—ফাইল চিত্র।
শীত এখনও তেমন পড়েনি। কিছুটা হালকা হালকা নরম ঠান্ডা আমেজ পড়েছে। সোয়েটার, কার্ডিগান, কাশ্মীরি শাল সবে ন্যাপথোলিনের গন্ধ নিয়ে আড়মোড়া ভাঙছে। এখনও তাদের বেরনোর সময় হয়নি।
কিন্তু তার আগেই সেলিব্রিটিরা ঠকঠক করে কাঁপছেন! সে কাঁপুনি থামার নামই নেই। বরং ক্রমাগতই বাড়ছে! ইদানিং শুনছি যে, বলিউডে নাকি বিখ্যাত পুরুষেরা কোনও অচেনা মহিলার সঙ্গে এক লিফটে চড়লেও একেবারে ‘ভজ গৌরাঙ্গ’ স্টাইলে দু’হাত সোজা মাথার উপর তুলে ফেলছেন! আর কাতরস্বরে অবিকল ‘মা, আমি চুরি করিনি’র সুরে ডায়লগ দিচ্ছেন— ‘মা, আমি কিন্তু ছুঁইনি!’
একেই বলে ‘কাঁটা লাগা’ কেস! যা তা কাঁটা নয়! এ কাঁটার নাম #মিটু! হ্যাশট্যাগের কাঁটা সমেত দাবানলের মতো ক্রমাগতই ছড়িয়ে পড়ছে। যদিও এর জন্ম এ দেশে নয়। এই অগ্নিকাণ্ডের প্রথম স্ফুলিঙ্গটির নাম তারানা বার্ক! ২০০৬ সালে অস্কারজয়ী প্রযোজক হার্ভে ওয়েনস্টাইনের বিরুদ্ধে সমাজকর্মী তারানা বার্কের হাত ধরেই ‘মি টু’ আন্দোলন প্রথম শুরু হয়। আন্দোলনের নাম ‘মি টু’ হওয়ার কারণ? তারানা বার্কের কাছে এক ত্রয়োদশী স্বীকার করে যে, সে যৌন হেনস্থার শিকার। তখন তারানা তাকে প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারেননি। তাঁর মনে পড়ে যায় নিজের অভিজ্ঞতা! মাত্র ছ’বছরের শিশু তারানা যে চরম যন্ত্রণাদায়ক ঘটনার শিকার হয়েছিলেন, সেই স্মৃতি মনে করিয়ে দেয় ত্রয়োদশী নাবালিকার নিষ্পাপ মুখ। কিন্তু প্রকাশ্যে তাকে কিছু বলতে পারেননি। শুধু মনে মনে বলেন—‘মি টু!’ অর্থাৎ, ‘আমিও’।
সেখান থেকেই শুরু হল #মিটু মুভমেন্ট। হার্ভে ওয়েনস্টাইনের বিরুদ্ধে এবং #মিটু আন্দোলনের স্বপক্ষে বহু ভুক্তভোগী নারী ও পুরুষ রাস্তায় নামলেন। মিছিলটি হলিউডের প্রধান সড়ক থেকে শুরু হয়ে ‘ওয়াক অব ফেম’ প্রদক্ষিণ করে সি এন এন সদর দফতরে গিয়ে শেষ হয়। যে ওয়েনস্টাইন জব্বর কাঁটা খেয়েছিলেন এবং খাওয়াই উচিত ছিল।
আরও পড়ুন: ছবির সেটেই জুনিয়র আর্টিস্টের শ্লীলতাহানি !
সেই শুরু! পরবর্তীকালে ‘মি টু’কে হ্যাশট্যাগ সহযোগে সোশ্যাল মিডিয়ায় আরও প্রবল ভাবে প্রকাশ্যে আনলেন অভিনেত্রী অ্যালিসা মিলানো। ২০১৭ সালের পনেরোই অক্টোবর থেকে শুরু হল ‘মি টু’র প্রবল ঘূর্ণিঝড়! তারানা বার্ক ‘মি টু’ শব্দটি মাই স্পেস সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ব্যবহার করেছিলেন। অ্যালিসা এবার হ্যাশট্যাগ দিয়ে #মিটুকে ট্যুইটারে নিয়ে এলেন। অ্যাশলে জুড, জেনিফার লরেন্স, উমা থারম্যান প্রভৃতি তথাকথিত সেলিব্রিটিদের সমর্থনে #মিটু প্রায় জ্বলন্ত মশালে পরিণত হল। কাঁপতে শুরু করল হলিউড।
সম্প্রতি এই ঝড়টি ভারতেও আমদানি হয়েছে। কোথায় লাগে টাইফুন, টর্নেডো! #মিটু মিসাইলের ধাক্কায় ধড়ধড় করে কুপোকাত হচ্ছেন সেলিব্রিটিরা। যে লোকটিকে দেখলে মনে হয় ‘প্রেম’ শব্দটি বললেই তেড়ে এসে স্রেফ জ্বালিয়ে দেবেন, সেই নানা পাটেকর থেকে শুরু করে ইউনিভার্সাল ‘বাপুজি’ অলোকনাথ অবধি কেউ বাকি নেই! কেস খেয়েছেন বিখ্যাত প্রযোজক ও পরিচালক সুভাষ ঘাই, কিংবদন্তি সাংবাদিক এম জে আকবর, সুরকার অনু মালিক, অভিনেতা রজত কাপুর, তথাকথিত বেস্ট সেলার সাহিত্যিক চেতন ভগত-সহ আরও অনেকে।
এই অবধি ঠিক-ই ছিল। কিন্তু #মিটু-র মতো একটা সিরিয়াস জিনিস কিছু কান্ডজ্ঞানহীন লোকের হাতে পড়ে ক্রমশই হাস্যকর হয়ে উঠছে যে! অনেক সুন্দরীই সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দাঁত মাজতে মাজতে ভাবছেন— ‘হাতে তো এখন বিশেষ কাজ-টাজ নেই। যাই, একটা #মিটু ঠুকে দিয়ে আসি!’ তার সাম্প্রতিক নমুনা বলিউডের এক আইটেম গার্ল! তিনি এক সুন্দরী বঙ্গতনয়ার মাথায় #মিটুর হাতুড়ি ধাম করে বসিয়ে দিয়েছেন! যাব্বাবা! এতদিন ধরে পুরুষ ভার্সেস নারী চলছিল! এবার নারী ভার্সেস নারী!
আরও পড়ুন: গোটা গায়ে জোর করে ক্রিম মাখিয়েছিল, বিস্ফোরক এই অভিনেত্রী
মুম্বই এখন থরহরিকম্পমান চিত্তে দেখার অপেক্ষায় আছে যে এর পর #মিটু-র গুগলি নিয়ে ফের কোনও দেবী আবির্ভূতা হবেন এবং ফের কার উইকেট পড়বে! শুধু মুম্বই কেন! কলকাতাতেও কিছুদিন আগেই এক পরিচালক ও এক মডেলের মধ্যে ‘তুই বিড়াল, না মুই বিড়াল’ গোছের একটা ধামাকা হয়ে গেল। বাকিরা দুরুদুরু বক্ষে ভাবছেন—‘কখন #মিটু আসে, কে জানে!’
এসব দেখেশুনে একটা প্রশ্নই মনে জাগছে। যেসব নারী তোতা মিঠু মিয়াঁর মতো অতিরিক্ত মাত্রায় ‘মি টু’, ‘মি টু’ করছেন— তাঁরা রীতিমতো শিক্ষিত। তবে তথাকথিত সেলিব্রিটি এঁরা এত বছর ধরে ঠিক কোথায় ছিলেন? তাঁরা কি কেউ ‘বিশাখা গাইডলাইনের’ কথা জানতেন না? ভারতের সংবিধানের ধারাগুলো কি অজানা ছিল? কিংবা ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট দ্বারা জারি করা ‘সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট অফ ওমেন অ্যাট ওয়ার্কপ্লেস অ্যাক্টের কথাও কি জানা ছিল না তাঁদের? #মিটু-র আবির্ভাবের অনেক আগেই তো আই পি সি সেকশনে মহিষাসুর বধ হয়ে যেত। তবে এত বছর ধরে #মিটু-র জন্য অপেক্ষা করতে হল কেন?
এ প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। তার চেয়েও বড় প্রশ্ন যে, তথাকথিত শিক্ষিতা, আধুনিকাদেরই যদি এই অবস্থা হয়, তবে সেই মেয়েটির কী হবে, যাঁর কাছে সোশ্যাল মিডিয়া কোনওদিনই পৌঁছয়নি বা আদৌ পৌঁছবেই না! #মিটু জিনিসটা খায়, না মাথায় মাখে— সেটাই তো তাঁর জানা নেই। যে লখিয়া রোজ জোতদারের হাতে ধর্ষিতা হয়েও কাজ চলে যাওয়ার ভয়ে চুপ করে থাকে, প্রত্যন্ত গন্ডগ্রামের যে চোদ্দো বছরের কুন্তী মাহাতো প্রত্যহ স্কুলশিক্ষকের হাতে শারীরিক ভাবে শোষিত হচ্ছে, অথচ লজ্জা ও ভয়ে টুঁ শব্দটিও করছে না— #মিটু আন্দোলন এল, না গেল, তাতে তাদের কী আসে-যায়! #মিটু নিঃসন্দেহে অত্যন্ত শক্তিশালী অস্ত্র— কিন্তু যদি বেশিরভাগ অত্যাচারিত সেই অস্ত্রটির ধারে কাছেও পৌঁছতেই না পারে, তবে তার উপযোগিতা সম্বন্ধে মনে স্পষ্ট সন্দেহ জাগে। আর আমাদের এই তৃতীয় বিশ্বের দেশে এই জাতীয়, তথাকথিত পিছিয়ে থাকা নারীদের সংখ্যাই কিন্তু বেশি। তাঁদের যখন প্রতিবাদ করার সময় হবে, তখন #মিটু-র শৌখিন অভিযোগের বদলে হাতে উঠে আসবে কাস্তে বা টাঙি!
তাই বলি কী, হ্যাশট্যাগওয়ালা বেয়নেট আমদানি না করে সাধারণ একটা কাস্তের কথা কি ভাবা যেতে পারে? রাখী সাওয়ন্ত, তনুশ্রী দত্তর জন্য নয়— আমাদের নিতান্তই অজানা-অচেনা এক দোপদি মেঝেনের জন্য একটা যোগ্য প্রতিবাদ কি তুলে আনতে পারি না?
যাতে সে অত্যাচারীর মুখে থুতু ফেলে বলতে পারে— ‘লেংটা করতে পারিস, কাপড় পরাবি কেমন করে? মরদ তু?’
এর পাশে হ্যাশট্যাগের কোনও প্রয়োজনীয়তা নেই।