আনন্দবাজার এক্সক্লুসিভ

ডন এই বিশ্বকাপ খেললেও হায়েস্ট স্কোরার হত

দু’দিন পরপর ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল বলে দেখা করা যায়নি। এত ঘন-ঘন ডাক্তার কেন, জিজ্ঞেস করায় তাঁর স্ত্রীর পাল্টা প্রশ্ন, তিরানব্বই বছর বয়সে রোজ ডক্টর দেখানোর কথা নয় কি? বিশ্বের এ হেন সবচেয়ে বর্ষীয়ান ক্রিকেটারকে পাওয়া গেল সিডনি থেকে প্রায় আশি কিলোমিটার উত্তরে, গসফিল্ডের রিটায়ারমেন্ট ভিলেজে। টিভিতে নিউজ দিব্যি দেখেন। আগন্তুকের জুতোর ফিতে সামান্য খুলে গেলে দেখিয়ে দেন, এখনও এত ভাল চোখ। কিন্তু বিশ্বকাপ ক্রিকেট নিয়ে কোনও আগ্রহ নেই। বিষ্যুদবারের ভারত-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ নিয়েও না। তিনি আর্থার রবার্ট মরিস অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান হিসেবে গণ্য হন। ব্র্যাডম্যান নিজের শতাব্দী সেরা দলে গাওস্কর-হাটন-হবসকে না নিয়ে ওপেনার হিসেবে মরিসকে নিয়েছেন। তিনি নিজেও ব্র্যাডম্যান-মগ্ন। কথা বললে মনে হবে তাঁর বিশ্বকাপ নেই তো কী, ব্র্যাডম্যান তো আছেন। এ হেন ক্রিকেটারের ডেরায় দুপুর-দুপুর এবিপি উপস্থিত।

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

সিডনি শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৫ ০৩:২১
Share:

লাইব্রেরি রুমে নিজের ক্রিকেট-স্মারকের সঙ্গে আর্থার মরিস। (ডান দিকে) স্ত্রী জুডিথের সঙ্গে। ছবি-গৌতম ভট্টাচার্য ও পিনাকী চট্টোপাধ্যায়।

প্রশ্ন: বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বয়সী জীবিত ক্রিকেটার আপনি। ব্র্যাডম্যানের সঙ্গে চুটিয়ে ক্রিকেট খেলেছেন। তা হলে মিডিয়ায় আপনাকে নিয়ে উচ্চবাচ্য নেই কেন?

Advertisement

মরিস: কারণ অনেকেরই ধারণা আমি মারা গেছি (হাসি)। হ্যাঁ এমনিতেও অবশ্য মারা যাওয়ার বয়স আমার বহু কাল হয়ে গিয়েছে। কাজেই ওদের ভাবনায় অস্বাভাবিকত্ব নেই। তবে সে দিন যখন দেখলাম চ্যানেল নাইন ব্র্যাডম্যানের আটচল্লিশের টিমের একমাত্র জীবিত সদস্য হিসেবে নিল হার্ভির নাম দিয়ে ওকে ইন্টারভিউ করছে, তখন একটু দুঃখ হয়েছিল। মনে হল এর আগে ফক্স স্পোর্টস আমাকে মেরেছিল। এ বার কিনা চ্যানেল নাইনও মেরে ফেলল (হাসি)।

Advertisement

প্র: সেই আটচল্লিশের সফরে তো আপনিই ছিলেন সফলতম ব্যাটসম্যান। বোধহয় তিনটে সেঞ্চুরি করেছিলেন। সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ছিল হেডিংলেতে আপনাদের ৪০৪ রান তাড়া করে জেতা।

মরিস: কোন ম্যাচটা? কানে সব সময় ভাল শুনতে পাই না।

প্র: হেডিংলের সেই রান তাড়া করা!

মরিস: ওটা শুরুতে রান তাড়া উদ্দেশ্য ছিল না। কিছু দূর এগনোর পর ডন হঠাৎ বলেন, চলো তাড়াই করা যাক। ইংল্যান্ড স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি এমন কিছু ঘটতে পারে।

প্র: : ডন যখন ওভালে শেষ ইনিংস খেলছেন, তখনও তো উল্টো দিকে আপনি। আপনি সেঞ্চুরি করলেন আর উনি জিরো রানে হোলিসের বলে বোল্ড।

মরিস: ভোলা যায় না এখনও সেই দৃশ্যগুলো। হোলিসের বলটা খুব ভাল পড়েছিল। ডন অবাক হয়ে দেখলেন, বোল্ড। উনি যখন ব্যাট বগলে নিয়ে চলে যাচ্ছেন, ইয়ার্ডলের বোলারকে জড়িয়ে কী চিৎকার। আমি তখন অবাক হয়ে ভাবছি আরে তুই ইংল্যান্ড ক্যাপ্টেনই তো। একটু আগে ডনকে ‘হি ইজ আ গুড ফেলো’ বলে গান গাইলি আর এখন এত চেঁচাচ্ছিস?

প্র: প্যাভিলিয়নে আপনি ফেরার পর ব্র্যাডম্যান আর কিছু বলেননি বলটা কেমন পড়েছিল এ সব নিয়ে?

মরিস: নাহ। ওই বলটা নিয়ে আর কথা বলতে ওঁকে শুনিনি।

প্র: ব্র্যাডম্যান তো শোনা যায় আপনাকে খুব ভালবাসতেন। আপনি টিমে ঢোকার দু’বছরের মধ্যে ভাইস ক্যাপ্টেন হয়ে যান। আটচল্লিশের সফরে আপনি নির্বাচকও ছিলেন।

মরিস: হ্যাঁ আমার সঙ্গে ওঁর খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। ডন মানুষটা ভাল ছিলেন। খুব শাই।

প্র: কিন্তু মিলার বা ফিঙ্গলটন তো ওঁকে যা-তা গালাগাল করে গিয়েছেন।

মরিস: আমার মনে হয় ওরা কেউ ডনকে ভাল করে চিনত না। উনি খেলার বাইরে টিমের সঙ্গে মিশতেন না। অন্য ক্যাপ্টেনরা যেমন খেলার পর বারে গিয়ে সবার সঙ্গে বসত, উনি তা না করে নিজের ঘরে বসে ফ্যানদের চিঠির উত্তর দিতেন। আমাকে এক বার ড্রিঙ্ক করতে দেখে বলেছিলেন, কী যে ছাইপাঁশ সব খেয়ে আরাম পাও বুঝি না।

প্র: একটা কথা বলুন। এই যে বলা হয় ব্র্যাডম্যান সবার চেয়ে ভাল ছিলেন। অ্যাভারেজ দেখলে বোঝা যায় ভাল ছিলেন। কিন্তু কোন জিনিসটা তাঁর ছিল যা আর বাকিদের নেই?

মরিস: ভাল প্রশ্ন। এটা নিয়ে আমিও অনেক ভেবেছি। ডনের পর যাদের আমি খুব হাইলি রেট করি, যেমন সোবার্স, সচিন, ভিভ রিচার্ডস, উইক্স, এরা সবাই কাছাকাছি। কিন্তু ডনের সঙ্গে একটা জায়গায় গিয়ে সবার তফাত হয়ে যায়। তা হল, ডন অসম্ভব ফ্রেশ থাকতে পারতেন। দিনের প্রথম বলে যা, তিনশো বলেও তাই। এই ফ্রেশ থাকতে পারাটা ওঁকে সব সময় ঠিক পজিশনে আসতে সাহায্য করত। আর প্রত্যেকটা বলকে একই রকম মন দিয়ে দেখতে পারতেন। এই জায়গাটাতেই উনি আলাদা।

প্র: ব্র্যাডম্যানের এত প্রশংসা সচরাচর ওঁর সতীর্থদের মুখে শোনা যায়নি।

মরিস: সে কী করা যাবে? তাতে তো আর ব্র্যাডম্যানের রেকর্ডটা মিথ্যে হয়ে যায়নি। ওটা একটা সৌধ হিসেবে চিরকাল থেকে যাবে। ওঁর স্মৃতিশক্তিটাও আলাদা ছিল। গড়পড়তার চেয়ে অনেক বেশি।

প্র: তাই?

মরিস: হ্যাঁ। একবার আমার বাবার স্পোর্টস শপে উনি ব্যাট দেখতে এসেছিলেন। আমার তখন মাত্র দশ বছর বয়স। আমি বলেছিলাম, হাউ ডু ইউ ডু মিস্টার ব্র্যাডম্যান? উনি অবাক হয়ে যান। এর পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে আমি যখন টিমে ঢুকি, উনি আলাপ করতে এসে হেসে বলেছিলেন, হাউ ডু ইউ ডু মিস্টার মরিস?

প্র: এত ভাল মনে রাখার ক্ষমতা?

মরিস: ইয়েস এতটাই ভাল।

প্র: শোনা যায় নেভিল কার্ডাস আপনার টেকনিক নিয়ে তীব্র সমালোচনার পর আপনি ব্র্যাডম্যানের কাছে অস্থির হয়ে গিয়েছিলেন।

মরিস: সত্যি কথা, গেছিলাম। একটু মন ভেঙে গেছিল। ডন বললেন পাত্তা দিও না।

প্র: কিন্তু ব্র্যাডম্যানের সঙ্গে তো কার্ডাসের খুব ভাল সম্পর্ক ছিল?

মরিস: সেটা ছিল। আমাকে বলেছিলেন কী লিখেছে কান দিও না। এ হল অকৃত্রিম মিডিয়া খেলা বোঝে না।

প্র: তাই বুঝি?

মরিস: হ্যাঁ হ্যাঁ। ডন বেশি কথা বলতেন না। কিন্তু এই ওয়ান লাইনারগুলো অনবদ্য।

প্র: এই বিশ্বকাপে যেমন বড়-বড় রান হচ্ছে টিভিতে দেখেছেন?

মরিস: আমি ওয়ান ডে ক্রিকেট নিয়ে কোনও দিনই বিশেষ আগ্রহী নই। ওটাকে বিরাট চ্যালেঞ্জ বলেই মনে করি না। মাঝেমধ্যে টিভি খুললে হয়তো নিউজে এক ঝলক দেখলাম, এই অবধি। বা অস্ট্রেলিয়ার খেলায় একটু চোখ গেল।

প্র: বিশ্বকাপ কোনও ইন্টারেস্ট করছে না?

মরিস: না করার কথাও ছিল না।

প্র: এ বার যে এমন রান করছে এক-একজন ব্যাটসম্যান, তাতে মনে হচ্ছে না ব্র্যাডম্যানোচিত অভিব্যক্তিটাই চ্যালেঞ্জের মুখে?

মরিস: কী বলছেন? ডন এই সব আধুনিক ব্যাট কি পেয়েছিলেন? উনি যে ব্যাটে দুশো-তিনশো করেছেন, এরা তাতে কুড়িও তুলতে পারবে কি না সন্দেহ।

প্র: কিন্তু এখন তো প্লেয়াররা পঞ্চাশ ওভারে আড়াইশো করে ফেলছে। এই তো নিউজিল্যান্ডের গাপ্টিল কালকেই আড়াইশোর কাছাকাছি রান করেছেন।

মরিস: জানেন কি না জানি না ১৯৩১ সালে একটা ম্যাচে ডন ২২ বলে সেঞ্চুরি করেছিলেন। ওটা হয়তো স্বীকৃত ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট ম্যাচ ছিল না। কিন্তু একটা ম্যাচ তো ছিল! ২২ বলে সেঞ্চুরি ভাবতে পারেন? আজ যদি সেই লোকটার হাতে এ সব মডার্ন ব্যাট থাকত?

প্র: আপনি বলছেন এ বারের বিশ্বকাপে খেললেও ডনকে ছোঁয়া যেত না?

মরিস: কোনও চান্সই নেই। বিশ্বকাপের সেরা ব্যাটসম্যান চোখ বুজে হতেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement