নতুন নায়ক সৌমর সঙ্গে কোচ হাতুরা সিংহে। ছবি: এএফপি।
বছর পাঁচেক আগেও কথাটা বললে, নিঃসন্দেহে লোকে আপনাকে বদ্ধ উন্মাদ না হলে ক্রিকেট নির্বোধ উপাধিতে ভূষিত করত।
ক্রিকেট মানচিত্রে বাংলাদেশ মানে তখনও ছিল রেকর্ডের দেশ এবং শেষোক্ত শব্দ জোড়া মোটেও সম্মানার্থে ক্রিকেটে মহাশক্তিদের টেবিলে ব্যবহৃত হত না। সমীকরণটা সহজ। পদ্মাপারে যাও, অফ ফর্মে থাকা ব্যাটসম্যানদের একটু বাইশ গজে ফূর্তি-টুর্তির সুযোগ করে দাও। রেকর্ডের পর রেকর্ড করো, আর সিরিজটা যথা সামান্য শক্তি খরচ করে জিতে ফিরে এসো। ২০০৭-র বিশ্বকাপে ভারত বধকে তখনও ধরা হত অঘটন। এ দিক ও দিক হঠাৎ হঠাৎ বিশ্ব ক্রিকেটের ‘বড়দাদাদের’ পেড়ে ফেলার কীর্তিকে দেখা হত করুণার চোখে। যেন বরাবরের লাস্ট বেঞ্চের হঠাৎই ইউনিট টেস্টের একটা পেপারে ভাল করে ফেলা। টেস্ট খেলিয়ে দেশ হিসাবে বাংলাদেশের পরিচিতিটা নামেই ছিল শুধু। আসল টেস্ট খেলিয়ে দেশের মর্যাদার সিড়িতে কখনও উঠতে দেওয়া হয়নি।
বুধবার রাতেও চট্টগ্রামে আফ্রিকার ক্রিকেট ঐশ্বর্যের সর্বস্ব লুন্ঠনের পর বাংলাদেশ জনতার নিশ্চিত সমালোচকদের সেই পুরনো মুখগুলো দেখতে ইচ্ছে করছে। নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা-এই নিয়ে ক্রিকেট দুনিয়ার পাঁচ উচ্চ বিত্ত দেশকে ধুয়ে মুছে দেওয়ার পর ইচ্ছে হওয়াটা অন্যায্য নয়। কোনও নায়কের আবির্ভাবের সিনেমা হিট হয়ে যদি পরের গুলো ফ্লপ দিতে থাকে তাকে ওয়ান ফিল্ম ওয়ান্ডার বলা যেতে পারে। কিন্তু পরের পর সিনেমা হিট করতে থাকতে সে নিজেই ওয়ান্ডার হিসাবে বিবেচিত হয়। মহা প্রতিদ্বন্দ্বীদের এক আধ বার হারিয়ে দিলে তাকে জায়ান্ট কিলার বলা চলে। কিন্তু সেটা বারবার ঘটতে থাকতে তাকেই সাক্ষাৎ জায়ান্ট হিসেবে মেনে নিতে হয়। বুধবার রাতের পর বোধ হয় বাংলাদেশ ক্রিকেটের ক্ষেত্রেও এই তুলনা গুলোই প্রযোজ্য।
বিশুদ্ধবাদী সমালোচকেরা যা খুশি রায় দিতে পারেন। বিশ্ব ক্রিকেটে নক্ষত্রেরা এর পরেও ভাবতে পারে টিমটার সাময়িক সুসময় চলছে। কিন্তু বাস্তব হল এর পর থেকে বাংলাদেশকে বাইশ গজে হালকা ভাবে নেওয়া মানে তুমি গেলে। নির্ঘাত মৃত্যু। তাচ্ছিল্য করবে যতটা ফেরতও পাবে ততটা।
উদাহরণ তো সদ্য সমাপ্ত এই সিরিজটাই। এবি ডেভিলিয়ার্স একটি ওয়ানডে ম্যাচ নির্বাসিত ছিলেন। তাঁকে সিরিজ থেকেই ছুটি দিয়ে দিল দক্ষিণ আফ্রিকা। ডেল স্টেন কেন খেললেন না, ক্রিকেট দক্ষিণ আফ্রিকা উত্তরটা দিতে পারবে। পরিণতি? সিরিজে দাঁড় করিয়ে হার। দু’বার দুশোর কমে নামিয়ে দেওয়া। পরিণতি, প্রোটিয়া ক্রিকেট মহলে প্রশ্ন উঠে যাওয়া, ভারত যেখানে পূর্ণ শক্তির টিম পাঠিয়ে নত মস্তকে ফিরে এল সেখানে তোমরা কোন সাহসে এই দুই মহারথী ছাড়া নেমে পড়লে হে!
মাস্টারদার শহরের মায়াবী রাতের পর থেকে ফেসবুক-সহ বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে বাংলাদেশ সমর্থকদের একটা মন্তব্য ক্রমাগত করতে দেখা যাচ্ছে। যে, এ বার অস্ট্রেলিয়াকে চাই। ওরাই আমাদের আসল প্রতিদ্বন্দ্বী। আতিশয্য মনে হোক বা যুক্তিযুক্ত, বাংলাদেশ ক্রিকেটের আজকের উত্তরণের পিছনে এই উদাত্ত সমর্থন কিন্তু বরাবরের প্রেরণা। টিম হারুক, জিতুক যাঁরা সব সময় টিমের পাশে থাকেন। মাঠে টিম নামলে অবধারিত ভাবে যাঁরা হয়ে যান টিমের দ্বাদশ ব্যক্তি। সমর্থনের উত্তাপ আর গর্জনে নামার আগেই প্রতিপক্ষ মনস্তাত্ত্বিক ভাবে ২-০ হেরে শুরু করে। কিন্তু সে সমর্থনে তো আর পরের পর ক্রিকেটীয় যুদ্ধ জেতা সম্ভব নয়। সেখানে স্কিল লাগে, প্রতিভা লাগে। লাগে লৌহ কঠিন মানসিকতা। যা সবার অলক্ষে ধীরে ধীরে একত্র করেছে বাংলাদেশ। এবং সেই প্রতিভার কোহিনুরের ছটা এখন বিশ্বজুড়ে। বিশ্বজুড়ে তাই এখন বাঘের ডাক।