লিন্ড কাফে। ৫৩ মার্টিন প্লেস। সিডনি।
শুক্রবার দুপুরে এই কাফেতে ঢুকতে গিয়ে দেখি এত লম্বা লাইন যে, কাউন্টারে পৌঁছতে অন্তত দশ মিনিট লাগবে। ভেতরে দারুণ সাজানো। বোর্ডে স্পেশ্যাল ইস্টার অফার। লোকজন অবিরত ঢুকছে। কর্মীরা হাসিমুখে কাস্টমার তদারকিতে ব্যস্ত। ঠিক সামনে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের কিছু বিলবোর্ড ঝোলানো। ঢিল ছোড়া দূরত্বে সৌরভ-রাহুলদের এখানকার আস্তানা ওয়েস্ট ইন হোটেল।
দেখলে কে বলবে সাড়ে তিন মাস আগের এক অভিশপ্ত তারিখে এই জায়গাটা সন্ত্রাসের কেমন প্রতিরূপ ছিল। আর সারা পৃথিবী যে সেটা লাইভ কভারেজে দেখছিল! এখানেই প্রথম সিডনির সন্ত্রাসবাদী আক্রমণটা ঘটে। যখন মন হ্যারন মানিস নামের এক আক্রমণকারী সকালে বন্দুক দেখিয়ে কাফের দখল নেয়। ভোররাতে অস্ট্রেলীয় পুলিশ গুলি করে তাকে মারে। তার আগে অবশ্য নিরীহ দু’জনের প্রাণহানি ঘটে গিয়েছে। মহাদেশব্যাপী তোলপাড় তুলে দেওয়া লিন্ড কাফে তার পর থেকে বন্ধ ছিল। ঠিক সাত দিন হল খুলেছে। প্রত্যাবর্তনে আরও যেন সাধারণ মানুষের ভালবাসা পাচ্ছে। উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর একটা সৌধ যেন হয়ে গিয়েছে।
মার্টিন প্লেস জায়গাটা হল সিডনির দালাল স্ট্রিট। ব্যাঙ্ক আর অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে বোঝাই একটা রাস্তা। ক্রিকেট জগতে বেশি প্রসিদ্ধ ছিল এখানে হঠাত্ করে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সামনে ব্র্যাডম্যান আর লারউডের শেষ দেখা হওয়ার জন্য। এখন ট্যুরিস্ট স্পট হয়ে গিয়েছে অবশ্যই অন্য কারণে। জায়গাটা যে সিডনির ধ্বংস থেকে জীবনে প্রত্যাবর্তন।
ঠিক ওই সময় অ্যাডিলেড টেস্ট শেষ হয়েছে। ম্যাচটা ৪৮ রানে হেরে গিয়েও বিরাট কোহলির জোড়া সেঞ্চুরিতে অস্ট্রেলিয়াময় ছড়িয়ে গিয়েছিল ভারতের নতুন দলের পারফিউম। আজ লিন্ড কাফের যখন ধ্বংস থেকে ফের জীবনে প্রত্যার্পণ ঘটল, তখন সেই সিডনি নগরে কোহলির ভারত নেমে গেল জীবন থেকে ক্রিকেটীয় ধ্বংসে।
২০০৭ ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপে হারের পর যেমন একসঙ্গে না ফিরে সবাই এ দিক-ও দিক ছিটকে ফেরত গেছিলেন, আজও দেখা গেল তাই। সকাল থেকেই দফায় দফায় টিম বেরিয়ে গেল এই মহাদেশ থেকে যেখানে গত নভেম্বর থেকে তারা বাসিন্দা। সিডনি মাঠের এক কিলোমিটারের মধ্যে একটা রেস্তোরাঁ আছে। ‘মায়া দা ধাবা’। দুপুরে সেখানে খেতে গিয়ে দেখলাম চড়চড়ে রোদ্দুরেও যেন আঁধার নেমেছে। এখানে শামি-সহ বেশ কিছু ভারতীয় ক্রিকেটার খেতে আসতেন। একদিন নাকি কোহলিও এসেছিলেন। রেস্তোরাঁর মালিক অজয় রাজ ঘোষণা করে দিয়েছিলেন, ভারত জিতলে তিন হাজার ফ্যানকে নিজের খরচে খাওয়াবেন। দুপুরে একদল ভারতীয় সমর্থকের দেখা পাওয়া গেল। যাঁরা এমনই শোকার্ত যে ফাইনালের টিকিট থেকেও মেলবোর্ন পৌঁছবেন কি না ঠিক করতে পারছেন না।
ম্যাচটা প্রচণ্ড লড়াই করে হারলে হয়তো এত হা-হুতাশ হত না। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া রিমোট প্রায় সারাক্ষণ নিজের কাছে রেখে জিতেছে। এমনই একচেটিয়া খেলেছে যে তাদের বড় চার জন ম্যাচ উইনারের কোনও সাহায্য ছাড়াই এত পরাক্রম! ক্লার্ক, ম্যাক্সওয়েল, স্টার্ক, ওয়ার্নার এঁদের কারও তো ম্যাচে কোনও ভূমিকাই ছিল না। তাতেও ৯৫ রানে কিনা বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে মীমাংসা করে দেওয়া!
টিভিতে অনুষ্কা শর্মাকে কাল এক ঝলক দেখানো এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে কোহলি আউট হয়ে যাওয়ায় সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে গতকাল তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। যাঁরা এত উত্তেজিত ছিলেন, তাঁরা একেবারেই মনে রাখেননি যে এ বার সিডনি টেস্টে সেঞ্চুরির সময় অনুষ্কা মাঠেই ছিলেন এবং সেঞ্চুরি করে বিরাট তাঁর দিকে ব্যাটও তোলেন। মেলবোর্ন টেস্টে সেঞ্চুরি করেও তাই!
আসলে কেউ থাকা বা না থাকা নয়, এর কোনও ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যা থাকবে। অস্ট্রেলিয়ার মাঠে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে অনেক দিন ধরেই ওয়ান ডে-তে রান পাচ্ছেন না কোহলি। ৭ ইনিংসে তাঁর মোট রান মাত্র ৯৫। সর্বোচ্চ ৩১। গড় ১৫। কাল এবং আগেও দেখে মনে হয়েছে অস্ট্রেলিয়া জাতীয় বড় ম্যাচে দেশের সম্মানরক্ষার বাড়তি দায়িত্ব নিতে গিয়ে কোহলি স্টিফ হয়ে যাচ্ছেন। চাপে তাঁর বডি মুভমেন্ট সামান্য মন্থর হয়ে যাচ্ছে। কালও তো মিচেল জনসনের বলটা অন্তত কয়েক সেকেন্ড পরে মিট করেছেন। গড়পড়তা দিনের কোহলির কাছে ডেলিভারিটা কোনও সমস্যাই হবে না, হয় তিনি শর্ট বলটা ছাড়তেন। নয়তো ওটা লং লেগের পাশ দিয়ে উড়ে যেত। শনিবার সকালে যাঁর মেলবোর্ন পৌঁছনোর কথা সেই সচিন তেন্ডুলকর এই চাপটাই তো চব্বিশ বছর বয়েছেন। কোহলির সমস্যাটা প্রাক্তন ক্রিকেটারদেরও ধারণায় নিছকই মানসিক। টেকনিক্যাল হলে টেস্ট ক্রিকেটে ধরা পড়ত। সেটাই যদি হবে, তা হলে কোহলির কথা বলা উচিত সচিনের সঙ্গে। কারণ এক নম্বর ব্যাটসম্যানের চাপ সারা জীবন থাকবে।
তেন্ডুলকর বলতে মনে পড়ল, এ বার বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেওয়ার ভঙ্গি আর বিপক্ষে যতই মিল থাক, কোহলির ২০১৫-র ভারত কিন্তু সচিনের ২০০৩-এর ভারতকে ছুঁতে পারেনি। দলগত পারফরম্যান্স যদি ঘটমান পরিস্থিতি এবং প্রতিদ্বন্দ্বীর ওজন দিয়ে মাপতে হয়, সচিনদের দক্ষিণ আফ্রিকা পারফরম্যান্স ভারতের বিশ্বকাপ অভিযানে তিন নম্বরে থাকবে। সবার আগে তিরাশির জয়, তার পর দু’হাজার এগারো। চারে টিম ধোনির আট ম্যাচে সাত জয়!
এ দিন সিডনি ক্রিকেট স্টেডিয়াম থেকে শুরু করে বিখ্যাত সেই হিলটন হোটেল যেখানে কেরি প্যাকার তাঁর ক্রিকেট মিটিংগুলো করতেন, থেকে পিট স্ট্রিট চত্বর অনেকটা রাস্তা হেঁটে মনে হল এক রাত্তিরেই শহরে বিশ্বকাপের অদৃশ্য নিরঞ্জন ঘটে গিয়েছে। এমনিতে ভারত বিশ্বকাপ থেকে চলে যাওয়া মানে আর্জেন্তিনা-ব্রাজিল-জার্মানি একই সঙ্গে টুর্নামেন্ট থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া। সিডনি ম্যাচে সংখ্যাগরিষ্ঠ অভিমত ভারতের হারার ওপর থাকলেও সেটা সত্যি সত্যিই ঘটে গেলে কী যন্ত্রণার হয়, নীল জার্সি সমর্থকেরা এখন বুঝছেন। আর তাই পাংশু মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
রাতের ফ্লাইটে মেলবোর্ন নেমেও একদল ভারতীয়র সঙ্গে দেখা হয়ে গেল যাঁদের দেশ থেকে ট্র্যাভেল এজেন্সি নিয়ে এসেছে। এঁরাও কেউ কেউ সন্দিহান হয়ে পড়েছেন, ফাইনালের টিকিট বিক্রি করে দিয়ে সেই টাকায় মেলবোর্ন সাইটসিয়িং করে নিলে কেমন হয়! ভারত ফাইনালে উঠলে যে গমগমে ভাবটা অবধারিত পাওয়া যেত, সেটাই যেন অদৃশ্য! শুনলাম বিশ্বকাপ ফাইনালে মাঠ পুরো ভরবে কি না এখনও অনিশ্চিত।
ধোনির ভারত খেতাব রাখার যুদ্ধ শুরু করেছিল ফেব্রুয়ারির ঠিক মাঝামাঝি, সেই সম্মান থেকে তারা চ্যূত ৪১ দিন লড়াই চালানোর পর।
চ্যূত যেন ক্রিকেট সভ্যতাও! ফাইনালের মতো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ বাকি। যা দিয়ে অন্তিম জয়ী নির্দিষ্ট হবে। পুজো বাকি, অঞ্জলি বাকি, প্রতিমা নিরঞ্জন হয়নি। অথচ মণ্ডপে যেন সিঁদুরখেলা শেষ দিকে!