আটলেটিকো- ১ (লারা) : কেরল- ০
২০১৫— তাঁর মাঠে থাকার মোট সময় সত্তর মিনিট।
২০১৬— একশো দু’মিনিট… এখনও পর্যন্ত।
আইএসএলের দু’টো মরসুম মেলালে এটাই আটলেটিকো দে কলকাতার সবচেয়ে দামি ফুটবলারের মাঠে থাকার লেখচিত্র। যেখানে পার্থক্য একটাই। গত বছর চেন্নাইয়ান এফসি-র সঙ্গে উদ্বোধনী ম্যাচে জোড়া গোল ছিল তাঁর। আর এ বার সেই ভরসাটুকুও টিমকে দিতে পারলেন না।
মাত্র আঠারো মিনিটে যখন চোট নিয়ে মাঠ ছাড়ছেন হেল্ডার পস্টিগা, তখন দেখা গেল গালে হাত দিয়ে মাঠের দিকে তাকিয়ে এটিকে কোচ মলিনা। উদ্বিগ্ন। চিন্তিত। তাঁর অভিব্যক্তি যেন এক জনের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছিল তখন— আন্তোনিও লোপেজ হাবাস! বছর খানেক আগে চেন্নাইয়ের মাঠে এ রকম ভাবেই তো দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনিও!
পস্টিগা মাঠের বাইরে যেতেই কোচির জওহরলাল নেহেরু স্টেডিয়াম মেতে ওঠে উৎসবে। ঢাকের শব্দ আর মোবাইল আলোর রোশনাইয়ে গ্যালারির হলুদ-সমুদ্র তখন উত্তাল নাচের মেজাজে। সচিন তেন্ডুলকরের মুখেও দেখা গেল স্বস্তির হাসি। তাঁর পাসে বসা সুপারস্টার অভিনেতা চিরঞ্জিবীর মুখেও তৃপ্তির ছায়া। তবে এক বছর আগে এই আনন্দ-উৎসব যেমন ধরে রাখতে পারেননি অভিষেক বচ্চন। আজ, বুধবার কোচিতে সচিন-চিরঞ্জিবীও ধরে রাখতে পারলেন না। কেন না সে দিনের চেন্নাই-বধের নায়ক যদি ভালদো হন, এ দিনের কোচি-বধের ‘মসিহা’ জাভি লারা।
বিরতির পরে তাঁর গোল যেন পরমাণু বোমার মতো আছড়ে পড়ল ষাট হাজারের হলুদ-গ্যালারিতে। জাভি লারার একটা শটেই সবাই চুপ। বন্ধ ঢাকের শব্দ। সচিনের মুখেও উধাও হাসি। আর এটিকে? উৎসব করার সময় যে তখন তাঁদেরই! গোলের পরে গোটা মাঠ একবার চক্কর কাটলেন লারা। তার পর দ্যুতি-হিউমের হাত ধরে এটিকে-র ডাগ আউটের দিকে ছুটলেন। ম্যাচ শেষে লারা বলছিলেন, ‘‘যে কোনও টুর্নামেন্টে প্রথম জয় খুব জরুরি। এক বার জিততে পারলে পরের ম্যাচগুলোতে কোনও সমস্যা হয় না।’’
টিমের প্রথম জয়ে তৃপ্ত মলিনাও। তবে সেই তৃপ্তির মধ্যে অদ্ভুত একটা আশঙ্কাও যেন উঁকি মারছিল। দেখে মনে হল, কোথাও একটা পস্টিগার জন্য চিন্তা তো আছেই। টিমের পারফরম্যান্সেও যে খুব একটা উচ্ছ্বসিত, সেটা কিন্তু নয়। আসলে গোলের পরে যে ভাবে টিমটা একেবারে ডিফেন্সিভ মোডে চলে গেল, তাতে নিশ্চিন্ত হওয়ার কথাও নয়। বরং ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হলে, হোমওয়ার্কে আরও নজর দিতে হবে। পরিশ্রম করতে হবে। মলিনা অবশ্য বলছিলেন, ‘‘তিন পয়েন্টাই আসল। এই জয়ে টিমের আত্মবিশ্বাস আরও বাড়বে।’’
এমনিতে দেখতে গেলে হাবাসের সঙ্গে মলিনার বিস্তর পার্থক্য। আগের কোচ মেজাজে যতটা অ্যাটাকিং ছিলেন, নতুন কোচ ততটাই ডিফেন্সিভ। সেটা ঘরের মাঠে প্রথম ম্যাচেও স্পষ্ট হয়ে যায়। তবে কেরলের মতো টিম যাঁদের ফুটবলারের তুলনায় ম্যানেজমেন্টের নামের (সচিন-চিরঞ্জিবী-নাগার্জুনা) ওজন বেশি, তাদের বিরুদ্ধে এত ডিফেন্সিভ ফুটবল কী দরকার ছিল? বিশেষ করে যেখানে এগিয়ে দল আর টিম খেলছে ৪-২-৩-১ ছকে।
এখানেই শেষ নয়। টিমের মার্কি ডিফেন্ডার অ্যারন হিউজকে এ দিন খেলাতে পারেননি কপেল। দেশের হয়ে খেলার ডাক পেয়েছেন। তার ওপর কেরলের যে ডিফেন্স লাইন কপেল দাঁড় করিয়েছিলেন তাতে সেন্টার ব্যাকে দু’জনেই ছিলেন আনকোরা। মলিনা অবশ্য স্বীকার করে নিলেন, ‘‘আমরা আরও বেশি গোলে জিততে পারতাম। যে গোলটায় জিতেছি, সেটাও লাকি গোল। তবে এ সব তো ফুটবলে হয়েই থাকে। প্রথম ম্যাচে আমরাও তো বিপক্ষের লাকি গোলের শিকার।’’
এটিকের গোলের উচ্ছ্বাসের আগে কোচি দেখল দুই মহানায়ক চিরঞ্জীবী আর সচিনকে। ছবি আটলেটিকো ওয়েবসাইট ও পিটিআই
কোচের স্ট্র্যাটেজি নিয়ে এত তাড়াতাড়ি কোনও মন্তব্য করা বোধহয় ঠিক হবে না। সবে তো শুরু। আর মলিনাও নতুন টিম নিয়ে প্রথম জয়ের স্বাদ পেলেন। কোথাও একটা বাড়তি চাপ তো থাকবেই। তবে পস্টিগা উঠে যাওয়ার পরে যে ভাবে তিনি টিমটাকে সামলালেন, তাতে হাবাসের ছায়া কিছুটা হলেও টিম থেকে মুছে ফেললেন তিনি। পস্টিগা মাঠ ছাড়তেই হিউম আর লারার কাঁধে দায়িত্ব তুলে দিলেন। এবং দু’জনকেই ক্রমাগত জায়গা বদল করাতে থাকলেন। নিটফল, ধাঁধিয়ে যায় কেরল ডিফেন্স। টিমের অন্যতম অভিজ্ঞ ফুটবলার বোরহা ফার্নান্দেজ বলছিলেন, ‘‘গোটা টুর্নামেন্ট পড়ে আছে। কত ছক বদলাবে। টিম বদলাবে। কিন্তু প্রথম জয়টা খুব টেনশনের হয়। এই ম্যাচটার সঙ্গে আর কোনও ম্যাচের তুলনা হবে না।’’
হয়তো বোরহার কথা ঠিক! এই জয়ের সঙ্গে অন্য কোনও ম্যাচের তুলনা হবে না। কিন্তু পস্টিগা? তাঁকে কত দিন মাঠের বাইরে থাকতে হবে? টিম সুত্রের খবর, বাঁ দিকের পাঁজরে চোট পেয়েছেন তিনি। সেটা কতটা গুরুতর এখনই জানা না গেলেও, এটিকে কোচের দাবি, ‘‘আমরা কলকাতায় ফিরে পস্টিগার কিছু টেস্ট করাব। তার পরে বুঝতে পারব, ও কতটা ফিট খেলার জন্য।’’
ম্যাচের আগে এটিকে-আতঙ্কে ভুগছিল কেরল। ম্যাচ শেষে দেখা গেল সেই আতঙ্কের ছায়া এ বার ঢুকে পড়েছে কলকাতায়। তবে এটা বিপক্ষের চাপে নয়, ঘরের চাপে। পস্টিগা-আতঙ্ক। তাই কোচি থেকে স্যুটকেস-ভর্তি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আতঙ্কও সঙ্গে নিয়ে ফিরছেন মলিনা।
আটলেটিকো: দেবজিৎ, অর্ণব, তিরি, প্রবীর, দ্যুতি (ডিকা), জুয়েল (বিক্রমজিৎ), বোরহা, দ্যুতি (ডিকা), লারা, হিউম, পস্টিগা (বেলেনকোসো)।