প্রতিপক্ষের চোখে: পঞ্চপাণ্ডবের সেরা কিন্তু আমেদ খানই

মোহনবাগান রত্ন। প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখেছেন ইস্টবেঙ্গলের সেই বিখ্যাত পঞ্চপাণ্ডবকে। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা? লিখছেন চুনী গোস্বামী...

Advertisement

চুনী গোস্বামী

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৯ ২০:১০
Share:

বিরল: দু’দলের দুই সেরা যখন একই ফ্রেমে। মোহনবাগানের চুনী গোস্বামী ও ইস্টবেঙ্গলের আমেদ খান। ফাইল চিত্র

দক্ষিণ কলকাতায় আমাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল একটা গাড়ি। সেটা ১৯৫৬ সালের এক সকাল। আর সেই গাড়ি থেকে নেমে আমাদের বাড়িতে ঢুকলেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে গৌরবের অধ্যায় রচনার অন্যতম রূপকার জ্যোতিষচন্দ্র গুহ।

Advertisement

সে দিন সকালে জ্যোতিষবাবু এসেছিলেন আমাকে ইস্টবেঙ্গলে খেলানোর প্রস্তাব নিয়ে। কারণ তিনি জানতেন আমার বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা সব কলকাতায় হলেও আমার জন্ম ওপার বাংলায়। আমাদের আদি বাড়ি ছিল পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার যশোদল গ্রামে। আমার বাবা প্রমথনাথ গোস্বামী যখন পরিবার নিয়ে কলকাতায় চলে এলেন, তখন আমার চার বছর বয়স। ।

ময়দানের সচল বনস্পতি জ্যোতিষদাকে বাবা আদর-আপ্যায়ন করে ঘরে বসালেন। কিছুক্ষণ পরে জ্যোতিষদা বাবাকে প্রস্তাব দিলে তিনি সরাসরি বলে দেন, ‘‘ওটা চুনী আর বলাইবাবু (আমার ফুটবলার জীবনের পথপ্রদর্শক প্রয়াত বলাইদাস চট্টোপাধ্যায়) জানেন। আমি কিছু জানি না।’’ এ বার ইস্টবেঙ্গলের তৎকালীন সর্বময় কর্তা আমাকে ডাকলেন। ময়দানের সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রীড়া প্রশাসক এ বার ঠিক মোক্ষম জায়গায় প্রশ্ন করলেন আমাকে। বললেন, ‘‘মেলবোর্ন অলিম্পিক্সের জন্য ভারতীয় ফুটবল দল গড়া হয়েছে। তাতে তোমাকে দেখতে না পেয়ে আমার খারাপ লেগেছে। তোমার এই দলে থাকা উচিত ছিল। তোমার ক্লাব তো বিষয়টা নিয়ে সে রকম কিছু পদক্ষেপ করল না!’’

Advertisement

আরও পড়ুন:আরও আগে না-খেলার আক্ষেপ থেকেই যাবে

ইস্টবেঙ্গলের তৎকালীন সর্বময় কর্তার কথা শুনে প্রথমে বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে দিই, ‘‘হয়তো আমি যোগ্য নই। ক্লাব কী করবে? আমি মোহনবাগান ছাড়ব না।’’

কিন্তু এর পরে জ্যোতিষবাবু যে কথা বলেছিলেন, তাতে ইস্টবেঙ্গল ও তার তৎকালীন শীর্ষকর্তার সম্পর্কে শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গিয়েছিল। আমাকে পাবেন না বুঝতে পেরে তিনি বলেছিলেন, ‘‘যদি মোহনবাগানে খেলার সংকল্পেই অটুট থাকো, তা হলে আর তোমাকে অনুরোধ করব না। তবে সংকল্পে অটল থাকা খুবই শক্ত কাজ চুনী। যদি পারো, তা হলে, আমি আজ আশীর্বাদ করছি, তুমি জীবনে আরও বড় খেলোয়াড় হবে।’’

জ্যোতিষবাবু আর কোনও দিন আমাকে ইস্টবেঙ্গলে টানার চেষ্টা করেননি। কেউ চেষ্টা করলে, বাধা দিয়েছেন। চিরকাল এত স্নেহ করেছেন, যেন আমি তাঁর ক্লাবেরই।

ইস্টবেঙ্গল ক্লাব মানে আমার কাছে একটা প্রতিষ্ঠান। সব সময়ে শ্রদ্ধাশীল থেকেছি এই ক্লাব ও তার প্রশাসক, ফুটবলারদের উপরে। আমার মতে, মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল ভারতীয় ফুটবলে একই বৃন্তের দু’টি ফুল।

১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে ও-পার বাংলা থেকে দলে দলে ছিন্নমূল মানুষ আসতে শুরু করে এ-পার বাংলায়। সেই মানুষদের প্রতিনিধি হল ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। মোহনবাগান ছিল এ-পার বাংলার মানুষের আবেগ। ধর্মীয় কারণে মহমেডান সারা ভারতের সেরা মুসলিম ফুটবলারদের পেত। তাই ইস্টবেঙ্গলের তৎকালীন সর্বময় কর্তা জ্যোতিষবাবু ওই সময়েই বুঝে গিয়েছিলেন, তাঁর ক্লাবের অনেক আগে পথ চলা শুরু মোহনবাগান ও মহমেডানের সঙ্গে পাল্লা দিতে গেলে দরকার ভিনরাজ্যের খেলোয়াড়দের। আর জ্যোতিষবাবুর এই প্রয়াসেই ভারতীয় ফুটবলে আত্মপ্রকাশ করে সেই পাঁচ ফরোয়ার্ড। যাঁদের গোটা দেশ জানে ‘পঞ্চপাণ্ডব’ নামে।

সালে, আমেদ খান, ধনরাজ, বেঙ্কটেশ ও আপ্পা রাও। এই পাঁচ দুরন্ত ফরোয়ার্ডকে নিয়েই তৈরি হল কিংবদন্তি এই পঞ্চপাণ্ডবের জুটি। আর আমার মতে, এই পঞ্চপাণ্ডবের দুই শ্রেষ্ঠ পাণ্ডব হলেন আমেদ খান ও বেঙ্কটেশ। প্রথম জনের সঙ্গে ক্লাব ফুটবলে কোনও দিন একসঙ্গে খেলার সৌভাগ্য হয়নি। বাংলা দলের হয়ে যদিও সন্তোষ ট্রফি খেলেছি। দ্বিতীয় জন পদ্মোত্তম বেঙ্কটেশ। যাঁর সঙ্গে আমি মোহনবাগানে খেলেছি।

কতটা ভয়ঙ্কর ছিল এই পঞ্চপাণ্ডব? তার একটা ছোট্ট পরিসংখ্যান দিই। ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫৩— এই পাঁচ বছরে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ইস্টবেঙ্গল গোল করেছিল সাড়ে তিনশোর উপরে। যার মধ্যে আড়াইশোর বেশি গোল ছিল এই পঞ্চপাণ্ডবের।

আর যে দলের পাঁচ ফরোয়ার্ড এ রকম গোলের খিদে নিয়ে মাঠে নামেন, তাঁদের ক্লাবে তো ট্রফির বন্যা ডাকবে। আর হয়েছিলও তাই।

এঁদের মধ্যে প্রথম কলকাতায় আসেন আপ্পারাও। পুরো নাম মামুদিপল্লী আপ্পারাও। অন্ধ্রপ্রদেশের ফুটবলার। ১৯৩৯ সালে আসেন কালীঘাট ক্লাবে। দু’বছর সেখানে তাঁর খেলা দেখার পরে জ্যোতিষবাবু তাঁকে ১৯৪১ সালে নিয়ে আসেন ইস্টবেঙ্গলে। খেলতেন রাইট ইনে। চার বছর পরে ১৯৪৫ সালে কেরল থেকে ইস্টবেঙ্গলে এলেন পি বি এ সালে। এ প্রসঙ্গে বলে নিই। সালের পুরো নামটা ছিল ছিল রেলগাড়ির মতো দীর্ঘ। পুথানপরমাভিল বাবাখান আবদুল সালে। খেলতেন লেফ্ট আউটে।

১৯৪৮ সালে কর্নাটক থেকে এলেন বেঙ্কটেশ। খেলতেন রাইট আউটে। ভারতীয় ফুটবলে উইং দিয়ে ঢুকে কাট করে ভিতরে ঢুকে আসা প্রথম চালু করেন তিনি। এর ঠিক এক বছর পরে ১৯৪৯ সালে এলেন ধনরাজ আর আমেদ খান। ধনরাজ খেলতেন সেন্টার ফরোয়ার্ডে। আর আমেদ খান লেফ্ট ইনে। ১৯৪৮ সালের লন্ডন অলিম্পিক্সে খেলতে গিয়েছিল ভারতীয় ফুটবল দল। সেই দলের প্রস্তুতি শিবির হয়েছিল শিলংয়ে। সেই শিবিরের দায়িত্বে ছিলেন জ্যোতিষবাবু। তাঁর মতো জহুরি জহর চিনতে ভুল করেননি। তিনিই এই দুই ফুটবলারকে লাল-হলুদ জার্সি পরিয়ে শুরু করেন এক ঐতিহাসিক যুগের।

ইস্টবেঙ্গলের এই পঞ্চপাণ্ডবের জমানায় আমি কোনও দিন তাঁদের বিরুদ্ধে খেলিনি। কারণ, মোহনবাগান জার্সি গায়ে আমি প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমেছিলাম ১৯৫৪ সালের ২৯ মে। তাই পরবর্তী কালে পঞ্চপাণ্ডবের জুটি ভেঙে যাওয়ার পরে আমেদ খানের বিপক্ষে বা সালের বিপক্ষে খেলেছি। আর ধনরাজ আর ভেঙ্কটেশের সঙ্গে খেলেছি মোহনবাগান জার্সি গায়ে।

তবে আমার পূজনীয় দাদা কাম বন্ধু ফুটবলার মান্নাদার (প্রয়াত শৈলেন মান্না) কাছ থেকে এই পঞ্চপাণ্ডবের ব্যাপারে অনেক গল্প শুনেছি।

এই পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে সেরা পাণ্ডব যে ছিলেন আমেদ খান। মান্নাদাও বলতেন, ‘‘আমেদকে আটকাতে গিয়েই আমাকে বেশি বিব্রত হতে হত। কখন যে আমাদের রক্ষণকে ফাঁকি দিয়ে গোল করে যাবে তা বোঝা ছিল দুঃসাধ্য।’’

এমনিতেই আমেদ খানের বলের উপর দখল ছিল অনবদ্য। আর বাড়াতে পারতেন ঠিকানা লেখা পাস। নিখুঁত থ্রু বা ওয়াল পাস খেলায় ছিলেন মাস্টার। এই কারণেই সে সময়ে অনেক ম্যাচেই ইস্টবেঙ্গল জিততে থাকলে শেষ পাঁচ-দশ মিনিট দেখতাম, ইস্টবেঙ্গল ফুটবলাররা বল পেলেই আমেদকে বাড়াচ্ছেন। আর আমেদ সেই বল নিজের পায়ে রেখে, ড্রিবল করে সময়টা নষ্ট করে দিতেন। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে কী ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা ছিল আমেদের খেলায়। তবে শুটিংটা সে রকম ভাল না থাকায় গোল করার চেয়ে গোল করিয়ে আনন্দ পেতেন আমেদ।

সে সময়ের ২-৩-৫ ছকে আমেদ যখন আক্রমণে যেতেন মনে হত, ইস্টবেঙ্গল ছয় জনে আক্রমণ করছে। আবার পিছিয়ে এসে যখন রক্ষণকে সাহায্য করতেন, তখন মনে হত, চার হাফে খেলছে ইস্টবেঙ্গল। ইলাস্টিকের মতো মাঝমাঠ থেকে আক্রমণে নিজেকে বাড়িয়ে নিতে পারতেন আমেদ খান। আর ছিল ধুরন্ধর বুদ্ধি। মাঠের বাইরে বেশি লোকের সঙ্গে মিশতেন না। কম কথা বলতেন। তাস ও সিগারেট ছিল ওর নেশা। সিনেমা দেখতেও খুব ভালবাসতেন।

আমেদ খান কতটা চতুর ছিলেন সে প্রসঙ্গে মান্নাদার কাছ থেকে শোনা একটা ঘটনার কথা বলি। ১৯৪৯ সাল। আইএফএ শিল্ড ফাইনালে মুখোমুখি ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগান। খেলা শুরু হতেই আমেদ খান খোঁচা মারলেন অনিল দে-র পায়ে। মার খেয়ে মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল অনিল দে-র। তিনি গোটা ম্যাচ আমেদকে মারার জন্যই মনোনিবেশ করে ফেললেন। আর আমেদ তখন ইচ্ছে করেই মাঠের নানা জায়গায় সরে যেতে থাকলেন। রাইট হাফ অনিল দে সেই ফাঁদে পা দিয়ে সরে যাওয়ায় বাঁ দিক থেকে উঠে এসে সালে গোল করে ম্যাচ জেতান ইস্টবেঙ্গলকে।

মান্নাদার কথায়, ‘‘আমেদ আমার সামনে হিন্দিতে ধনরাজকে বলত, এই মান্নাকে মারবি না। আমার ভাল বন্ধু। কিন্তু তার পরেই কানাড়ি ভাষায় ধনরাজকে আরও কী সব বলত। বহু পরে ধনরাজের কাছ থেকে শুনেছি, ওই সময় কানাড়ি ভাষায় আমেদ বলত, ঠেলা মার। মান্নাকে ধাক্কা দিয়ে মাথা গরম করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা কর। লাভটা হবে আমাদেরই।’’

পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে আমি তাই বড় দলে খেলার স্বপ্ন নিয়ে মন দিয়ে আমেদ খানকে দেখতাম। চাইতাম, ওঁর মতো প্রতিপক্ষকে সম্মোহিত করে বল নিয়ে এগিয়ে যেতে। এ প্রসঙ্গে ১৯৪৯ সালে কলকাতায় আসা সুইডেনের হেলসিংবর্গ দলের বিরুদ্ধে আমেদের খেলার কথা মনে পড়ছে। সুইডেনের দলটি তিন ব্যাকে খেলছিল। সেই দলটির বিরুদ্ধে আমেদ এমন খেলা দেখিয়েছিলেন যে বিপক্ষের কোচ উলফ লাইবার্গ আমেদকে বলেছিলেন, ‘‘ইউরোপে চলো। যে কোনও দল তোমাকে বরণ করে নেবে।’’ ওঁর খেলা দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম বলের উপর দখল রাখাই ফুটবলের বড় কথা। ওই গুণের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে ফুটবলে বড় হওয়ার চাবিকাঠি। যাঁরা আমেদের খেলা দেখেননি, তাঁরা জানেন না, কত বড় ফুটবলার ছিলেন।

১৯৫৪ সালে সুইডেনের আলমাননা ইড্রিটস ক্লাব খেলতে এসেছিল আইএফএ একাদশের বিরুদ্ধে । ম্যাচের পরে সেই ক্লাবের প্রেসিডেন্ট আমেদকে তাঁর দলের হয়ে খেলতে আমেদকে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু আমেদ ইস্টবেঙ্গল ছাড়েননি। ইস্টবেঙ্গলও কখনও ভোলেনি তাদের ইতিহাসে অন্যতম সেরা এই ফুটবলারকে। ছেলে মজিদ এক সময়ে চাকরি পায়নি বলে আশির দশকে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন আমেদ খান। সেই মজিদকে ১৯৮৫ সালে ইস্টবেঙ্গলে সই করিয়ে ব্যাঙ্কে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন ক্লাবের সে সময়ের কর্তা দীপক (পল্টু) দাস। জ্যোতিষবাবুর পরে পল্টু দাস। তারও পরে প্রয়াত স্বপন বল বা দেবব্রত সরকারেরা নিয়মিত যোগাযোগ রেখে গিয়েছে বৃদ্ধ আমেদ খানের সঙ্গে। আসলে কখনও ক্লাবের সঙ্গে যোগসূত্র আলগা হতে দেননি আমেদ খান। খেলোয়াড় জীবনের শেষ বছরে ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে গিয়েছিলেন মহমেডানে। কিন্তু ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে ম্যাচে পেনাল্টি বাইরে মেরেছিলেন। তার পরেই অবসর নিয়ে ফেলেন ফুটবল থেকে।

১৯৪৮ সালের লন্ডন অলিম্পিক্সে দু’টি পেনাল্টি নষ্ট করে ফ্রান্সের কাছে ১-২ গোলে হারে ভারত। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রশংসিত হয়েছিল আমেদের ড্রিবল ও পাস দেওয়ার ক্ষমতা। অলিম্পিক্স থেকে ফেরার পথে ভারতীয় দল বেশ কিছু প্রদর্শনী ম্যাচ খেলেছিল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দল ছিল আয়াখ্স আমস্টারডাম। সেই ম্যাচে গোল করে ভারতকে জিতিয়েছিলেন আমেদ।

পঞ্চপাণ্ডবের দ্বিতীয় প্রধান খেলোয়াড় ছিলেন আমার ভেঙ্কটেশদা। যেমন দুর্দান্ত ফুটবলার, তেমনই ছিলেন মজার মানুষ। সুন্দর ব্যবহারের জন্য জুনিয়র ফুটবলারদের কাছে ছিলেন কাছের মানুষ। মান্নাদারা মজা করে বলতেন, ‘‘আমরা সবাই হলাম পদ্ম। আর ভেঙ্কটেশ আমাদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম মানে ভাল মানুষ। তাই ওর নামটা পদ্মোত্তম ভেঙ্কটেশ।’’

ভেঙ্কটেশদার গতি, বুদ্ধিদীপ্ত ফুটবল আর গোলার মতো শট বিপক্ষের ত্রাস ছিল। ডান দিক থেকে তীব্র গতিতে কাট করে ভিতরে ঢুকে আসা ছিল দু’চোখ ভরে দেখার মতো ব্যাপার। রাইট আউটের ফুটবলার কিন্তু দুই প্রধানেই ভেঙ্কটেশদা বেশি গোল করেছেন বাঁ পায়ে। হরিণের মতো ছুটে বিপক্ষ রক্ষণকে টালমাটাল করে দিতেন। ডান দিক থেকে কাট করে ভিতরের দিকে ঢুকে এসে পেনাল্টি বক্সের বাইরে থেকে শট নিতেন। ভেঙ্কটেশদার পায়ে সাত-আট রকমের ডজ ছিল। তাঁর সোয়ার্ভ করা শট কী ভাবে বাঁক খাবে, তা গোলকিপাররা অনেক সময় বুঝতে পারতেন না।

ফুটবলই ছিল ভেঙ্কটেশের ধ্যান-জ্ঞান। মাত্র ৫১ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। ওঁর রসবোধ ছিল তুমুল। শেষের দিকে অনুশীলনে ৫০-৫০ বল বাড়ালে তেড়ে আসতেন। তার পরে বলতেন, ‘‘দেখছিস না আমার একটা ফুটবলের মতো ভুঁড়ি হয়েছে। বেশি জ্বালাস না।’’ বলেই হো হো করে হেসে জড়িয়ে ধরতেন বড়দাদার মতো। ১৯৫৫ সালে প্রথম রোভার্স কাপ জিতেছিল মোহনবাগান। সেমিফাইনালে গোল করেছিলেন ভেঙ্কটেশ। ওঁর বিশেষত্ব ছিল বল ছাড়া ও ধরা। নিজেই বলতেন, ‘‘বল ছাড়া আর বল ধরা—এটাই তো ফুটবল। তার জন্য তোরা এত চিন্তিত হয়ে পড়িস কেন। সহজ জিনিসটা সহজ ভাবে আয়ত্ত কর।’’ কত বড় ফুটবলার হলে এ ভাবে ফুটবলকে ব্যাখ্যা করতে পারেন! মোহনবাগান জার্সি গায়ে কলকাতা লিগে আমার প্রথম দিনের খেলায় ভেঙ্কটেশদাই আমাকে লেফ্ট ইন থেকে ডেকে এনে রাইট ইনে তাঁর পাশে খেলিয়েছিলেন। চামচে করে মুখে খাবার তুলে দেওয়ার মতো পায়ের সামনে বল জুগিয়েছিলেন।

লেফ্ট আউট সালে ছিল আর এক দুর্দান্ত খেলোয়াড়। প্রচণ্ড সুযোগসন্ধানী ফুটবলার। একই সঙ্গে দুরন্ত গতির অধিকারী। আর একটা চোরা গতি ছিল ১০-১২ গজের। তাই বল তাড়া করলে খুব দ্রুত বলের কাছে পৌঁছে যেতে পারতেন। এ ভাবে প্রচুর গোল করেছেন তিনি। সালের হেডটা ভাল ছিল। তাই প্রান্ত থেকে উড়ে আসা বলে মাথা ছুঁইয়ে অনেক গোল করেছেন। বক্সের সামনে বল ধরে দুর্দান্ত ভাবে বিপক্ষ রক্ষণকে কাটিয়ে দ্বিতীয় পোস্ট দিয়ে বল গোলে রাখার একটা বড় গুণ ছিল সালের।

আপ্পারাওকে আমি তার সেরা সময়ে সে ভাবে দেখিনি। রাইট ইনে বুদ্ধিদীপ্ত ফুটবল খেলতেন। আর ধনরাজ ছিলেন সেন্টার ফরোয়ার্ড। সালে, আমেদ, আপ্পারাও, ভেঙ্কটেশের বাড়ানো বল ধরে গোল করাই ছিল ওঁর কাজ। ধনরাজের সঙ্গে মোহনবাগানে খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে। সেই পঞ্চপাণ্ডবের ক্লাব ইস্টবেঙ্গলে এ বার শতবর্ষ। যে ক্লাবের বহু আলোকিত অধ্যায় রচনা করেছেন এই পাঁচ ফরোয়ার্ড। এঁদের পাশাপাশি, ক্লাব প্রশাসকদের কৃতিত্বও রয়েছে। বিশেষ করে জ্যোতিষ গুহ, ডা. নিশীথ ঘোষ, পল্টু দাস থেকে এ কালের কর্তারা। মোহনবাগানে যেমন গোষ্ঠবাবু, উমাপতি কুমার, করুণাশঙ্কর ভট্টাচার্য, থেকে ধীরেন দে থেকে এ কালের কর্তারা। এঁরা প্রত্যেকেই নিজের নিজের ক্লাবকে ভালবেসে সেবা করে এসেছেন। স্পনসর আসার আগে অর্থ দিয়ে ক্লাবের পাশেও দাঁড়িয়েছেন। একটা চুনী-বদ্রু বা পঞ্চপাণ্ডব কোনও সমর্থকভিত্তিক ক্লাবকে ১০০ বছর টেনে নিয়ে চলতে পারে না। তার জন্য প্রশাসকদেরও সমান কৃতিত্ব থাকবে।

(সাক্ষাৎকার: দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়)

আরও পড়ুন:ইস্টবেঙ্গলে খেলতেই আবার জন্মাতে চাই

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement