। আইসিসি-র প্রভাবশালী কর্তারা চাইছেন, চেয়ারম্যান হিসেবে এ বার আসুন সৌরভ। দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রেম স্মিথের সঙ্গে যেমন তাঁর খুব ভাল সম্পর্ক। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া যে বরাবর ভারত বা উপমহাদেশের বিরুদ্ধে হেঁটেছে, তারাও সৌরভ-বিরোধী নয়। এমনকি সীমান্তের কাঁটাতার, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের তিক্ততা ভুলে পাকিস্তান বোর্ডের মনোভাবও সৌরভের ব্যাপারে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ। রামিজ় রাজার সঙ্গে যথেষ্ট ভাল সম্পর্ক ভারতীয় বোর্ড প্রধানের। শেষ আইপিএলের সময়েও রামিজ়কে ব্যক্তিগত ভাবে ফোন করে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন সৌরভ। আসতে না পারলেও সেই উষ্ণতার জবাবে শুভেচ্ছা জানাতে ভোলেননি প্রাক্তন পাক অধিনায়ক। বিরাট কোহলির পাশে বাবর আজ়মের দাঁড়ানো নিয়ে হইচইয়ের মধ্যে অলক্ষ্যেই চলে দুই দেশের দুই বোর্ড প্রধানের বন্ধুত্ব। যাঁরা ক্রিকেট জীবনে নিজেদের দেশের অধিনায়কও ছিলেন।
শুধু তা-ই নয়, অ্যাসোসিয়েট দেশ থেকে হওয়া আইসিসির তিন জন নতুন ডিরেক্টরও সৌরভের পক্ষে রয়েছেন। নবনির্বাচিত এই তিন ডিরেক্টর হচ্ছেন সিঙ্গাপুরের ইমরান খোয়াজা (আইসিসিতে খুবই অভিজ্ঞ এবং পুরনো কর্তা, গত বার চেয়ারম্যান পদেও লড়েছিলেন), নীল স্পাইট এবং পঙ্কজ খিমজি। ওমান ক্রিকেট সংস্থার প্রধান খিমজি আবার এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলেরও ভাইস প্রেসিডেন্ট। আইসিসি সূত্রের খবর, রবিবার পরবর্তী চেয়ারম্যান নিয়ে আলোচনার সময় গরিষ্ঠ সংখ্যক ডিরেক্টরেরা সৌরভের প্রতি সমর্থন দেখান। তাতেই আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে সৌরভের সম্ভাবনা। সব মিলিয়ে বার্মিংহাম সরগরম দাদাকে নিয়ে।
আইসিসি চেয়ারম্যান নির্বাচনের প্রক্রিয়াকেও এ বারে আরও সহজ, সরল করে দিতে চাইছে আইসিসি। গত বার নিউজ়িল্যান্ডের বার্কলে যখন চেয়ারম্যান হন, দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতা দরকার ছিল। আইসিসি বোর্ড ১৬ সদস্যের। অর্থাৎ, চেয়ারম্যান হতে বার্কলের দরকার পড়েছিল ১১ ভোটের। শোনা যাচ্ছে, নতুন নিয়মে আইসিসি চাইছে, ৫১ শতাংশ ভোট পেলেই তিনি নির্বাচিত হবেন। অর্থাৎ, সৌরভকে যদি ভোটাভুটিতে যেতেও হয়, তা হলে ১৬ সদস্যের বোর্ডের মধ্যে ৯ জন ডিরেক্টরের সমর্থন পেলেই তিনি চেয়ারম্যান হয়ে যাবেন। নির্বাচনী প্রক্রিয়া ব্যালট-যুদ্ধ পর্যন্ত গড়ালে কিন্তু এই যে অ্যাসোসিয়েট দেশের প্রতিনিধি হিসেবে আসা ডিরেক্টরেরা তাঁর পক্ষে রয়েছেন, তা টি-টোয়েন্টির ভাষায় ‘গেমচেঞ্জার’ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
যদিও প্রভাবশালী আইসিসি কর্তাদের অন্তত প্রাথমিক ভাবে যা মনোভাব, নির্বাচন এড়িয়ে সর্বসম্মত ‘অধিনায়ক’-এর মুকুট মাথায় উঠলেও অবাক হওয়ার থাকবে না। তবে গত কয়েক বছরে প্রশাসক হিসেবে অভিজ্ঞ হয়ে ওঠা তিনি, সৌরভও নিশ্চয়ই বুঝে গিয়েছেন, আইসিসি বৈঠক মানে সবুজ পিচে ওয়াসিম আক্রমের মতোই রহস্যময়। কোন বলটা ভিতরে আসবে, কোনটা বাইরে যাবে, সারাজীবন যা ব্যাটসম্যানদের কাছেদুর্বোধ্যই থেকে গেল!
আইসিসি যদি আক্রমের রিভার্স সুইং হয়, নিজের দেশের বোর্ড মানে ডারবানের পিচ। অ্যালান ডোনাল্ডদের বাউন্সের ছোবলের জন্য তৈরি থাকো। সৌরভের নতুন ইনিংসের ভাগ্য এখন অনেকটাই দাঁড়িয়ে তাঁর নিজের বোর্ডের সিদ্ধান্তের উপরে। জয় শাহ-রা আইসিসি উৎসাহে সাড়া দিয়ে ভারতীয় বোর্ড থেকে তাঁর নাম প্রস্তাব করবেন? নাকি এর মধ্যে আবার লুকিয়ে রয়েছে অন্য নাটক? নিজের ড্রেসিংরুমে আবার অযাচিত ভাবে উদয় হবেন না তো কোনও গ্রেগ চ্যাপেল?
বোর্ড প্রশাসনের রাজনীতি নিয়ে চর্চা যেমন রয়েছে, তেমনই কারও কারও মত, এত বড় সুযোগ হাতছাড়া করার বোকামিও হয়তো করতে চাইবে না বোর্ড। কয়েক দিন পরেই সুপ্রিম কোর্টে সৌরভ-জয় শাহদের বোর্ডের গদির ভবিষ্যৎ নিয়ে শুনানি রয়েছে। সেখানে সর্বোচ্চ আদালত সৌরভ-জয়কে মসনদে থেকে যাওয়ার ছাড়পত্র দেয় কি না, তা দেখার অপেক্ষায় ক্রিকেট মহল। তার আগে জনপ্রিয় পূর্বাভাস হচ্ছে, যদি সুপ্রিম কোর্ট থাকার অনুমতি দেয়, তা হলে সৌরভ চলে যেতে পারেন আইসিসি-তে। জয় তাঁর জায়গা নিয়ে হতে পারেন পরবর্তী বোর্ড প্রেসিডেন্ট। ভারতীয় বোর্ড থেকে সৌরভই যে আইসিসি-তে যাওয়ার জন্য সেরা বাজি, তা নিয়ে আপাত ভাবে সংশয় থাকার কথা নয়। তবু ভারতীয় বোর্ড এবং তার রাজনীতির ইতিহাস। কে গ্যারান্টি কার্ডে সই করবে! ডারবানের মতোই যখন-তখন বল লাফাতে পারে যে!
কারও কারও মত, সুপ্রিম কোর্ট কী রায় দেয়, তার উপরেও নির্ভর করতে পারে বোর্ডের আইসিসি-সমীকরণ। সর্বোচ্চ আদালতের রায় দেখে নিয়ে প্রভাবশালী কর্তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, কে যাবেন আইসিসি-তে বোর্ডের মুখ হয়ে। আপাতত সৌরভ অবশ্যই এগিয়ে গেলেন আইসিসি অন্দরমহলে ‘অ্যাওয়ে’ ম্যাচ জিতে। এ বার তাঁর পরীক্ষা ‘হোম গ্রাউন্ড’ অর্থাৎ ঘরের মাঠে, নিজের বোর্ডের মধ্যে।
এর পরে দুরন্ত স্টেপ-আউটে স্পিনারকে টপাটপ গ্যালারিতে ফেলার মতো যদি তিনি ‘হোম ম্যাচ’-টাও জিতে নিতে পারেন? লর্ডসে জামা খুলে ওড়ানোর দৃশ্য না ফিরে আসে সৌরভ-ভক্তদের মনে। সেই লর্ডস, যেখান থেকে এক সময় অঙ্গুলি হেলনে আইসিসি শাসন করত ইংরেজ কর্তারা!