সোমবার ভোরে দিল্লি থেকে একটা ফোন গিয়েছিল মার্কিন মুলুকের উইসকনসিনে। সেখানে তখন রাত। এ দেশ থেকে প্রশ্ন ছিল, ‘‘কী পার্টি হবে তো?’’ ও দেশ থেকে সদ্য পিজিএ চ্যাম্পিয়নশিপে পঞ্চম হওয়া তারকার উচ্ছ্বসিত উত্তর আসে, ‘‘আরে ভাইয়া, বিগ ওয়ান! বিগ ওয়ান!’’
অনির্বাণ লাহিড়ীকে সেই প্রতিশ্রুতি ভুলতে দিতে নারাজ তাঁকে নিয়ে মহোৎসবে মাতা ভারতীয় গল্ফ দুনিয়া।
সোমবার কলকাতার রাহিল গাঙ্গজি হোন বা দিল্লির দিগ্বিজয় সিংহ। ডেনমার্ক থেকে জীব মিলখা সিংহ হোন বা বিদেশ সফরের পথে থাকা গগনজিৎ ভুল্লার, প্রত্যেকের গলায় শোনা গেল একটাই কথা। ভারতের সঙ্গে এশিয়ার গল্ফকেও অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিচ্ছেন অনির্বাণ।
মরসুমের শেষ মেজরে অনির্বাণ শুরুটা করেছিলেন দারুণ ভাবে। তবে ছন্দে আছেন, সেটা বোঝা গিয়েছিল গত মঙ্গলবারই। যখন টুর্নামেন্টের আগে হুইসলিং স্ট্রেটসের কোর্সেই ‘লং ড্রাইভ’ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে চমকে দিয়েছিলেন। তার পর টুর্নামেন্টের চার রাউন্ডে তাঁর স্কোর যথাক্রমে ৭০, ৬৭, ৭০, ৬৮। মোট ১৩-আন্ডার ২৭৫। তৃতীয় শেষ দিন এক সময় তো অনির্বাণ যুগ্ম ভাবে তৃতীয় স্থানেও উঠে এসেছিলেন। সেটা ধরে রাখতে না পারলেও শেষ করলেন পঞ্চম স্থানে। মেজরের আসরে যা কোনও ভারতীয়ের আজ পর্যন্ত সেরা প্রদর্শন। শুধু তাই নয়, দ্বিতীয় রাউন্ডে তাঁর ৬৭ মেজরে কোনও ভারতীয়ের সেরা স্কোর। সব মিলিয়ে পর পর রেকর্ডের ঘনঘটা! ব্যক্তিগত ভাবে তাঁর নিজের কেরিয়ারের সেরা গল্ফ কীর্তি তো বটেই।
২০০৮-এ এই পিজিএ ট্যুরেই নবম হয়েছিলেন জীব মিলখা সিংহ। যিনি নিজের রেকর্ড ভাঙায় উচ্ছ্বসিত। ডেনমার্ক থেকে মোবাইলে বললেন, ‘‘অনির্বাণ যে মেজরে আমার পারফরম্যান্স টপকে গেল সেটাই বলে দিচ্ছে ভারতীয় গল্ফ কী অসাধারণ উন্নতি করছে। নিজের নামের পাশে রেকর্ডটা দেখার চেয়ে এই অগ্রগতিটা আমার কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি।’’
এক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আর একটায় যাওয়ার ফাঁকে অনির্বাণের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাননি। সেই আফসোস জানিয়ে গগনজিৎ ভুল্লার মোবাইলে বলছিলেন, ‘‘ভারতীয় গল্ফের অনির্বাণের মতো হিরোদের ভীষণ দরকার। অসাধারণ কৃতিত্ব! আজ গোটা দেশ ওকে নিয়ে গর্বিত!’’
ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কৃতিত্বে বুক ফুলিয়ে ঘুরছেন রাহিল গাঙ্গজি। বলছিলেন, ‘‘একদম চ্যাম্পিয়নের মতো খেলেছে। যে ভাবে বিশ্বের সেরাদের পাশে স্নায়ু ধরে রেখে শেষ রাউন্ডটা খেলল, আমি গর্বিত ও আমার বন্ধু। কিপ ইট গোয়িং বান!’’
বান, অনির্বাণের ডাক নাম। আদরের সেই নামেই তাঁকে ডাকেন অধিকাংশ ভারতীয় গল্ফার। যাঁদের খুব কাছের মানুষ বাঙালি গল্ফার। যিনি পিজিএ ট্যুরে খেলার প্রবল চাপেও নিয়ম করে খবর রাখেন ভারতীর গল্ফের। ফেসবুকে বা টুইটারে সতীর্থদের অভিনন্দন জানাতে ভোলেন না ছোটখাট কোনও সাফল্যেও। সেই অনির্বাণের এমন কৃতিত্বে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে দিগ্বিজয় সিংহ আবার আফসোস করছিলেন, ‘‘শেষ হোলটা বোগি না করলে চতুর্থ হতে পারত। একটুর জন্য ফ্সকে গেল!’’ খুব ভোরেই ফোন করেছিলেন। পার্টির দাবিও তোলেন। বলছিলেন, ‘‘ভারতীয় গল্ফের তো বটেই, এশীয় ট্যুরেরও মর্যাদা বাড়াল ছেলেটা। এর পর হয়তো ক্রিকেট নিয়ে বাড়াবাড়ির পাশে গল্ফও প্রচার আর স্পনসর, দু’টোই আরও বেশি পাবে।’’
অনির্বাণ আগাস্টা মাস্টার্সে নামার সময় জীব বলেছিলেন, ‘‘লিখে নিন। এর পরের মেজরগুলো আরও ভাল খেলবে।’’ এ দিন সেই কথার সূত্র ধরেই বললেন, ‘‘এখন বিশ্বসেরাদের পাশে খেলায় ও অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ। সেটাই পারফরম্যান্সেও উঠে আসছে।’’ দিগ্বিজয় আবার বলছিলেন, ‘‘পিজিএ ট্যুর অনেক বেশি কঠিন। এশিয়ার চেয়ে ওখানকার কোর্সগুলো অনেক আলাদা। মাটি শক্ত বলে বাউন্সও আলাদা। অনির্বাণ এতদিনে সেই বাউন্সটার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। ব্রিটিশ ওপেনে ভাল শুরু করাটাও ওকে বাড়তি আত্মবিশ্বাস দিয়েছে।’’
অভিজ্ঞ জীব আবার আরও বড় প্রেক্ষিতে দেখতে চাইছেন এই সাফল্য। বলছিলেন, ‘‘অনির্বাণ পারায় আমাদের অন্য ছেলেরাও এ বার বড় স্বপ্ন দেখতে চাইবে। একটা সুস্থ্ প্রতিযোগিতা গল্ফের মান আরও বাড়াবে। আমার ধারণা, ভারতীয় গল্ফের ভবিষ্যৎ অনেকটাই পাল্টে দেবে অনির্বাণের এই পারফরম্যান্স।’’