নিরাপত্তারক্ষীরা যখন ভক্ত। চণ্ডীগড় বিমানবন্দরে বিরাট কোহালিকে দেখা মাত্র প্রথমে ঘিরে ধরেছিলেন ক্রিকেট-ভক্তেরা। কিন্তু নিরাপত্তারক্ষীরা তাঁদের সরিয়ে নিজেরাই ব্যস্ত হয়ে পড়েন কোহালির সঙ্গে ছবি তুলতে। সোমবার। ছবি: গৌতম ভট্টাচার্য
গত দু’বছর ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে বেশি সংস্কারসাধনকারী দুই ব্যক্তি দুপুর-দুপুর মুখোমুখি!
একজন আদালতকক্ষের সাহায্য নিয়ে করেছেন মাঠের বাইরের একাধিক সংস্কার। প্রবল চাপের কাছেও মাথা না নুইয়ে নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসনকে বার করে দিয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেটের চৌহদ্দি থেকে।
অন্য জন বাইশ গজে টিম ইন্ডিয়ার সংস্কার করেই যাচ্ছেন অপর্যাপ্ত ভাবে।
প্রথম জন—কট্টর ক্রিকেটপ্রেমী হিসেবে পরিচিত বিচারপতি মুকুল মুদগল। মুদগল নিজে এগিয়ে এলেন দ্বিতীয় লোকটির দিকে। যাঁকে নিয়ে ক্রিকেট সৌরজগত এ মূহূর্তে আবর্তিত। কোনও এক বিরাট কোহালি!
দুপুরে চণ্ডীগড়ের নতুন এয়ারপোর্ট টার্মিনালে তাঁদের ঘিরে তখন গোটা ভারতীয় দল। কোহালি বসে আছেন ধোনির ঠিক পাশে। পারস্পরিক শরীরী ভাষা কাল ৩১ বলে ৫৯ তোলার মতোই বন্ধুত্বপূর্ণ। দেখে মনে পড়ে যাচ্ছে তিরাশির ফাইনাল জেতার পর লর্ডসে সুনীল-কপিল ব্যালকনিতে একত্রিত হওয়ার ফ্রেম। ব্যর্থতা যেমন সুখী টিম ভেঙে দু’টুকরো করে দিতে পারে। বড় সাফল্য তেমনই টিমের মধ্যে দেশভাগ ঘুচিয়ে দেয়।
যাই হোক, মুদগলের অতশত মনে রাখার দায় নেই। তিনি ধোনিকে অভিনন্দন জানিয়ে বিরাটের সঙ্গে হাত মেলালেন। ‘‘কী খেলেছ! জাস্ট মায়াবী!’’ বিচারপতি তো বটেই আইনব্যবসার সঙ্গে জড়িত লোকেরা সাধারণত মেপেজুকে কথা বলেন। তিনি মুদগল, এ মুহূর্তে আইনের নয় ক্রিকেটের আলখাল্লা পরে আছেন। এবিপিকে সটান বলে দিলেন, ‘‘এই ইনিংস সচিন কিছুতেই খেলতে পারত না। দু’জনের রান তাড়ার ম্যাচগুলোয় রেকর্ড পাশাপাশি রাখুন! তা হলে আমাকে প্রশ্নটাই করার দরকার হবে না।’’
আধুনিক ক্রিকেট বিশ্বের মহাতারার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে তখন অবশ্য মনে হচ্ছে সচিনের সঙ্গে কী আশ্চর্য মিল! সাফল্যকে নেওয়ার ভঙ্গিতে!
তেরো বছর আগে সেঞ্চুরিয়নের মন মাতাল করে দেওয়া ৯৮-এর পরের দুপুরে সচিনের হোটেল রুমে ঢুকতে গিয়ে দেখেছিলাম, অন্ধকার ঘরে একা বসা। জানতেনও না গোটা ভারতে তাঁর পাকিস্তান বধ ঘিরে যে অকাল-দিওয়ালি পালিত হচ্ছিল।
কোহালিও তো এবিপি-র কাছে জানলেন অস্ট্রেলিয়া বধের পর যে হোলি-দিওয়ালি একাকার হয়ে গিয়েছে। জয়পুর, নাগপুর, আমদাবাদে লোকে কাল মাঝরাত্তিরে শোভাযাত্রা করে যে কী ভাবে আনন্দ করেছে। গোটা দেশ এমন বিভোর যেন বিশ্বকাপ জিতেছে। পাশ থেকে ধোনি বললেন, ‘‘তাই বুঝি? কিছুই জানি না। এত টায়ার্ড ছিলাম ফিরে আর টিভি দেখা হয়নি।’’ কোহালি তখন হেসেই চলেছেন। মূর্তিমান প্রশান্তির হাসি যে, অপারেশন সর্বাঙ্গসুন্দর হয়েছে!
মুম্বইয়ের চার্টার্ড ফ্লাইটে ওঠার জন্য টিম তখন অপেক্ষমান। কিন্তু এয়ারপোর্টের এমন অবস্থা যে মনে হচ্ছে খোলা ময়দানের বটতলায় ইন্ডিয়ান টিমকে নিয়ে আসা হয়েছে। একটা ক্রিকেট টিমকে— সরি ক্রিকেট টিমের কোনও ব্যক্তিকে ঘিরে যাত্রীদের এই পর্যায়ের মাতামাতি কল্পনাতীত। সচিনকে নিয়েও অন্তত এয়ারপোর্টের নিরাপদ বৃত্তে এ জিনিস হয়েছে কি না মনে করতে পারলাম না। পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে একপ্রস্থ ঘোষণা এবং তাতেও কাজ না হওয়ায় পুলিশ ডেকে যাত্রীদের হঠাতে হল। টিমকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল কাচে ঘেরা লাউঞ্জে যেখানে ওই দিল্লিগামী চার্টার্ড ফ্লাইটের বোর্ডিং কার্ড না থাকলে কেউ ঢুকতেই পারবেন না।
এ বার সেখানে পুলিশেরা কোহালিকে নিয়ে এসে নিজেরাই ছবি তুলতে শুরু করে দিল। ভারতীয় দলের ম্যানেজার তাদের বেশ দাবড়েই দিলেন, ‘‘বাহ রে, আপনারা সান্ত্রী। আপনারা অন্যদের যে কারণে বার করলেন নিজেরাই সেটা করছেন?’’ তখন সত্যিই মনে হচ্ছে বাকিরা নিমিত্ত মাত্র। বিরাট-রাজ তাঁর চোদ্দো জন অনুগামীকে নিয়ে মুম্বই যাত্রা করছেন।
তখনও আঁচ পাওয়ার উপায় নেই যে, এই হাসিমুখের কোহালির মধ্যে প্রাক্তন প্রেমিকাকে নিয়ে গণপ্রতিক্রিয়ায় লাভাস্রোত বইছে। মুম্বই নেমে টুইটও করলেন, ‘লজ্জা, লজ্জা। অনুষ্কাকে উত্যক্ত করা বন্ধ করুন। ও আমার জীবনে অনেক মোটিভেশনের পিছনে।’ অনুষ্কা— তিনি কোথায়? কী ভাবছেন? জানার উপায় নেই। এবিপি-র মুম্বই নিবাসী ফিল্ম প্রতিনিধি জানালেন, অনুষ্কা নাকি রাজস্থানে শ্যুটিং করছেন। এ মুহূর্তে বিরাট প্রসঙ্গ এতই স্পর্শকাতর এবং নমনীয় যে তিনি দূরে থাক, তাঁর কাছের লোকেরাও মুখ খুলতে চান না।
বিরাট-রাজ মানুষ হিসেবে এতই প্রাইভেট যে, ব্যক্তিগত উথালপাথালের খবর হাতে গোণা কিছু মানুষ ছাড়া হদিশ পাওয়া সম্ভবই নয়। কিন্তু বেদনা যদি কিছু থেকেও থাকে তাঁর পেশাদারি জীবনের পূর্ণিমা এসে তাকে ঢেকে দেওয়া উচিত।
যে কোনও ভারতীয় ক্রিকেটার সবচেয়ে বেশি কী চায়? অবশ্যই তার অস্ট্রেলিয়ান প্রতিদ্বন্দ্বী বা বড় কোনও অজি ক্রিকেটারের তারিফ।
সেটাও তো হাতের কাছে মজুত। কলকাতায় স্টিভ ওয়-র পর এ বার চণ্ডীগড়ে মার্ক ওয়! অস্ট্রেলীয় নির্বাচক মার্ক জানালেন, এত তাড়াতাড়ি ভারত ছাড়তে হবে ভাবেননি। কিন্তু টিম যেহেতু ফিরে যাচ্ছে তিনি সিলেক্টর থাকেন কোন যুক্তিতে? মার্ক রেখেঢেকে কথা বলেন না, ‘‘মাঠে বসে ভাবতেই পারিনি ম্যাচটা হারব। কোয়ার্টার ফাইনালে ১৬০ অনেক রান। কিন্তু এই ছেলেটা অন্য গ্রহের ক্রিকেট খেলে। ভেরি স্পেশ্যাল। আমি বলে দিলাম ভারতই চ্যাম্পিয়ন।’’ মার্ক এগিয়ে গেলেন ডিপার্চার গেটের দিকে। মনে হল প্রশংসার আর কী মণিহার উপুড় করতে পারতেন আধুনিক ভারতীয় তারকার জন্য? অস্ট্রেলিয়ানরা ঐতিহাসিক ভাবে এত সশ্রদ্ধ তো একজন ভারতীয়র জন্যই হয়েছে!
ভারতের মেয়েদের দলটাকে পাওয়া গেল হাতের কাছে। এবং অবশ্যই ঝুলন গোস্বামীকে। একই চার্টার্ড ফ্লাইটে তাঁরাও দিল্লি যাচ্ছেন। সেমিফাইনালে না যেতে পারার যন্ত্রণায় দিশেহারা ঝুলন। কিন্তু তারই মধ্যে সামান্য সন্তুষ্টি। ক্রিকেটের অমোঘ শাস্ত্রশিক্ষা করে ফিরেছেন মোহালি মাঠ থেকে। ‘‘শিখলাম আড়া-তেড়া না মেরেও যে টি-টোয়েন্টিতে একই রকম সফল হওয়া যায়। শিখলাম, কী করে বড় ব্যাটসম্যান গ্যাপ খোঁজে। কী অসামান্য হতে পারে তার ব্যাট স্পিড।’’
শোয়েব আখতার একটু দূরে সিকিউরিটি চেক করাচ্ছেন। চোখাচোখি হতে বললেন, ‘‘এটা অন্যায়। রোজ একটা ছেলে জেতাবে হয় নাকি? তা হলে যে দিন ও রান পাবে না সে দিন আপনাদের টিম দাঁড়িয়ে যাবে?’’ শোয়েবের পাশে ব্রেট লি। যিনি মুম্বই নেমে বলছিলেন, ‘‘কালকের ইনিংসটা যে মাঠে বসে দেখার সুযোগ পেয়েছি তাতেই নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি।’’
সোমবার বিভিন্ন মহলে কথা বলে মনে হল মহাকাব্যিক হয়ে গিয়েছে সতেরো, আঠারো এবং উনিশ ওভারে কোহালির গিয়ার বদলানোটা। বিশেষ করে ফকনারকে তিনি যে ভাবে মেরেছেন তার তুলনা হচ্ছে সেঞ্চুরিয়নে শোয়েব-নিগ্রহর সঙ্গে! ভারতীয় দলে একজন বললেন, ‘‘আপনারা শুধু বাইশ গজে বিরাটের ঔজ্জ্বল্য দেখেন। ওর গ্রিন রুমটা খেয়াল করেন না যে, জিমে কতক্ষণ কাটায়। খাবারের ব্যাপারে কী অসম্ভব সতর্ক। গ্রিলড খাবার ছাড়া মুখেই দেয় না। সবাই ওর চার-ছয়ের কথা লিখছে। কাল চার বার ও আর ধোনি দু’রান করে নিয়েছে দেখেছেন। ওটা এক না হয়ে দুই হয়েছে স্রেফ ফিটনেসের জোরে। আসলে এটায় মাথায় রাখবেন যে ও মাঠের বাইরেও ক্রিকেট খেলে।’’
যুবরাজ সিংহ এর মধ্যে পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে আবির্ভূত। এত হাসি-গান-হইহল্লার মধ্যে একমাত্র বিয়োগান্ত দিক। বিদেশি ফিজিওকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলেন যুবরাজ। দু’দিন বাকি। বললেন, ‘‘চেষ্টা করব।’’ তবু মুম্বই সেমিফাইনালে তাঁকে ঘোর অনিশ্চিত দেখাচ্ছে। তাতে যুবির ব্যক্তিগত মেজাজ মেঘলা থাকলেও টিমের বিশেষ যায়-আসে না। বিরাট-রাজের দরবারে তিনিই যে এক এবং অদ্বিতীয়!
ব্যাটিং কোচ সঞ্জয় বাঙ্গার বহু দিনের অকৃত্রিম নেতাজি ভক্ত। কলকাতা সাংবাদিকের কাছে খোঁজ করলেন সুগত বসুর লেখা ‘হিজ ম্যাজেস্টিজ এনিমি’-তে নেতাজি অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে নতুন কোনও আলোকপাত আছে কি না? বাঙ্গারের ধারণা। সরি ধারণা নয়, স্থির বিশ্বাস— তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়নি। তিনি বহু বছর লুকিয়ে ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নে। সেটা লালবাহাদুর শাস্ত্রী জানতেও পারেন। শাস্ত্রী বলেওছিলেন একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা তিনি আজ করবেন। কিন্তু সে দিনই তিনি মারা যান। এ সব বলতে বলতে বাঙ্গার যোগ করলেন, কালকের ইনিংসটা ঘোরের মতো।
তাঁকে পাশ থেকে কেউ ফুট কাটল। কোনটা বেশি ঘোর এনে দেওয়ার মতো? কালকের ইনিংসটা? নাকি নেতাজি সম্পর্কে যদি চমকপ্রদ কোনও নতুন ঘোষণা শোনো? বাঙ্গার হাসলেন। কিছু বললেন না।
মুম্বইয়ে নেমেও দেখা গেল অবস্থার কোনও পরিবর্তন নেই। এফএমে সেই বিরাট-রাজের একচ্ছত্র গুণকীর্তনই চলছে। তিনি যে দরবার নিয়ে শেষমেশ আরব সাগরের ধারে এসে পড়লেন। মুম্বইও আগামী তিন দিন তাঁর নতুন রাজ্যপাট হওয়ার জন্য যেন সাগ্রহে তৈরি!