কেউ যেতে চান ব্রাজিলের নতুন প্রজন্মের ফুটবল-শিল্প দেখতে, কাউকে টানছে, গতিময়-জার্মানি দর্শন!
ব্রাজিল মানেই চোখের সামনে ভেসে ওঠা পেলে, রোনাল্ডো, রোনাল্ডিনহো, নেমার। আর জার্মানি মানেই ফ্রানৎস বেকেনবাউয়ার, গার্ড মুলার, টমাস মুলারদের চোখ ধাঁধানো শৃঙ্খলাবদ্ধ ফুটবলের আলপনা।
রবিবাসরীয় রাতে যুবভারতীতে অনূর্ধ্ব ১৭ বিশ্বকাপের সবথেকে হাই ভোল্টেজ ম্যাচ। তাই দূরে থাকতে চাইছেন না কেউই। টিভির পর্দায় নয়, ‘ম্যাচ অব দ্য টুনার্মেন্ট’ চাক্ষুস দেখতে চুনী গোস্বামী থেকে মহম্মদ আজহারউদ্দিন, সুব্রত ভট্টাচার্য থেকে অর্ণব মণ্ডল, গৌতম সরকার থেকে মহম্মদ রফিক সবাই যেতে চান স্টেডিয়ামে। বসতে চান গ্যালারিতে। চাখতে চান বিশ্বের শক্তিধর দুই টিমের নতুন প্রজন্মের ফুটবল।
আরও পড়ুন: সমর্থন নিয়ে চিন্তিত নয় জার্মানি
‘‘আমি টি এফ এ-র দায়িত্বে থাকার সময় সাও পাওলো অ্যাকাডেমিতে গিয়েছিলাম ছয় জন ছাত্রকে নিয়ে। আশির দশকের স্মৃতি এখনও টাটকা। দেখেছিলাম, কী ভাবে তৈরি করা হয় ছেলেদের। এত দিন পরে দেখতে চাই কী ভাবে বদলেছে ব্রাজিল বা আদৌ বদলেছে কি না? সেই গ্যারিঞ্চা, পেলের আমল থেকে দেখছি ওদের। পাওলিনহোরা এখন কেমন অবস্থায়। সেটা দেখতে যাব, ইচ্ছে আছে।’’ কিংবদন্তী চুনী গোস্বামীর ইচ্ছেশক্তি উথলে ওঠে আশি ছুঁতে যাওয়া সত্ত্বেও। ‘‘ব্রাজিল বনাম জার্মানি বিশ্বের যেখানেই খেলা হোক, সেটা আকর্ষণীয় হবেই। আগ্রহও থাকবে।’’
ষটের দশকের প্রাক্তনের সঙ্গে আবেগ মিলে যায় ২০১৭-র মহম্মদ আজহারউদ্দিনের। চুনীর মতো এই প্রজন্মের আজহারও একটা ম্যাচ দেখতে যুবভারতীতে যাননি। গ্রামের বাড়িতে বসেই আজহার টিভিতে খেলা দেখেছেন দুটো টিমের। উনিশ বছর বয়সি আজহারের আক্ষেপ, তাঁর চেয়ে কম বয়সি ছেলেরা যে গতি বা স্কিল নিয়ে যুব বিশ্বকাপ খেলছেন সেটা তিনি পারেন না বলে। কলকাতার ‘ডার্বি বয়’ বলছিলেন, ‘‘সোমবার থেকে মোহনবাগানের অনুশীলন শুরু হবে। ভাবছি তার আগের দিন চলে যাব কলকাতায়। টিকিট জোগাড়ের চেষ্টা করছি। খুব ইচ্ছে ম্যাচটা দেখার। এই ম্যাচ তো আর দেখতে পাব না গ্যালারিতে বসে।’’
পেলের কসমসের বিরুদ্ধে খেলেছেন সুব্রত ভট্টাচার্য এবং গৌতম সরকার। দু’জনে প্রকাশ্যেই নিজেদের বলেন, ব্রাজিল সমর্থক। কিন্তু যুবভারতীতে গ্রুপ লিগের কোনও ম্যাচ দেখেননি ওঁরা দু’জনেই। কেন রবিবার .যাবেন? সাত-আটের দশকের ‘ছোট বেকেনবাউয়ার’ বলা হত যাঁকে সেই গৌতম সরকার বলছিলেন, ‘‘আরে ফাইনাল না দেখলেও কোনও আক্ষেপ থাকবে না। কিন্তু এই ম্যাচটা দেখতেই হবে মাঠে বসে। ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন হবে কি না জানি না। তবে পাওলিনহো, ব্রেনের, অ্যালেন সৌজা-রা যেন পুরানো ব্রাজিলকে ফিরিয়ে এনেছে। দেখতে বেশ ভাল লাগছে।’’ পাশাপাশি দেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা মিডিও-র মন্তব্য, ‘‘বিশ্বকাপে ঘরের মাঠে জার্মানির কাছে সাত গোলে খেয়েছিল ব্রাজিল। সেটা এখনও ভেসে ওঠে। মনে হয় কী ভাবে এটা হল? রবিবার কিন্তু ব্রাজিল ফেভারিট।’’
সাতাত্তরে পেলের টিমের বিরুদ্ধে গৌতমের মতোই সুব্রত খেলেছিলেন। আটকে দিয়েছিলেন ফুটবল সম্রাটকে। পেলের অভিনন্দন জানিয়ে জড়িয়ে ধরা সেই ছবি এখনও তাঁর গল্ফগ্রিনের বাড়ির ড্রইংরুমে দেখা যায়। ভারতীয় ফুটবলের সেই সফলতম ফুটবলার ও কোচ সুব্রত বলছিলেন, ‘‘আমি দেখতে যাব গতি বনাম স্কিলের লড়াই। এমনিতে টিভিতে খেলা দেখছি। কিন্তু যা দেখার জন্য যাব সেটা টিভি দেখে পুরোপুরি বোঝা যায় না। জার্মানরা ডাইরেক্ট ফুটবল থেকে সরে আসছে। ব্যক্তিগত দক্ষতাকে প্রাধান্য দিচ্ছে। ব্রাজিলের এই টিমটা বেশ ভাল খেলছে। চার-পাঁচটা ছেলে তো বেশ ভাল। এই লড়াইটা দেখতেই হবে।’’ পাশাপাশি ঠোটকাঁটা হিসাবে পরিচিত সুব্রতর মন্তব্য, ‘‘মাঠে তো যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ‘কার পার্ক’ তো পাওয়াই যাচ্ছে না। টিকিটের মতোই ওটা নিয়েও শুনছি নানা গণ্ডগোল।’’
সুব্রত-গৌতমদের মতোই এই প্রজন্মের অর্ণব মণ্ডল-মহম্মদ রফিকরাও যুবভারতীতে হাজির থাকবেন ব্রাজিল-জার্মানি যুদ্ধ দেখতে। এর আগে কোনও ম্যাচ দেখেননি দু’জনেই। অর্ণব জাতীয় দলের ফুটবলার হিসাবে একটা টিকিট পেয়েছেন ওই ম্যাচের। ‘‘সব খেলাই দেখছি। তবে ফিজিক্যালি ব্রাজিল অনেকটা এগিয়ে থাকবে এই ম্যাচে। সেই তুলনায় জার্মানরা অত সংগঠিত নয়। তবে ওদের স্ট্রাইকার ইয়ান ফিটো আর্প বেশ ভাল। গোলটা চেনে।’’
বোঝাই যায় প্রতিটি ম্যাচ কতটা মনোযোগ দিয়ে দেখছেন এ বারের ইস্টবেঙ্গল অধিনায়ক। আর স্টিভন কনস্ট্যান্টাইনের ভারতীয় দলের অপরিহার্য মিডিও মহম্মদ রফিক তো রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে আছেন রবিবারের ম্যাচ দেখার জন্য। বলছিলেন। ‘‘আমি আর্জেন্তিনার সমর্থক। কিন্তু ব্রাজিলের এই টিমটার খেলা এত ভাল লাগছে কী বলব। বিশেষ করে দশ (অ্যালেন) আর সাত (পাওলিনহো) নম্বর ছেলেটা দারুন খেলছে।’’ আই এস এলের প্রায় সব টিমই প্রস্তুতির জন্য বিদেশে। সুব্রত পাল, মেহতাব হোসেন, জেজে লালপেখলুয়ারা তাই বিদেশে বসেই ম্যাচটা দেখবেন বলে জানাচ্ছেন। তাঁদের সবারই আফসোস বিশ্বকাপের সেরা ম্যাচটা মাঠে বসে দেখা হবে না বলে।