নায়ক: রাঁচীতে সংযমের ছবি তিনি। সেঞ্চুরি করার পর পূজারা। রয়টার্স
টাইম মেশিন বলে কি কিছু আছে? বোধহয় না।
তবু তো সত্তর-আশির দশকে ফিরে যাওয়া গেল। টাইম মেশিন ছাড়াই। শনিবার ক্রিকেটভক্তদের সে যুগে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন চেতেশ্বর পূজারা।
হাল আমলের সাড়ে তিন বা চার দিনে শেষ হওয়া টেস্ট ম্যাচ নয়। রাঁচীর জেএসসিএ স্টেডিয়ামে যেন এমন এক টেস্ট ম্যাচের রিপ্লে চলছে, যা হতো টাইগার পটৌডি, বিষাণ সিংহ বেদী, সুনীল গাওস্করদের যুগে। যাতে পাঁচ দিনের ক্রিকেট যুদ্ধের গনগনে আঁচ থাকত ভরপুর।
আদি ক্রিকেটের অকৃত্রিম উপাদানে ভরা এক অসাধারণ ও স্মরণীয় ইনিংস শুক্রবার খেলেছেন স্টিভ স্মিথ। আর শনিবার পূজারা উপহার দিলেন তেমনই এক আভিজাত্যে মোড়া ইনিংস, যা টেস্ট ক্রিকেটের খানদানি মশলায় ঠাসা।
রক্ষণশীল ক্রিকেট ভক্তদের এখন উৎসবের সময়। টেস্ট ক্রিকেটের গরিমা হারিয়ে যাচ্ছে বলে যাঁরা এত দিন বুক চাপড়াতেন, তাঁদের একজন বিষাণ সিংহ বেদী। টেস্ট ক্রিকেটের মরণঘণ্টা বেজে গিয়েছে বলে প্রায়ই হা-হুতাশ করতেন যিনি, সত্তরের সেই ভারত অধিনায়ক শনিবার দিল্লি থেকে ফোনে বলেন, ‘‘এ যেন আমাদের সময়ের টেস্ট ফিরে এসেছে। দক্ষতা, ধৈর্য, টেকনিক, সৌন্দর্য, বুদ্ধি। এ সবের মিশ্রণ দেখতে পাচ্ছি। আগের দিন দেখিয়েছে স্মিথ আর আজ আমাদের পূজারা। আইপিএলের যুগেও এ সম্ভব!’’
আরও খবর: পূজারার ব্যাটে লড়ছে ভারত, সঙ্গী ঋদ্ধিমান
চলতি সিরিজের তৃতীয় টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার ৪৫১ রানের জবাবে ভারত তৃতীয় দিনের শেষে ৩৬০-৬। দলকে লড়াইয়ে রাখলেন ২৯ বছরের গুজরাতি ব্যাটসম্যান পূজারা। মন্থর, কিন্তু টেস্ট কেরিয়ারের উৎকৃষ্টতম সেঞ্চুরিটা করে যিনি প্রমাণ করে দিলেন ওয়ান ডে, টি-টোয়েন্টির রমরমার মধ্যেও বিশুদ্ধ টেস্ট ইনিংস খেলা যেতে পারে।
সৌজন্য: স্লেজিংয়ের উত্তাপ থেকে সাময়িক মুক্তি। পূজারাকে সেঞ্চুরির জন্য অভিনন্দন স্টিভ স্মিথের। পিটিআই
সাত ঘণ্টায় ৩২৮ বল খেললেন। দিনের শেষে ১৩০ রানে অপরাজিত। রান এল মাঠের সব দিক থেকে। ক্রিকেটের প্রায় সব রকম শটের পশরাই থালায় সাজিয়ে ক্রিকেটপ্রেমীদের সামনে পেশ করলেন শিল্পী পূজারা। প্রতিটাই নিখুঁত, নিপুণ ও দর্শনীয়। এই ধুমধাড়াক্কা ক্রিকেটের যুগে চোখে আরাম এনে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
প্রথম ৪০টা রান করতে যখন তাঁর ১৩৯ বল লেগে যায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় তখন ‘বিজ্ঞ’-দের আলোচনা, কোহালির আক্রমণাত্মক ক্রিকেট তত্ত্বের দফারফা করে দিচ্ছেন যে পূজারা। পরের ৬০ রান ৭৫ বলে আসতেই সে সব কর্পূরের মতো উবে গেল। পূজারার নিখুঁত ড্রাইভ, ফ্লিক ও কাটে তখন সারা স্টেডিয়াম মুগ্ধ।
টিভিতে এই ইনিংস দেখার পর তাঁর বাবা ও কোচ অরবিন্দ পূজারাও উত্তেজিত। রাজকোট থেকে ফোনে বললেন, ‘‘আমার চিন্টু কত বড় ব্যাটসম্যান, তার প্রমাণ আজ দিয়ে দিল। আইপিএলে ও খেলে না বলে আমার কোনও আক্ষেপ নেই। সোনা অনেকেই কিনতে পারে। হিরে কেনে ক’জন বলুন তো? ওকে লোকে টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবেই চিরকাল মনে রাখুক।’’
মুরলী বিজয়কে তৃতীয় দিনে ভাল মতোই পাশে পেয়েছিলেন পূজারা। কিন্তু বিজয় আধুনিক ক্রিকেটের আকর্ষণীয় উপাদানগুলোকে মেশাতে চান ব্যাটিংয়ে। তাই মাঝে মাঝেই বাঁধনহারা হয়ে পড়েন। এ দিনও সে রকমই এক মুহূর্তের শিকার হয়ে নিজের ৫০তম টেস্টে সেঞ্চুরিটা আর পাওয়া হল না বিজয়ের। ১৮ রান দূরে ও’কিফের বলে ধোঁকা খেয়ে যান। না হলে এই টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার স্মিথ-ম্যাক্সি জুটির যোগ্য জবাব হয়ে উঠতে পারতেন মুরলী-পূজারা।
দিনের শেষে সাংবাদিকদের বিজয় বলেন, ‘‘ঠিক আগের বলটাই তেমন স্পিন করেনি দেখে আমি ভাবলাম রান করার সুযোগ আছে। ফিল্ডিংও বেশি ছড়ানো ছিল না। স্টেপ আউট করে মারা শটগুলোর উপর ভরসা আছে। কিন্তু ধোঁকা খেয়ে গেলাম। আমি ক্রিজে থাকলে হয়তো আরও ভাল জায়গায় থাকত দল।’’
তাঁদের ১০২ রানের পার্টনারশিপ ছাড়াও বিজয়-কেএল রাহুলের ৯১ রানের ওপেনিং পার্টনারশিপটাও বলার মতো। এখন বঙ্গসন্তান ঋদ্ধিমান সাহাই পূজারা ও ভারতের ভরসা। পূজারাকে নিয়ে বিজয় বললেন, ‘‘ও একাই প্রচুর চাপ নিতে পারে। ওর ওপর প্রচুর ভরসা করা যায়। ও সঙ্গে থাকা মানে নিশ্চিন্তে নিজের স্বাভাবিক খেলাটা খেলা যায়। আমরা দু’জনেই ফর্মে আছি। এই ব্যাপারটাও দলের কাজে লেগেছে।’’
তৃতীয় দিনের শেষে দুই শিবিরই বলছে, ম্যাচ যে কেউ জিততে পারে। বিজয় তো বললেনই, সাংবাদিক বৈঠকে এসে একই কথা বলে গেলেন স্মিথদের সহকারী কোচ ডেভিড সাকেরও।
এই না হলে আসল টেস্ট ক্রিকেটের উত্তেজনা!