ইনিংসে ১০ উইকেট নেওয়ার কীর্তি অজাজ় উৎসর্গ করতে চান তাঁর পরিবারকেই। ফাইল চিত্র।
ক্রিকেটার হওয়ার জন্য তাঁকে কম রাস্তা পার হতে হয়নি। আর সেই যাত্রাপথে অনেককেই পাশে পেয়েছেন অজাজ় পটেল। কিন্তু আলাদা করে বলতে চান তাঁর বাবা-মা-স্ত্রীর কথা। বলতে চান, ক্রিকেটার হয়ে ওঠার নেপথ্যে তাঁর পরিবারের আাত্মত্যাগের কথা। যে কারণে ইনিংসে ১০ উইকেট নেওয়ার কীর্তি অজাজ় উৎসর্গ করতে চান তাঁর পরিবারকেই।
নিউজ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে ভারতের টেস্ট সিরিজ় জয়ের চেয়েও আলোচনায় গত কয়েক দিন ধরে উঠে আসছে অজাজ়ের এক ইনিংসে ১০ উইকেট নেওয়ার কীর্তি। দেশে ফিরে যাওয়ার আগে ভারতীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে ভিডিয়ো কলে মঙ্গলবার সকালে মুখোমুখি হন এই বাঁ-হাতি স্পিনার। যেখানে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, এই ঐতিহাসিক কীর্তি আপনি কাকে উৎসর্গ করতে চান? ভারতীয় বংশোদ্ভূত স্পিনারের জবাব, ‘‘আমি যে আজ এই জায়গায় পৌঁছতে পেরেছি, তার জন্য অনেক মানুষকেই ধন্যবাদ দিতে হবে। তবে আলাদা করে আমার বাবা-মা, স্ত্রী, এঁদের কথা বলতেই হবে। আমার জন্য অনেক আত্মত্যাগ করেছে পরিবার। আমার ছোট্ট একটা মেয়ে আছে। সে-ও আমার সঙ্গে সময় কাটাতে পারছে না।’’ তা হলে কি পরিবারকেই উৎসর্গ করতে চান আপনার এই কীর্তি? ‘‘নিশ্চয়ই, একশোবার,’’ বলে উঠলেন ৩৩ বছর বয়সি এই ক্রিকেটার।
ক্রিকেট ইতিহাসে জায়গা করে নিলেও অজাজ় তাঁর জীবন যাত্রায় বিশেষ কোনও বদল দেখছেন না। বলছিলেন, ‘‘মুম্বইয়ে থাকলে হয়তো আমার জীবনটা একটু বদলে যেত। লোকের নজরে আসতাম। কিন্তু নিউজ়িল্যান্ডে ও রকম কিছু হবে বলে মনে হয় না। আমি বাসে চাপতে পারি। সাধারণ কাজগুলো দ্বিধাহীন ভাবে করতে পারি। কীর্তির কথা জানলেও ওখানে কেউ ঘিরে ধরবে না।।’’
ইতিহাস রচিত হলেও স্পনসরদের লাইন বা অর্থবৃষ্টি, কিছুই এখনও আসেনি তাঁর জীবনে। অজাজ়ের কথায়, ‘‘বদল বলতে এখন আমাকে বেশি লোকে চেনে। কেউ কেউ এসে ছবি তুলতে বা সই
নিতে চাইছে। এর চেয়ে বেশি কিছু হয়নি। আমিও মাটিতে পা রেখে চলতে চাই। লক্ষ্য আছে নিউজ়িল্যান্ডের হয়ে ৮০-৯০টা টেস্ট খেলা।’’
আধুনিক ক্রিকেট বিশ্বে বর্ণবিদ্বেষ শব্দটা রীতিমতো ঝড় তুলেছে। ইংল্যান্ডে তো তোলপাড় ফেলে দিয়েছে। মুম্বই থেকে যাওয়ার ফলে এবং মুসলিম ক্রিকেটার হওয়ায় নিউজ়িল্যান্ডে কি আপনাকে কোনও সমস্যায় পড়তে হয়েছে? অজাজ় বলছেন, ‘‘আমি জানি বর্ণবিদ্বেষ কতটা ছায়া ফেলে সব জায়গায়। তবে আমার কোনও খারাপ অভিজ্ঞতা নেই। বরং নিউজ়িল্যান্ড দল সব সময় আমার সংস্কৃতিকে সম্মান করে এসেছে।’’ তিনি এ-ও জানিয়েছেন, ২০১৮ সালে জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার পরে সবার সমর্থন কী ভাবে পেয়েছিলেন। ‘‘মসজিদে যাওয়ার সময় আমার সঙ্গে কেউ না কেউ থাকত। আবার ড্রেসিংরুমেও আমাকে আলাদা জায়গা দেওয়া হত, যাতে আমি ঠিকমতো প্রার্থনা করতে পারি,’’ বলেছেন অজাজ়। তবে এটা জানাতে ভুলছেন না, ‘‘ক্লাব ক্রিকেটে দু’একটা খারাপ অভিজ্ঞতা হয়নি, তা নয়। কিন্তু সার্বিক ভাবে সমস্যা হয়নি। তবে এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা।’’
২০১৯ সালে ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে সন্ত্রাসবাদী হামলার সময় মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ হিসেবে আপনাদের কী অভিজ্ঞতা হয়েছিল? অকল্যান্ডের বাসিন্দা অজাজ়ের জবাব, ‘‘আমরা সবাই খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল। কিন্তু নিউজ়িল্যান্ড সরকার এবং স্থানীয় মানুষজন সব সামলে দিয়েছিল।’’
একটি ঘটনার কথাও বলেছেন অজাজ়। ওই সময় পটেল পরিবারের নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছিল। প্রতিবেশীরা সেখানে বোরখা পরা অবস্থায় অজাজ়ের মাকে বেশ কয়েক বার যেতে দেখেছিলেন। ‘‘প্রতিবেশীরা বুঝেছিলেন আমরা মুসলিম। তার পরে তাঁরা আমাদের বাড়ির সামনে একটা ফুলের টব আর একটা কার্ড রেখে যান। যেখানে লেখা ছিল— আমরা আপনাদের পাশেই আছি। আপনারা আমাদের সম্প্রদায়েরই অংশ,’’ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কিছুটা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন অজাজ়।
মাস দুয়েক আগে ভারতে যখন পা রেখেছিলেন তিনি, ক’জন তাঁর নামটা জানতেন, সন্দেহ। এখন যখন দেশে ফিরে যাচ্ছেন, ক্রিকেট আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে ফুটে উঠেছেন। কিন্তু মানুষ হিসেবে একই রকম আছেন অজাজ় ইউনুস পটেল।