দৃঢ়প্রতিজ্ঞ: অন্য নির্যাতিতাদের পাশে থাকতে শহরে হাজির কোয়েল চট্টোপাধ্যায়, অনুজা গুপ্ত এবং আয়েশা সিংহ। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নন্দনা সেনও (বাঁ দিক থেকে তৃতীয়)। বৃহস্পতিবার। নিজস্ব চিত্র
নিজের কথা যে এ ভাবে বলতে পারবেন, বছর দু’য়েক আগেও ভাবতে পারেননি তিনি। ছ’বছর বয়স থেকে কিশোরীবেলা পর্যন্ত, জীবনের অনুচ্চারিত দগদগে অধ্যায় ক্যামেরার সামনে মেলে ধরেছেন কোয়েল চট্টোপাধ্যায়।
কলেজপড়ুয়া মেয়ের মা, ৪২ বছরের সাহসিনী বলছেন, ‘‘কাছের আত্মীয়-গুরুজনের কদর্য চেহারাটা নিয়ে খুলে বলাটা সোজা ছিল না। তবে সঙ্কোচ-লজ্জার গিঁট খুলে ফেলার মধ্যেই যে আমার মুক্তি, এটা বুঝতে পেরেছি।’’ এই কথার স্রোত খুলে দেওয়াটা শুধু ওঁর নিজের জন্য নয়, অনেক বছর আগের কোয়েলের মতো আরও অনেক অসহায় খুদের জীবন সুরক্ষিত করারও একটা সুযোগ। কারণ কোয়েল জানেন, বাড়ির ভিতরে এমন ঘটতে পারে জেনেও অনেক সময়ে মা-বাবারা পর্যন্ত তা এড়িয়ে চলেন।
দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা, পেশায় ওয়েব ডেভেলপার কোয়েলের মতোই এগিয়ে এসেছেন সমাজকর্মী আয়েশা সিংহ, বেঙ্গালুরুর রিনা ডি’সুজা, মুম্বইয়ের ঈশিতা মানেক, দিল্লির বর্ণিনী ভট্টাচার্যেরা। কারও ক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনকারীর পরিচয় দাদা, কারও ক্ষেত্রে কাকা, কারও আবার বিশ্বস্ত পরিচারক বা অভিভাবকপ্রতিম পড়শি। সময়ের পলির নীচে আগ্নেয়গিরির মতোই তপ্ত হয়ে ছিল এই সব জীবনের নৈঃশব্দের গল্প। সেই নিঃস্তব্ধতাকেই ভেঙেচুরে ক্যামেরার সামনে মন খুলে কথা বলছেন, হাত ধরাধরি করে হেসে উঠছেন ‘অপরাজিতা’রা। ‘‘ভয়, গ্লানি সবটা ঝেড়ে ফেলে জিতে গিয়েছি বলব না! তবে হারিনি!’’ বলছেন কোয়েল।
নিগ্রহের চিত্রনাট্য
• দ্য কালার পার্পল (১৯৮৫): অ্যালিস ওয়াকারের উপন্যাস নিয়ে স্টিভেন স্পিলবার্গের ছবি। সেলি আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ মেয়ে। কিশোরী বয়সে বাবা তাকে ধর্ষণ করে। সে একাধিক বার গর্ভবতী হয়।
• মনসুন ওয়েডিং (২০০১): বিয়েবাড়িতে ছোটবেলার যৌন নিগ্রহকারী পিসেমশাইয়ের মুখোমুখি রিয়া। একটি বাচ্চার সঙ্গে তাকে দেখে রিয়া চিৎকার করেন। নিগ্রহকারী চলে যেতে বাধ্য হয়।
• প্রেশাস (২০০৯): বাবার ধর্ষণে গর্ভবতী মেয়ের লড়াইয়ের গল্প। এক শিক্ষকের প্রেরণায় সেই কিশোরী দুই সন্তানকে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চায়।
• হাইওয়ে (২০১৪): বাবার বন্ধুর হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার বীরা। বাবাকে তাঁর প্রশ্ন, আমায় বাইরের বিপদ নিয়ে ভয় দেখিয়েছ, ঘরের বিপদের কথা বলনি কেন?
বাংলা ছবি ভীতু (২০১৫), হিন্দি কহানি-টু (২০১৬)-তেও পরিবারে যৌন নিগ্রহের অনুষঙ্গ ছিল।
তাঁরা যা ছিলেন, আর যা হয়েছেন— সেই গল্পের নাম ‘দ্য লিটল গার্ল উই ওয়্যার, অ্যান্ড দ্য উইমেন উই আর!’ ‘‘এ দেশে ছোটদের যৌন নিগ্রহ ক্রমশ মহামারি হয়ে উঠছে। যৌথ পরিবারের নিশ্চিন্তিও যে নিরাপদ নয়, এটা জোর গলায় বলার সময় এসেছে।’’— বলছেন তথ্যচিত্রটির গুরুত্বপূর্ণ নেপথ্যকর্মী অনুজা গুপ্ত। পরিবারের বৃত্তে যৌন নির্যাতনের শিকার মেয়েদের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে শরিক একটি সংগঠনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রামের কথায়, ‘‘এখনও বেশির ভাগ শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। সেই নির্যাতনকারীরা কিন্তু মঙ্গলগ্রহের জীব নয়। অনেক ক্ষেত্রেই মামা, কাকা, দাদা, এমনকী বাবাদের দিকেও আঙুল ওঠে। চেম্বারেও এমন বহু শিশু দেখাতে আসে।’’
আরও পড়ুন: মুড অফ, কাজে মন বসছে না, জেনে নিন কী করবেন?
বুধ ও বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কলকাতার এক মাল্টিপ্লেক্স ও প্রেক্ষাগৃহে টিকিট কেটে ৩৭ মিনিটের ছবিটি দেখলেন দর্শকেরা। আজ, শুক্রবার লোরেটো কলেজ ও আইআইএসডব্লিউবিএম-এর পড়ুয়াদের সামনে ছবিটির প্রদর্শনী। দর্শকদের মুখোমুখি হচ্ছেন কোয়েল, আয়েশা, অনুজা বা ছবিটির আর এক নেপথ্যকর্মী অশ্বিনী আইলাওয়াদি। এ শহরেও নির্যাতিতাদের এগিয়ে চলার মন্ত্র শেখাতে নিরাময় কর্মশালার আয়োজন করছেন তাঁরা। আয়োজক সোমা রায় কর্মকার বলছিলেন, সাধারণ যৌন নির্যাতনের থেকেও কাছের জনের হাতে নিগ্রহের যন্ত্রণা ঢের কষ্টের! তাঁর কথায়, ‘‘অনেকেরই অকারণ পাপবোধ, নিজের প্রতি ঘেন্না কাজ করে। নিজের কথা বলতে দশ পা এগিয়েও ফের ৪০ পা পিছিয়ে যান তাঁরা।’’
কোয়েলের কথায়, ‘‘এখন পুরনো কথা আমি বেশ বলতে পারি। কিন্তু যে বা যারা আমার সঙ্গে এমন করেছিল, তাদের মুখোমুখি হতে চাই না!’’ এ সব ক্ষেত্রে অনেক মেয়েকেই নিগ্রহকারীর কাছাকাছি থাকতে হয়। আয়েশার মতে, বাড়ির ভিতরে ছোটদের এই নিগ্রহের প্রতিবাদ করতে হলেও মায়েদের নিজের পায়ে দাঁড়ানো জরুরি। না-হলে কিছু করার থাকে না। তথ্যচিত্রটি জুড়েই মা কিংবা বাবার লোকলজ্জা বা অন্য অসহায়তায় মুখ বুজে থাকার ছবি। এই লড়াইয়ের সমব্যথী অভিনেত্রী নন্দনা সেনের কথায়, ‘‘বড়রা পাশে না দাঁড়ালে ছোটদের পক্ষে প্রতিবাদ করা অসম্ভব।’’
এখন পকসো (প্রোটেকশন অব চাইল্ড ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সেস) আইনে এমন অভিযোগে সাজা দেওয়ার রাস্তা কিছুটা সোজা হয়েছে। তবু সব সময়ে আইনি সাজাও সমাধান নয়। যৌন নিগ্রহ মানতে না চাওয়ার সামাজিক অবচেতনে ঘা মারতে চান অনুজা, সোমারা। বুধবারের শো শেষে থমথমে প্রেক্ষাগৃহে উঠে দাঁড়ালেন এক সদ্য তরুণী। ‘‘মাকেও এত দিন বলিনি! আমার সঙ্গেও এমনই হয়েছে। আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে পারি?’’