প্রশিক্ষণ: বাংলার প্রাক্তন অফস্পিনার সৌরাশিস লাহিড়ী ভেজা বলে অফস্পিন ও লেগস্পিনের গ্রিপ ধরার পরামর্শ দিচ্ছেন। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
সারা ভারতে বছরের শেষের দিকে ওয়ান ডে ম্যাচ মানেই দেখা যাবে সেই দৃশ্য। বার বার মাটিতে হাত ঘষছেন স্পিনাররা। রুমাল দিয়ে বল মুছে চলেছেন। শিশিরে এমনঅ ভিজে যাচ্ছে বল যে, গ্রিপ করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছেন। আর পরে ব্যাট করা দল সেই সুযোগ নিয়ে হেলায় ম্যাচ জিতে বেরিয়ে যাচ্ছে। কেন অসুবিধার মুখে পড়েন স্পিনাররা? কী ভাবে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারেন কুলদীপ যাদব, যুজবেন্দ্র চহালরা। আনন্দবাজারের জন্য বাংলার প্রাক্তন অফস্পিনার সৌরাশিস লাহিড়ী ভেজা বল হাতে নিয়ে বিশ্লেষণ করতে নামলেন।
অফস্পিনারের ক্ষেত্রে সমস্যা কী: আঙুলের সাহায্যে বল ঘোরাতে হয় অফস্পিনারদের। যাঁদের বলা হয় ‘ফিঙ্গার স্পিনার’। এই মুহূর্তে ভারতীয় ওয়ান ডে দলে না থাকলেও আর অশ্বিন এই ঘরানার স্পিনার। বলের সিমকে তর্জনী ও মধ্যমার সাহায্যে ঘোরান এঁরা। বল শুকনো থাকলে এই পদ্ধতিতে কোনও সমস্যা হয় না। আরও গুরুত্বপূর্ণ বলের ‘রিলিজ পয়েন্ট’। কোচেরা বলেন, বল ছাড়ার সময় হাত ও পায়ের আঙুল যেন এক লাইনে থাকে। ঠিক ঘড়ির কাঁটায় ১১:৫৫ বাজার মতো। কিন্তু বল যদি ভেজা থাকে, সে ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি মেনে বল করা কঠিন। কারণ, ‘রিলিজ পয়েন্টের’ আগেই হাত থেকে বল পিছলে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আর তা হলে বল স্পিনও করবে না, নির্ধারিত জায়গাতেও পড়বে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ব্যাটসম্যানের পায়ের কাছে বল গিয়ে পড়ছে। ব্যাটসম্যানও মনের সুখে সেই বলগুলো পিটিয়ে যাবে।
সমাধান: অফস্পিনার তখন চেষ্টা করে রক্ষণাত্মক বোলিং করার। কারণ সব বলই তখন সোজা হয়। টার্ন বন্ধ হয়ে যাবে বলটা শিশিরে ভিজে যাওয়ার ফলে। ব্যাটসম্যানরা চেষ্টা করতে থাকে লং-অফ অথবা লং-অনের উপর দিয়ে মারতে। ভেজা বলে উইকেটের সোজাসুজি বোলিং করতে হবে অফস্পিনারদের। কারণ সোজা বলকে সুইপ অথবা স্লগ-সুইপ মারতে গেলেই এলবিডব্লিউ অথবা বোল্ড হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বছরের শেষের দিকে শীত আসার সময় থেকেই এই ধরনের পরিস্থিতি ভারতের যে কোনও মাঠে যে কোনও ম্যাচে হতে পারে। ইডেনে যে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ আসছে ৪ নভেম্বর, এখনই বলে দেওয়া যায়, সেই ম্যাচে শিশিরে মাঠ পুরো ভিজে যাবে। প্রত্যেক স্পিনারেরই তাই বল ভিজিয়ে অনুশীলন করে তৈরি থাকা উচিত। আর ম্যাচ চলাকালীন কোমরে রাখা উচিত তোয়ালে। নিয়ম করে প্রত্যেক বলের পরে বল মুছে পরের বল করতে যাওয়া উচিত যে কোনও স্পিনারের। আরও একটি উপায় দেখা যায় আর অশ্বিনের বোলিংয়ে। সিম সোজা ধরে আউটসুইংয়ের মতো বল করেন অশ্বিন। যা ডান হাতি ব্যাটসম্যানের ক্ষেত্রে ভেতরে আসার বদলে বাইরের দিকে চলে যায়। এটা কিন্তু শিশির পড়লে দারুণ অস্ত্র।
লেগস্পিনারের ক্ষেত্রে সমস্যা কী: ক্রিকেটের সব চেয়ে কঠিন বোলিংয়ের নাম লেগস্পিন। কব্জির সাহায্যে বল ঘোরাতে হয় বলে তাঁদের বলা হয় ‘রিস্ট স্পিনার’। বল ভেজা থাকলে অফস্পিনারদের থেকেও কঠিন অবস্থা হয় যুজবেন্দ্র চহালের মতো বোলারদের। ঘোরানোর চেষ্টা করলেও বল ঘুরবে না। আপ্রাণ চেষ্টা করলেও হাত থেকে পিছলে সেই ব্যাটসম্যানের পায়ের সামনে গিয়ে পড়বে বল। যা স্টেপ আউট করলেই ফুলটস করে নিতে পারবেন ব্যাটসম্যানরা। অনভিজ্ঞ লেগস্পিনারদের তো কোমরের উপরও ফুলটস বল করতে দেখা যায়।
সমাধান: চহালকে দেখা যায় ভেজা বল থাকলে তিনি বেশি ঘোরানোর চেষ্টা করেন না। বলকে ‘স্লাইড’ করান। ‘স্লাইডার’-এর অর্থ হল, একই গ্রিপে কনিষ্ঠ আঙুলের সাহায্যে বল সোজা ফেলা। সে ক্ষেত্রে কব্জির বেশি প্রয়োজন পড়ে না। তাই বল পড়ে সোজা যায়। ‘ফ্লিপার’ও শিশিরে বল করার জন্য ভাল অস্ত্র। সাধারণ লেগস্পিনের চেয়ে ফ্লিপার অনেক জোরে ছাড়া হয়। বল পিচে পড়ার পরে মিডিয়াম পেসের মতো ব্যাটসম্যানের দিকে ধেয়ে আসে। অনিল কুম্বলের বোলিং দেখলে ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হবে। কিন্তু গুগলি করতে সব চেয়ে সমস্যা হয় ভিজে বলে। কারণ, হাতের পিছন দিয়ে তালু দেখিয়ে লেগস্পিনের মতো একই অ্যাকশনে বল ছাড়তে হয়। অনেক কঠিন শিল্প, অনেক বেশি নিয়ন্ত্রণ লাগে। ভেজা বলে গুগলি করতে গেলে ‘ফ্লাইট’ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না। খেলার আগে অনেক সময় পেয়ে যান ব্যাটসম্যানেরা।
চায়নাম্যানের ক্ষেত্রে সমস্যা কী: ডান হাতি লেগস্পিনারের ক্ষেত্রে যে সমস্যা দেখা যায়, বাঁ হাতি চায়নাম্যানের ক্ষেত্রেও সমস্যা একই। পার্থক্য একটাই, ডান হাত ও বাঁ হাতের। বাঁ হাতি লেগস্পিনারদের ক্রিকেটীয় ভাষায় বলা হয় চায়নাম্যান। তবে এর সমাধান পদ্ধতিতে পার্থক্য রয়েছে।
সমাধান: আবার ফিরে আসা যাক ‘রিলিজ পয়েন্টে’। বল ছাড়ার সময় কানের পাশ দিয়ে হাত আনতে হয় প্রত্যেক বোলারকে। হাত যখন কানের ঠিক পাশে চলে আসে, তখনই ছাড়তে হয় বল। কিন্তু বল ভিজে থাকলে সহজে তা করা যায় না। তখনই বলের ফ্লাইটে বৈচিত্র আনতে হয় তাঁদের। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে গত ম্যাচে কুলদীপ যাদব বল ঘোরানোর চেষ্টা করলেও সে রকম ঘুরছিল না। তখন ফ্লাইটে বৈচিত্র এনে দেখা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে বল সোজা হলেও ব্যাটসম্যানরা টার্নের জন্য খেলতে গিয়ে পরাস্ত হতে পারে। পাশাপাশি, তোয়ালে ও শুকনো মাটির ব্যবহার জানা উচিত লেগস্পিনার ও চায়নাম্যানদের। মাঠে শিশির তো সব জায়গাতেই পড়ে। কিন্তু ব্যাটসম্যানের স্টান্স নেওয়া জায়গায় হাত দিলে শুকনো মাটি পাওয়া যায়। সেটা হাতে এবং বলে লাগিয়ে বোলিং করলেও শিশির থেকে কিছুটা রক্ষা পাওয়া সম্ভব।