প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি

ভেবেছিলাম সুস্থ হয়ে গেলে ওকে বলব, আর হুটহাট ডাইভ দিস না

এখনও চোখে ভাসছে সেই অভিশপ্ত মুহূর্তটা! শুক্রবার দুপুর! ঘড়ির কাঁটায় তখন একটা বাজতে মিনিট পাঁচেক বাকি। শিবু (শিবসাগর সিংহ) প্রাণপণ চেষ্টা করছে অঙ্কিতের মুখে মুখ লাগিয়ে সিপিআর (কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন) দেওয়ার। যাতে ও অক্সিজেনটা পায়। আর আমি চেস্ট পাম্প করছি যাতে হঠাৎ সংঘর্ষে ওর বন্ধ হয়ে যাওয়া শ্বাসটা ফিরে আসে। চোখটা উল্টে গিয়েছে তখনই।

Advertisement

অনুষ্টুপ মজুমদার

শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:১৯
Share:

এখনও চোখে ভাসছে সেই অভিশপ্ত মুহূর্তটা!

Advertisement

শুক্রবার দুপুর! ঘড়ির কাঁটায় তখন একটা বাজতে মিনিট পাঁচেক বাকি। শিবু (শিবসাগর সিংহ) প্রাণপণ চেষ্টা করছে অঙ্কিতের মুখে মুখ লাগিয়ে সিপিআর (কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন) দেওয়ার। যাতে ও অক্সিজেনটা পায়। আর আমি চেস্ট পাম্প করছি যাতে হঠাৎ সংঘর্ষে ওর বন্ধ হয়ে যাওয়া শ্বাসটা ফিরে আসে। চোখটা উল্টে গিয়েছে তখনই। আমি আর শিবু মরিয়া। দশ সেকেন্ডের মধ্যে শ্বাসটা ফিরেও এল। কিন্তু জ্ঞানটা ফিরল না। ততক্ষণে মাঠে ঢুকে পড়েছেন ডাক্তার। অঙ্কিতের পালসটা একবার দেখলেন। তার পরেই অ্যাম্বুল্যান্স ডাকলেন ওকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তখনই অঙ্কিতকে অ্যাম্বুল্যান্সে তুলে হাসপাতালে ছুটলেন আমাদের ক্লাবের শ্যামলদা (গুপ্ত)।

তখনও জানতাম না দু’বছর আগে আমার অধিনায়কত্বে বুচিবাবুতে খেলতে যাওয়া অঙ্কিতের সঙ্গে ওটাই শেষ দেখা হয়ে যাবে!

Advertisement

শুক্রবার সকালেও আমার ঠিক পিছনে দাঁড়িয়েই যে শান্ত ছেলেটা ওয়ার্মআপ করছিল এক মনে, বাহাত্তর ঘণ্টা পেরোতেই খবর এল, ইস্টবেঙ্গল টিমে আমার সেই ছোট ভাই অঙ্কিত কেশরী আর নেই। আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে অনেক দূরে! আমাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে।

রবিবার রাতেও ঘুমোতে যাওয়ার আগে ভাবলাম, সুস্থ হয়ে ইস্টবেঙ্গল তাঁবুতে ফিরলে বলব, ‘‘অঙ্কিত আর হুটহাট ডাইভ দিস না কখনও।’’ কিন্তু সেই সুযোগ ও দিল কোথায়?

যে অঙ্কিতকে মনে থাকবে।

নিয়তি কি এ ভাবেই দেখা দেয়! না হলে মাত্র চার বলের জন্য ও সে দিন ফিল্ডিং করতে নামবেই বা কেন? নকআউটের কোয়ার্টার ফাইনালে সে দিন ভবানীপুরের বিরুদ্ধে অঙ্কিত ছিল আমাদের দ্বাদশ ব্যক্তি। দু’বার পরিবর্ত হিসেবে মাঠে নেমে ফিল্ডিং করে ফেলেছে। শেষ ওভারের (৪৫ ওভার) আগের ওভারের খেলা চলছে। তার ঠিক আগের ওভারেই অর্ণব নন্দী বল করে ড্রেসিংরুমে গিয়েছে। ওর জায়গায় নেমেছে অঙ্কিত। দাঁড়িয়েছে ডিপ কভারে। ক্রিজে ব্যাট হাতে ভবানীপুরের ঋত্বিক চট্টোপাধ্যায়। বোলার আমাদের সৌরভ মণ্ডল। সৌরভকে মারতে গিয়েই লোপ্পা ক্যাচ তুলল ঋত্বিক। লং অনে দাঁড়িয়ে দেখলাম সেই ক্যাচ ধরতে এগোচ্ছে সৌরভ, অঙ্কিত দু’জনেই। বল দ্রুত নামছে নীচে। হঠাৎ ডাইভ দল অঙ্কিত। তখনই বোধহয় সৌরভের সঙ্গে ওর সংঘর্ষ হয়ে থাকবে। একটু দূরে ছিলাম বলে ভাল করে দেখতে পাইনি। কিন্তু পরক্ষণেই দেখলাম ও পড়ে গিয়ে আর উঠছে না। লং অফ থেকে ছুটে গেল শিবু। আমিও ছুটলাম। কিন্তু আমাদের চেষ্টা কাজে লাগল কোথায়? বাংলার অনূর্ধ্ব-১৯ টিমের ক্যাপ্টেন তো আর আমাদের ড্রেসিংরুমের দরজা ঠেলে কোনওদিনই ঢুকবে না। বলবে না, ‘‘আমাকে এ বার আরও ভাল পারফর্ম্যান্স করতে হবে।’’

সেদিন বিকেলেই ম্যাচ জিতে আমরা হাসপাতালে গিয়েছিলাম। দেখা হয়নি ওর সঙ্গে। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, ওর জ্ঞান ফিরে এসেছে। শনিবারও শুনলাম ও ভাল আছে। রবিবার বিকেলেও শুনলাম অঙ্কিত নাকি ওর দাদাকে দেখতে চেয়েছে।

সোমবার সকালে আমাদের খেলা ছিল কালীঘাটের বিরুদ্ধে। ওই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠেই। মাঠে গিয়েই শুনলাম অঙ্কিত কিছুক্ষণ আগেই আমাদের ছেড়ে চিরকালের মতো চলে গিয়েছে এক অজানা গন্তব্যে। যেখান থেকে আর কোনও দিনই ফেরা যায় না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement