মীরপুরের গ্যালারিতে ক্রিকেট পাগল বাংলাদেশিরা।
বুধবার যখন শের-ই-বাংলার মাঠে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি আর মাশরফি মর্তুজাকে নিয়ে টস করতে গিয়েছিলাম, তখন ওদের সঙ্গে কথা বলার সময় বুঝতেই পারিনি যে, স্টেডিয়ামের পিএ মানে পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমেও আমাদের গলা শোনা যাচ্ছিল।
টের পেলাম বৃহস্পতিবার। শ্রীলঙ্কা-আরব আমিরশাহি ম্যাচের টসের সময়। যখন আমি একই ভূমিকায়। টসজয়ী আমিরশাহি ক্যাপ্টেন আমজাদ জাভেদকে প্রশ্ন শুরু করতেই যেন চার দিক থেকে ছুটে এসে আমারই গমগমে আওয়াজ আমাকে ধাক্কা মারল। প্রথম কয়েক সেকেন্ড হকচকিয়ে গিয়েছিলাম, আরে এ তো আমারই গলা!
আসলে কী হয়েছে জানেন?
বুধবারের ম্যাচে গ্যালারির হইহুল্লোড়, দর্শকদের চেঁচামেচির আওয়াজে চাপা পড়ে গিয়েছিল স্টেডিয়ামের পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমের হাজারো ওয়াটের শব্দও। তাই সে দিন তা কানেই আসতে দেয়নি। আর পরের দিন শ্রীলঙ্কা-আমিরশাহি ম্যাচে প্রায় ফাঁকা গ্যালারি। তাই আওয়াজটা যেন কানে ধাক্কা মারল।
এই হল বাংলাদেশ আর তার ক্রিকেটপ্রেমী জনতা। এমন ক্রিকেটপাগলামি দেখিনি কখনও।
হ্যাঁ, আমাদের কলকাতাতেও ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে উন্মাদনা দেখেছি। মাঠে ঢোকার লম্বা লাইনও দেখেছি। কিন্তু খেলা শুরুর চার ঘন্টা আগেও বিশাল লাইন! ইডেনে কোনও দিন দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না। যা দেখলাম ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচের দিন শের-ই-বাংলায়।
আমরা যারা টিভিতে কমেন্ট্রি করি, তাদের খেলা শুরুর চার-পাঁচ ঘন্টা আগেই মাঠে চলে আসতে হয়। আমিও সে দিন দুপুরেই শের-ই-বাংলায় চলে আসি। মাঠে ঢোকার সময় ওই বিশাল লাইন দেখে সত্যিই অবাক হয়ে যাই। এ কী পাগলামি রে বাবা! আর মাঠে ঢুকে দেখলাম গ্যালারিতে খেলার আগের ওই তিন-চার ঘন্টা ধরে মানুষগুলো সমানে পতাকা নেড়ে গেল, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গান গাইল, স্লোগান দিল। অসাধারণ!
আসলে গত বছর ভারতকে ওয়ান ডে সিরিজ হারানোর পর থেকে বাংলাদেশি ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে একটা ধারণা হয়েছিল যে এর পর থেকে তাদের প্রিয় দল ভারতকে যেখানে পাবে, সেখানেই হারাবে। এখানকার কয়েকটা টিভি চ্যানেলেও গত কয়েক দিন ধরে প্রায় একই কথা বলা হচ্ছিল শুনছিলাম। কিন্তু বুধবারের ম্যাচের পর বোঝা গেল, ধারণাটা পুরোপুরি ঠিক না। বাংলাদেশের হারের পর সে দিন ওই ভেঙে পড়া মানুষগুলোর মুখের দিকে সত্যিই তাকানো যাচ্ছিল না যেন। মাঠ থেকে হোটেলে ফেরার সময় আমাদের গাড়ির ড্রাইভারেরও দেখলাম প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থা। অনেককে রাস্তা দিয়ে দলবেঁধে হাঁটতে দেখলাম। যেন এ ভাবে নিজেরাই নিজেদের শাস্তি দিচ্ছিল ওরা।
যদিও এটা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট। আজ যে হাসে, কাল তাকে কাঁদতেও হতে পারে। কিন্তু সে দিন ভারতের পারফরম্যান্সটা এতটাই দাপটের ছিল যে, এখন ভারতের ম্যাচ হারা নিয়ে ভাবতেই অনেককে দ্বিধা করতে দেখছি।
আমার যারা সঙ্গী কমেন্টেটর, বিশেষ করে শোয়েব আখতার, ডিন জোন্স, তারা তো ভারতকে প্রায় চ্যাম্পিয়নই বলতে শুরু করে দিয়েছে। যদিও তারাও বিশ্বাস করে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে যখন যা খুশি হতে পারে। তবে ভারতের দাপটে তারা মুগ্ধ। ভিভিএস (লক্ষ্মণ) যদিও ধোনিদের সাবধানে থাকার পরামর্শ দিচ্ছে। শোয়েব আবার মুগ্ধ আশিস নেহরার কামব্যাক পারফরম্যান্সে। চার বছর পর ভারতীয় দলে ফিরে ও যে শুধু দেশের হয়ে ভাল বোলিং করছে, তা কিন্তু নয়, দলের বোলিং ক্যাপ্টেনের ভূমিকাটাও সফল ভাবে পালন করে যাচ্ছে। সে দিন ভারতের প্র্যাকটিসের সময়ও দেখছিলাম বারবার বুমরাহ, হার্দিকদের সঙ্গে কথা বলছিল, বোঝাচ্ছিল অনেক কিছু। পাশাপাশি নিজের কাজটাও করে যাচ্ছে। ওর এই ভূমিকায় নিশ্চয়ই ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট খুশি।
বাংলাদেশে ক্রিকেট মানেই যে উৎসব, তা এখানে আসার পর থেকেই বুঝতে পারছি। বিশেষ করে এখানকার মেয়েদের ইনভলভমেন্ট দেখে আমি মুগ্ধ। গ্যালারিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রচুর মহিলা। সমানতালে প্রিয় ক্রিকেটারদের জন্য গলা ফাটিয়ে যাচ্ছে তারাও।
এই উৎসবটা নিশ্চয়ই আরও জমে যাবে শনিবার। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের দিন। আমার ধারণা ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচের দিন যে রকম মানুষের ঢল নেমেছিল মীরপুরে, শনিবারও সে রকমই হবে আবার। কারণ, এখানকার মানুষ ক্রিকেটকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে। আর ভারত-পাকিস্তান মানেই হাই ভোল্টেজ ড্রামা। এই লড়াই থেকে তাই মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারবে না ওরা। তার উপর পাকিস্তান এখন পুরোপুরি ‘আননোন কমোডিটি’। কখন যে কী করে বসবে, কেউ জানে না। ব্যাট করতে নেমে দু’শোও তুলে দিতে পারে। বিপক্ষকে ৫০-এ অলআউটও করে দিতে পারে, আবার নিজেরা গো হারান হারতেও পারে। তবু ভারত-পাক ম্যাচ মহারণই।