অনির্বাণের জাদুদণ্ডে নতুন শিখরে বাঙালি

নির্ভুল নিশানায় লম্বা ড্রাইভ মারার দক্ষতায় জ্যাক নিকোলাসের মতো কিংবদন্তি গল্ফারের পাশে বসেছে তাঁর নাম। আবার, প্রিয় আলু-পোস্ত রাঁধতেও নাকি সমান পারদর্শী! একই সঙ্গে ঠিক এতটাই আন্তর্জাতিক এবং আটপৌরে অনির্বাণ লাহিড়ী! দেড় বছর বয়সে কলকাতা ছেড়ে গেলেও যিনি নিজেকে ষোলো আনা বাঙালি বলতেই পছন্দ করেন। রবিবার মার্কিন মুলুকের উইসকনসিনের হুইসলিং স্ট্রেটস কোর্সে সেই বাঙালির কীর্তিতে ভর দিয়েই নতুন শৃঙ্গ স্পর্শ করল ভারতীয় গল্ফ।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ অগস্ট ২০১৫ ০৩:৫৬
Share:

পিজিএ চ্যাম্পিয়নশিপে পঞ্চম হওয়ার পথে অনির্বাণ। ছবি: এএফপি

নির্ভুল নিশানায় লম্বা ড্রাইভ মারার দক্ষতায় জ্যাক নিকোলাসের মতো কিংবদন্তি গল্ফারের পাশে বসেছে তাঁর নাম।
আবার, প্রিয় আলু-পোস্ত রাঁধতেও নাকি সমান পারদর্শী!
একই সঙ্গে ঠিক এতটাই আন্তর্জাতিক এবং আটপৌরে অনির্বাণ লাহিড়ী! দেড় বছর বয়সে কলকাতা ছেড়ে গেলেও যিনি নিজেকে ষোলো আনা বাঙালি বলতেই পছন্দ করেন।
রবিবার মার্কিন মুলুকের উইসকনসিনের হুইসলিং স্ট্রেটস কোর্সে সেই বাঙালির কীর্তিতে ভর দিয়েই নতুন শৃঙ্গ স্পর্শ করল ভারতীয় গল্ফ। মরসুমের শেষ মেজর, পিজিএ চ্যাম্পিয়নশিপে পঞ্চম স্থানে শেষ করার পর বেঙ্গালুরু বা কলকাতার গণ্ডি পেরিয়ে এই মুহূর্তে যিনি প্রকৃতই গল্ফ-বিশ্বে ভারতীয় কোহিনুর!
অনির্বাণই প্রথম ভারতীয় গল্ফার যিনি কোনও মেজরের আসরে সেরা পাঁচ জনে থেকে টুর্নামেন্ট শেষ করলেন। পুরস্কার মূল্যে জিতলেন ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় আড়াই কোটি টাকা। এখন তাঁর ড্রাইভ, তাঁর পাটিং থেকে শুরু করে খেলার ফাঁকে পঞ্জাবিতে ক্যাডি রাজীব শর্মার সঙ্গে শলাপরামর্শ, গল্ফ কিটসের উপর ছাপানো ডাকনাম ‘বান’ (বন্ধু ও ঘনিষ্ঠজনেরা এই নামেই ডাকেন)— সবই আন্তর্জাতিক গল্ফের নবতম চর্চার বিষয়।
অস্তগামী টাইগার উডসের পাশে গত কয়েক মাসে গল্ফ দুনিয়ায় স্বপ্ন বোনা শুরু হয়েছে নতুন প্রজন্মকে ঘিরে। যার মধ্যে ছিলেন এ বছরের জোড়া মেজর জয়ী, সদ্য এক নম্বর হওয়া জর্ডান স্পিয়েথ। আলোচনায় এখন অনির্বাণও। রবিবারের সাফল্যের পর বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে যিনি আবার উঠে এসেছেন আটত্রিশে (সেরা ছিল ৩৪)। এই মরসুমে খেলেছেন গল্ফের সব ক’টি মেজর। কাট ফস্কেছেন শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র ওপেনে। এশীয় ট্যুরে অনির্বাণের সাত খেতাবের দু’টো এসেছে এ বছর। সঙ্গে পুরস্কারমূল্যে প্রায় ৯ লক্ষ সাড়ে ২৫ হাজার ডলার জিতে এশিয়ার সেরা গল্ফার তো ছিলেনই। বাকিদের সঙ্গে ব্যবধানটা আরও দুর্লঙ্ঘ্য করে তুললেন এ বার। ইউরোপীয় ট্যুরের প্রথম দশ গল্ফারের মধ্যেও চলে এলেন। সঙ্গে বাড়তি সম্মান, অনির্বাণ থাকবেন প্রেসিডেন্টস কাপের টিমে।
সাম্প্রতিক কালে ইনডিভিজুয়াল স্পোর্টসের দুনিয়ায় এমন অনায়াস দাপট দেখানো ভারতীয়ের সংখ্যাটা হাতে গোনা। দাবায় বিশ্বনাথন আনন্দের স্বর্ণযুগ আপাতত কড়া চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। টেনিসে সানিয়া মির্জা, ব্যাডমিন্টনে সাইনা নেহাওয়াল আছেন। বাঙালি বলতে একমাত্র আঠাশ বছরের বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা।

Advertisement

খেলার জগতে ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টের বিরুদ্ধে মোহনবাগানের জয়, ডন ব্র্যাডম্যানকে প্রবীর সেনের স্টাম্পিং, পঙ্কজ রায়ের বিশ্বরেকর্ড বা লর্ডসের বারান্দায় সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের জার্সি খুলে ওড়ানোর মতোই বাঙালির ক্রীড়া লোকগাথায় অধ্যায় হয়ে থেকে যাবে অনির্বাণের এই পঞ্চম স্থানটাও। যা গ্র্যান্ডস্ল্যামের ফাইনাল খেলার মতোই সাড়া ফেলা। লিয়েন্ডার পেজের নাম মনে পড়েছে অনেকের। তবে ক্রীড়ারসিকেরা মনে করালেন, লিয়েন্ডারের কৃতিত্ব মূলত ডাবলস-এ। অনির্বাণ সে দিক থেকে অনিবার্য ভাবেই অনেক কদম এগিয়ে থাকবেন। ভারতীয় গল্ফ ইউনিয়নের গৌরব ঘোষ তো এ দিন বলেই দিলেন, ‘‘কোনও সন্দেহ নেই, সৌরভের পর কোনও বাঙালির হাত ধরে এটাই ভারতের সেরা স্পোর্টিং অ্যাচিভমেন্ট।’’ আজ যাঁর কৃতিত্ব পেরিয়ে গেলেন অনির্বাণ, সেই জীব মিলখা সিংহ নিজে সুদূর ডেনমার্ক থেকে বলছিলেন, ‘‘অসম্ভব আনন্দ হচ্ছে। ২০০৮-এ এই টুর্নামেন্টে আমার নবম স্থানটা টপকে গেল অনির্বাণ। ব্যক্তিগত ভাবে আমি দারুণ গর্বিত। গোটা দেশ গর্বিত। তবে আমি বলব, অবিশ্বাস্য একটা অভিযান সবে শুরু হয়েছে। অনির্বাণ কিন্তু এমন সম্মান আরও অনেক নিয়ে আসবে।’’

এই নায়ককে নিয়ে তো বাঙালি গর্ব করবেই!

Advertisement

ঠিকানা বেঙ্গালুরু হলেও ‘প্রবাসী বাঙালি’ তকমাটা ঘোর অপছন্দ অনির্বাণের। একবার আলাপচারিতায় প্রসঙ্গটা উঠেছিল। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদী তিনি, ‘‘আমি কলকাতায় মাত্র দেড় বছর বয়স পর্যন্ত থেকে থাকতে পারি। কিন্তু মনেপ্রাণে আমার চেয়ে খাঁটি বাঙালি কম পাবেন।’’ সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসাবে আলু-পোস্ত প্রেম সামনে রেখে দাবি করেছিলেন, রান্নাটা জানেন।

বাবা সেনাবাহিনীর চিকিৎসক। বদলির চাকরি। সেই সূত্রে প্রায় গোটা দেশেই ঘুরেছেন। ‘‘কিন্তু বাড়িতে আমরা বাংলায় কথা বলি। বাঙালি সংস্কৃতি আর বাঙালি খাবার আমার সবচেয়ে প্রিয়।’’ দাদু-দিদা কলকাতায় থাকায় মাঝেমধ্যেই আসতেন এ শহরে। ইদানীং নিজের ব্যস্ত গল্ফ-সূচির চাপে অবশ্য কলকাতা সামান্য পিছনের সারিতে। তবে গড়পড়তা বাঙালির মতোই ভোজনরসিক হিসাবে বেশ নামডাক অনির্বাণের। কলকাতার আর এক তারকা গল্ফার, তাঁর প্রিয় বন্ধু রাহিল গাঙ্গজি যেমন জানাচ্ছেন, দু’বছর আগে শেষ যে বার কলকাতায় খেলে যান, সে বার কিঞ্চিৎ অতিরিক্ত মাত্রায় চিকেন রেজালা খেয়ে সামান্য অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। যখনই কলকাতায় আসেন বিরিয়ানি, নানান মাছের পদ আর মিষ্টিতে বাঙালি হওয়ার ষোলো আনা রসনা তৃপ্তিটাও সেরে যান।

তবে গল্ফের স্বার্থেই সে সব অনেক পাল্টেছে ইদানীং। গত দু’বছরে ইন্দোনেশিয়া মাস্টার্স, ভেনেশিয়ান ম্যাকাউ ওপেন, মেব্যাঙ্ক মালয়েশিয়া ওপেন এবং হিরো ইন্ডিয়া ওপেন জিতে ধূমকেতু উত্থানে অনিবার্ণ পৌঁছে গিয়েছেন পেশাদারি গল্ফের সেরার সেরাদের পাশে। জিতে নিয়েছেন গল্ফের মক্কা, পিজিএ ট্যুরে খেলার কার্ড। ভারতীয় গল্ফারদের মধ্যে যে কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন তাঁর আগে শুধু অর্জুন অটওয়াল এবং জীব মিলখা সিংহ।

পিজিএ ট্যুরে নিয়মিত খেলার যোগ্যতা অর্জনের পরের ধাপটা ছিল আন্তর্জাতিক গল্ফে রোরি ম্যাকিলরয়, টাইগার উডসের মতো মহাতারকাদের পাশে নিয়মিত খেলে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার পরীক্ষা। যাতে রবিবারের পর সসম্মানে উত্তীর্ণ অনির্বাণ। নিজেই বলেছেন, ‘‘বিশ্বের সেরাদের পাশে এই যে নিজেকে প্রমাণ করতে পারলাম, এতে আত্মবিশ্বাসটা বিশাল বেড়ে গেল। এখন জানি, আর একটু উন্নতি করতে পারলে মেজর চ্যাম্পিয়ন হওয়াও অসম্ভব নয়।’’

অনির্বাণকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা বলছেন, এই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে স্বপ্ন দেখার সাহসটাই তাঁর আসল শক্তি। সঙ্গে প্রায় যোগীর নিষ্ঠায় গল্ফ সাধনা।

গৌতম বুদ্ধের বিপাসনা যোগ অনির্বাণ নিয়মিত করেন একাগ্রতা বাড়াতে। গল্ফটা খেলেনও প্রায় উপাসনার মতোই। এতটাই নিষ্ঠা যে, ব্রিটিশ ওপেনে ডাক পাওয়ায় নববধূ ঈপ্সার সঙ্গে ম্যাডাগাস্কারের হনিমুন মাঝপথে মুলতুবি রেখেই ছুটে গিয়েছিলেন খেলতে। জুনিয়র পর্যায় থেকে অনির্বাণের উত্থান দেখেছেন গৌরব ঘোষ। বলছিলেন, ‘‘বেঙ্গালুরুর ইগলটন গল্ফ কোর্স বাড়ি থেকে দূরে ছিল বলে কোচ বিজয় দ্বিবেচার সঙ্গে একটা ভাড়ার বাড়িতে থাকত ও। অনেক কষ্ট করেছে।’’

দিল্লি থেকে গল্ফার দিগ্বিজয় সিংহ টেলিফোনে বলছিলেন, ‘‘বান-এর এই সাফল্যের কারিগর শুধু ও নিজে আর ওর কোচ। অন্য কেউ এর কৃতিত্ব দাবি করতে পারবে না। আজ একার চেষ্টায় ভারতীয় গল্ফকে বিশ্বসেরাদের পাশে পৌঁছে দিল! হ্যাটস অফ!’’

আসমুদ্র হিমাচলও ঠিক এটাই বলছে।

হ্যাটস অফ!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement