প্রাক-লগ্নে পুরস্কার ছাপিয়ে আবেগের পাস নস্ট্যালজিয়ার গোল

আরু...মাই..নাই..গাম! কর্নাটকী সতীর্থের নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে জিভ এত হোঁচট খেত যে, গোটা নামটাই কাটছাঁট করে পাল্টে নিয়েছিলেন চুনী গোস্বামী। শুধু তাই নয়, অরুময়নৈগমের নামটা ভেঙে আরু...মাই করে দেওয়া হয়েছিল বাগানে।

Advertisement

প্রীতম সাহা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০১৫ ০২:৪৩
Share:

আরু...মাই..নাই..গাম!

Advertisement

কর্নাটকী সতীর্থের নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে জিভ এত হোঁচট খেত যে, গোটা নামটাই কাটছাঁট করে পাল্টে নিয়েছিলেন চুনী গোস্বামী। শুধু তাই নয়, অরুময়নৈগমের নামটা ভেঙে আরু...মাই করে দেওয়া হয়েছিল বাগানে। প্রাণাধিক প্রিয় ক্লাবে সেটা চালুও ছিল ফুটবলজীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। সাফল্য আসুক বা ব্যর্থতা, প্রভাবিত হতেন না। মস্তিষ্ক থাকত বরফশীতল। ভিতরে একটা অনন্ত ছটফটানি। অফুরান এনার্জিতে যেন টগবগ করছে সব সময়।

চুনী গোস্বামী ঠিক যে ভাবে আজও মনে রেখেছেন অরুময়কে। এত দিন পরেও অরুময় নিয়ে প্রশ্নে তো সর্বপ্রথম বেরোয়, ‘‘কোনও দিন রাগতে দেখিনি। তরুণ প্রজন্মের জন্য আদর্শ।’’

Advertisement

অরুময়— সাতচল্লিশ বছরেও তিনিও আর পাল্টালেন কোথায়? বার্ধক্য ময়দানের ‘বেবি ট্যাক্সি’-র চাকার গতি কমিয়েছে। কিন্তু বাগান-আবেগ এতটুকু কমেনি। বাগানের নতুন প্রজন্মের গোল দেখলে মুখে এখনও পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে। জরা-বার্ধক্য ভুলে ছিটকে বেরোয় ষাটের দশকের বিদ্যুৎ।

শুক্র-বিকেলে ক্লাব সচিব অঞ্জন মিত্রের ঘরে যখন ঢুকেছিলেন অরুময়, বারাসতে সবুজ-মেরুনের গোল হয়নি তখনও। ঢুকলেন, এবং ক্লাব কাঁপিয়ে চিৎকার উঠল গো-ও-ও-ল! বাগানের এক পরিচিত ক্লাব সদস্যকে দেখা গেল অরুময়কে কোলে তুলে নাচছেন। অর্থসচিব দেবাশিস দত্ত ছুটছেন জড়িয়ে ধরতে। যে আবেগে স্নান করতে করতে বাগান-রত্ন বলে ফেলেন, ‘‘মোহনবাগান বদলায়নি। বদলাবেও না। এত আবেগ, এত ভালবাসা বোধহয় পৃথিবীর আর কোনও ক্লাবে পাব না! বাগানের ঋণ কোনও দিন শোধ করতে পারবে না আমি।’’

বাগান-রত্নের দৌড়ে তিন বার ছিলেন, রত্নলাভ হয়নি এক বারও। চুনী মনে করেন, অরুময়ের আগেই পুরস্কার পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তাঁর কোনও আক্ষেপই নেই। উল্টে বলে দেন, ‘‘নাম ঘোষণাটাই আমার পুরস্কার। আরে, ডুরান্ড জয়ের হ্যাটট্রিক করেছিল প্রথমবার মোহনবাগানই। আর সেই দলের অন্যতম সদস্য ছিলাম আমি। এ রকম অনেক ইতিহাস আছে বাগানে। এত পেয়েছি যে আক্ষেপের কোনও জায়গাই নেই।’’ আক্ষেপ হয় অন্য কারণে। চুনী-পিকে-বলরামের মতো হীরকখণ্ড তো আর ভারতবর্ষের ফুটবলে জন্মাল না।

সত্যি, রত্ন বটে!

চুনীর অন্ধভক্ত ছিলেন। ফুটবলকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার পিছনেও চুনী। ফুটবলজীবনের কীর্তির কথা আর বিশেষ মনে করতে পারলেন না অরুময়। স্মৃতি পথ হারিয়েছে। শুধু একটা কথা মনের গভীরে সযত্নে থেকে গিয়েছে আজও। তাঁর পাস, চুনীর গোল। ‘‘গোটা জীবন এটা আমার কাছে আত্মতৃপ্তির বিষয়। চুনীদার বেশির ভাগ গোল কিন্তু আমার পাস থেকে,’’ ক্লাব লনে দাঁড়িয়ে বলে চলেন অরুময়। যে কথাকে চুনীও স্বীকৃতি দেন। ‘‘অরুময়ের মতো উইঙ্গার ভারতে আর আসেনি, বলব না। কিন্তু এটা বলব যে, ওর মতো নিখুঁত পাসিং ক্ষমতা খুব কম ফুটবলারেরই ছিল।’’ মাঠে চুনীও চাইতেন, বলটা অরুময়ের পায়ে যাক। কারণ সেখান থেকে ঘুরে আসবে তো তাঁরই পায়ে। ‘‘অসাধারণ একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল আমাদের। একটা ভাল জুটি তৈরিতে যা দরকার,’’ আরও বললেন চুনী। প্রশস্তি শুনে অরুময় আবার জুড়লেন, ‘‘চুনীদা আমার যত না সতীর্থ ছিলেন, তার চেয়ে বেশি ছিলেন শিক্ষক। বকাঝকা করতেন। কিন্তু সেটা আমার ভালর জন্য।’’

আজ, শনিবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে শতাব্দীপ্রাচীন ক্লাবের একশো পঁচিশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান। যেখানে আনুষ্ঠানিক বাগান-রত্ন দেওয়া হবে বেঙ্গালুরুবাসী প্রাক্তন উইঙ্গারকে। তার প্রাক্-লগ্নে দাঁড়িয়ে অন্তত মনে হল না শনিবারের অনুষ্ঠান, পুরস্কার, অর্থ কোনও কিছুই তাঁর মাথায় থাকবে বলে। বরং চোখ খুঁজতে পারে আশি ছুঁইছুঁই এক ব্যক্তিত্বকে। শ্রবণেন্দ্রীয় উৎকর্ণ থাকতে পারে পরিচিত— বহুপুরাতন শব্দগুচ্ছের প্রত্যাশায়।

আরু..মাই বলটা বাড়া!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement