সম্মান: সমাপ্তি অনুষ্ঠানে ভারতের পতাকা হাতে সৃজেশ এবং মনু ভাকের। রবিবার প্যারিসে। ছবি: রয়টার্স।
আইফেল টাওয়ার। স্যেন নদী। নেপোলিয়ন বোনাপার্ত শুয়ে আছেন তাঁর কবরে। ভার্সাইয়ের রাজপ্রাসাদ, যেখানে খুঁজলে হয়তো এখনও পাওয়া যাবে ফরাসি বিপ্লবের রক্তের দাগ। প্লাস দে লা কনকর্ড, যেখানে এক সময় গিলোটিন হত, দু’টি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাম হল রাজা ষোড়শ লুই ও রানি আঁতোয়ানেৎ। যাঁদের গিলোটিন এখানে হয়েছিল। ফরাসি বিপ্লবের সময় তাঁরাই ছিলেন রাজা-রানি। খিদের তাড়নায় ফ্রান্সের মানুষ যখন শাসকদের কাছে রুটি চাইছে, তখন রানি আঁতোয়ানেতের সেই উক্তি চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে, ‘‘ওরা রুটি পাচ্ছে না তো কী, কেক খেতে পারে না!’’
১৬ দিনের এক অলিম্পিক গেমস অভিনবত্ব এবং ইতিহাসের ছোঁয়ায় যা শুধু নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে বললে কিছুই বলা হবে না। বলা উচিত, দ্বিতীয় ফরাসি বিপ্লব ঘটে গেল। শুরু হয়েছিল স্যেন নদীতে ঝলমলে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দিয়ে। এই প্রথম অলিম্পিক্সের কোনও উদ্বোধনী অনুষ্ঠান স্টেডিয়ামের বাইরে খোলা আকাশের নীচে হল। খেলাধুলো উদ্বোধনের একটা আলাদা নকশাই যেন সে দিন দিয়ে গিয়েছিল প্যারিস। রবিবার স্তাদ দ্য ফ্রান্সে হল সমাপ্তি অনুষ্ঠান। ১৬ দিনের এমন মহাযজ্ঞ খেলাধুলোর ইতিহাসে আর কখনও দেখা গিয়েছে কি না সন্দেহ। যেমন পরিকল্পনা, তেমনই ইতিহাসের ছোঁয়া। তেমনই আতঙ্ক, হুমকিকে উড়িয়ে দিয়ে ভয়ডরহীন ভাবে জীবনকে উপভোগ করার মন্ত্র
উপহার দেওয়া।
এমন সব দুর্ধর্ষ অলিম্পিক্সের কেন্দ্র আর কোনও দেশে দেখা যাবে? আইফেল টাওয়ারের নীচে বিচ ভলিবল। গেমসের সময় যার নামই হয়ে গিয়েছিল ইনস্টাগ্রাম ভেনু। রাতারাতি বালি দিয়ে নকল বিচ তৈরি করা হয়েছিল। ডিজ়ে জোরে মিউজ়িক বাজিয়ে দিচ্ছেন। রাতে খোলা আকাশ ও আইফেল টাওয়ারের নীচে সবাই তার সঙ্গে তালে তালে নাচছেন আর বিচ ভলিবল উপভোগ করছেন। সবচেয়ে বেশি মূল্যের টিকিটও এই বিচ ভলিবলের। একটি সিটও কোনও দিন খালি পড়ে থাকেনি। সেখানে এক রাতে গিয়ে মনে হচ্ছিল, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ঠিক লিখে গিয়েছিলেন, প্যারিস এক চলমান মহোৎসবের নাম। ১৬ দিনের অলিম্পিক্স নয়, এক চলমান মহোৎসব দেখা গেল।
আইফেল টাওয়ার যদি ভালবাসার মিনার হয়, তা হলে প্লাস দেলা কনর্কডে কোথাও যেন চাপা পড়ে আছে মৃতের আর্তনাদ। গিলোটিনের চিহ্ন বহন করা সেই জায়গাতেই হচ্ছিল স্কেটবোর্ডিং। প্রত্যেক দিন ৩৭ থেকে ৪০ হাজার দর্শক ভিড় করতেন। গ্রাঁ প্যালেস, যেখানকার কাচের ছাদ পৃথিবী বিখ্যাত। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোক ছুটে আসে দেখতে। সেখানেই হচ্ছিল ফেন্সিং। মমার্ত, যেখানে ফরাসি কবি, সাহিত্যক, শিল্পীদের ইতিহাস ও চিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, সেখান থেকে সাইক্লিস্টরা যখন যাচ্ছিলেন, ভেঙে পড়ছিল জনতার ভিড়। বিখ্যাত শিল্পী ক্লোদ মোনের একটি বিখ্যাত ছবি রয়েছে এই জায়গাটা নিয়ে। প্যারিস অলিম্পিক্সে সাইক্লিং চলার সময়, একটি বহুতল বাড়ির উপরে উঠে এক ফটোগ্রাফার সরু রাস্তার মধ্যে দিয়ে সাইক্লিস্টদের যাওয়ার ছবি তোলেন। যার সঙ্গে ক্লোদ মোনের আঁকা ছবির তুলনা করা হচ্ছিল। একেকটা ইভেন্টের একটা কেন্দ্র যেন এক একটা পোস্টকার্ড। মাঝে মধ্যে মনে হচ্ছিল, অলিম্পিক্সে ভিক্তর ইউগোর ছবির প্রদর্শনী হচ্ছে।
সাইক্লিস্টরা লুভ্র মিউজিয়ামের পাশ দিয়ে গেলেন। যেখানে মোনালিসা রয়েছেন। সেখানে পল গঁগ্যা, পিয়ের অগস্ত রেনোয়া (ফরাসিরা বলেন হ্রেনোয়া), কামিল পিসারো, স্পেনের পাবলো পিকাসো, ভ্যান গঘ, পল সিজ়ান, লিয়োনার্দো দা ভিঞ্চি, ক্লোদ মোনে-সহ বিখ্যাত ফরাসি শিল্পীদের ছবি রয়েছে। এক দিনে হয় না, তিন-চার দিন লেগে যায় সব ছবি দেখতে ও বুঝতে।
মমার্তে দাঁড়িয়ে গেমস দেখতে দেখতে মনে হবে সত্যিই ছবির দেশ। কবিতার দেশ। শনিবার রাতে আইফেল টাওয়ারের আশপাশের অঞ্চল দিয়ে দৌড়চ্ছিলেন ম্যারাথন প্রতিযোগীরা। রাত তখন কটা হবে? প্যারিসের সময়ে একটা-দেড়টা। রাস্তার দু’ধারে জনতা ভেঙে পড়েছিল ম্যারাথন প্রতিযোগীদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য। পুরুষ-মহিলা মিলিয়ে এত প্রতিযোগী দৌড়চ্ছেন, যাঁরা দাড়িয়ে দেখছেন অনেকেই তাঁদের চেনেন না। কিন্তু কী অসাধারণ খেলোয়াড়সুলভ মনোভাবের উদাহরণ! এই যে এত রাতে কষ্ট করে সবাই দৌড়চ্ছেন, তাঁদের আমরা দাঁড়িয়ে একটু উৎসাহ দিই। না হয় না-ই বা ঘুমোলাম একটা রাত। এই ভাবনাটাই তো সোনার পদক জেতার যোগ্য। এক জন রানার ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লেন। মনে হল, আর পারবেন না। রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে থাকা জনতা তখন ঠিক করল তাঁরা এই অবসন্ন শরীরটাকে টেনে তুলবেই। এমন হাততালি আর গো...গো...আওয়াজ উঠল, সেই হাঁটু মুড়ে বসে পড়া রানারও উঠে পড়লেন। তাঁর রক্ত আবার ফুটতে শুরু করেছে। তিনি দৌড়তে থাকলেন। তাঁর দৌড় দেখে যে ভাবে সকলে উৎসব করতে থাকলেন, তা এ বারের অলিম্পিক্সের নিজেদের দলের সোনা জেতার মুহূর্তকেও
হার মানাবে।
ইনভ্যালিডে হচ্ছিল তিরন্দাজি। যেখানে নেপোলিয়ন বোনাপার্ত কবরে শায়িত। যেখানে আশা জাগিয়েও সমাধিস্থ হয়েছিল ভারতের আরও একটি অলিম্পিক্স পদকের সম্ভাবনা। জায়গাটা স্যেন নদীর ঠিক তীরেই। সেখানেও মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে উৎসাহ দিচ্ছিলেন প্রতিযোগীদের। কে বলবে অলিম্পিক্সের খেলাধুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। জনতা কখনও তিরন্দাজি দেখতে ছুটছে। সেখান থেকে বেরিয়ে স্যেন নদীতে বিখ্যাতে ক্রুজ়ে করে ঘুরছে। এর মধ্যে খচখচানি থেকে যাচ্ছে, ভারত কি একটু ভাল করতে পারত না? বিনেশ ফোগতকে নিয়েও কোথাও একটা অস্বস্তির সুর। তাঁর এই ১০০ গ্রাম ওজন কমাতে না পারার দায় কার? বিনেশের ব্যক্তিগত কোচেদের? নাকি ভারতীয় দলের জন্য নিযুক্ত ডাক্তার দিনশ পারজিওয়ালার? এ বার কি পারস্পরিক দোষারোপের পালা শুরু হবে? প্যারিসের সমাপ্তি অনুষ্ঠানে যখন এক দিনে মনু ভাকের ও পি আর সৃজেশ পতাকা বহন করছেন, আর এক দিনে এই আশঙ্কা কিন্তু মাথা চাড়া দিচ্ছে।
ভার্সাইয়ের রাজপ্রাসাদের পাশে সেই বিখ্যাত বাগান। যেখানে নিঃশব্দে বসেছিল বিদ্রোহী প্রজারা। একই সঙ্গে রথ দেখা ও কলা বেচা সবই হচ্ছিল। ইতিহাসের সরণি বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখে নাও অলিম্পিক্স। সমাপ্তি রজনীতে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে, এই যে আবেগ আর কোনও দেশে নেই।
আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেসে হবে ২০২৮ অলিম্পিক্স। যেখানে ১৯৮৪ সালে অলিম্পিক্স হয়েছিল। পিটার উবেররথ অলিম্পিক্সে বাণিজ্যিকরণের দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন। উদ্যোক্তারা শনিবার সাংবাদিকদের সামনে বলেছেন, আইফেল টাওয়ার নেই। কিন্তু হলিউড আছে। জানিয়েছেন, গাড়িহীন গেমস করতে চান তাঁরা। সেটা কী ব্যাপার? গেমসের সময় রাস্তায় কোনও প্রাইভেট গাড়ি চলতে দেবে না। সবাইকে গণপরিবহণ ব্যবহার করতে হবে। রাস্তায় যাতে যানজট না হয়। সত্যি কি তা করা সম্ভব? নাকি প্যারিস এমন মাতিয়ে দিয়েছে, লস অ্যাঞ্জেলেস এখন খুঁজে বেড়াচ্ছে টেক্কা দেব কী করে?