ডাম্পারে ছাই ৩৫ টনের, ভাঙছে রাস্তা

তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাইয়ে ঢেকেছে এলাকা। এক দিকে হাঁপানি, অন্য দিকে ফসল নষ্ট। ছাই-গাড়ির দাপটে ভেঙে যাচ্ছে রাস্তা। ব্যাহত হচ্ছে জীবনযাপন। খোঁজ নিল আনন্দবাজার। পর্ব ২। রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়বড়জোড়া ও গঙ্গাজলঘাটি শিল্পাঞ্চলের রাস্তার বেহাল অবস্থা নিয়ে গ্রামবাসী থেকে কারখানা কর্তৃপক্ষ সকলেই বার বার অভিযোগ তোলেন। কিন্তু রাস্তার হাল ফেরে না। মালবাহী গাড়িতে নিয়ম ভেঙে অতিরিক্ত পণ্য পরিবহণ করাকেই দুষছেন সকলে। আর সে ক্ষেত্রে বার বার ডিভিসি-র মেজিয়া তাপবিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ ও ছাই সরানোর দায়িত্ব প্রাপ্ত ঠিকা সংস্থার নাম জড়িয়েছে।

Advertisement
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০১৪ ০২:৫৩
Share:

ধোঁয়ায় ঢাকা। নিয়ম ভেঙে অতিরিক্ত মালবহনে ভাঙছে রাস্তা।

বড়জোড়া ও গঙ্গাজলঘাটি শিল্পাঞ্চলের রাস্তার বেহাল অবস্থা নিয়ে গ্রামবাসী থেকে কারখানা কর্তৃপক্ষ সকলেই বার বার অভিযোগ তোলেন। কিন্তু রাস্তার হাল ফেরে না। মালবাহী গাড়িতে নিয়ম ভেঙে অতিরিক্ত পণ্য পরিবহণ করাকেই দুষছেন সকলে। আর সে ক্ষেত্রে বার বার ডিভিসি-র মেজিয়া তাপবিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ ও ছাই সরানোর দায়িত্ব প্রাপ্ত ঠিকা সংস্থার নাম জড়িয়েছে।

Advertisement

তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই জমা করা হয় পাশের লটিয়াবনির ছাইপুকুরে বা অ্যাশপন্ডে। সেখান থেকে ছাই ডাম্পারে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় আসানসোল, রানিগঞ্জ প্রভৃতি এলাকায়। সেখানে পরিত্যক্ত কয়লাখনিগুলি ওই ছাই দিয়ে ভরাট করা হয়। গঙ্গাজলঘাটির দুর্লভপুর, লাগাপাড়া, রাধামাধবপুর, চৌশাল হয়ে বড়জোড়ার মালিয়াড়া, ঘুটগোড়িয়া, বড়জোড়া, প্রতাপপুর প্রভৃতি এলাকা দিয়ে দিনের আলোয় এই ছাই পরিবহণ করা হয়। শেষে দুর্গাপুর ব্যারাজ পার হয়ে রানিগঞ্জ ও আসানসোলে যায় ছাইবাহী ট্রাক-ডাম্পার। রাতে রুট বদলে লটিয়াবনি থেকে বাঁকুড়া-রানিগঞ্জ ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে নন্দনপুর, গোস্বামীগ্রাম, মেজিয়া সেতু হয়ে রানিগঞ্জের দিকে গাড়িগুলি নিয়ে যাওয়া হয়। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র সূত্রের খবর, সারা দিনে প্রায় ৪৫০টি দশ চাকার ডাম্পার এই ছাই পরিবহণের কাজে ব্যবহার করা হয়।

১০ চাকার গাড়িতে কতটা পণ্য পরিবহণ করা যেতে পারে? বাঁকুড়ার জেলাশাসক বিজয় ভারতী বলেন, “১০ চাকার গাড়িতে ২৫ টন পর্যন্ত মাল পরিবহণ করা যেতে পারে। তার বেশি মাল নিয়ে গেলেই তা বেআইনি।” বাসিন্দাদের দাবি, নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই অতিরিক্ত পরিমাণ ছাই পরিব হণ করা হচ্ছে। তার জেরে রাস্তা যেমন ভাঙছে, তেমনি বাড়ছে পথদুর্ঘটনাও। এ নিয়ে এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র লাগোয়া গ্রামগুলির বাসিন্দারা একাধিকবার জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছেন। কিন্তু অতিরিক্ত মালবহণ বন্ধ হয়নি।

Advertisement

রাধামাধবপুরের বাসিন্দা আদিত্য মণ্ডল বলেন, “এলাকার রাস্তাঘাট নরককুণ্ডে পরিণত হয়েছে। ভারী যানবাহণ চলাচল বন্ধে এ বার কড়া হোক প্রশাসন।” বড়জোড়ার ঘুটগোড়িয়ার শঙ্কর মণ্ডল বলেন, “অতিরিক্ত মাল নিয়ে ডাম্পারগুলো যায়, তখন রাস্তার পাশে থাকা বাড়ি কাঁপতে থাকে। কবে মাথায় বাড়ির ছাদ ভেঙে পড়ে সেই আশঙ্কায় থাকি।” তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ছাই পরিবহণকারী সংস্থার বিরুদ্ধে ওঠা এই অতিরিক্ত পণ্য পরিবহণের অভিযোগের সত্যতা যাচাই করতে বিদ্যুতকেন্দ্রের মাল পরিবহণকারী গাড়ির ওজন মাপার অফিসে গিয়ে দেখা গেল, বাস্তবিকই প্রায় প্রত্যেক গাড়িতেই কমবেশি ৩৫ টনের বেশি ওজনের ছাই পরিবহণ করা হচ্ছে।

তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ওজন মাপার যন্ত্রে ছাইবাহী গাড়ির ওজন ধরা পড়েছে প্রায় ৩৫ টন।

দুর্লভপুর-বড়জোড়া রাস্তা দেখাশোনা করে পূর্ত (সড়ক) দফতর। সেই দফতরের বাঁকুড়া বিভাগের এক আধিকারিক বলেন, “ওই রাস্তা ঠিক রাখা যাচ্ছে না। সংস্কার করা হলেই অতিরিক্ত মালবাহী ছাইগাড়ির চাপে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে ডিভিসি-কে জানিয়েও কাজ হয়নি।” দুর্লভপুর থেকে মেজিয়া হয়ে রানিগঞ্জ যাওয়ার ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কের উপরেও একই কারণে চাপ বাড়ছে। এনএইচ-এর দুর্গাপুর বিভাগের এক আধিকারিকের কথায়, “অতিরিক্ত পণ্য নিয়ে গেলেই রাস্তা খারাপ হবে। ভারী ছাইগাড়ির চাপেও তাই ওই রাস্তার ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু বারণ করলে শুনবে কে?”

যদিও এই সমস্ত অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করছেন ডিভিসি-র ছাই পরিবহণকারী ঠিকা সংস্থার অন্যতম কর্তা বিশ্বদীপ দে। তাঁর দাবি, “কে বলছে আমরা অতিরিক্ত পরিমাণে ছাই নিয়ে যাচ্ছি? সব নিয়ম মেনেই ছাই বহন করা হচ্ছে।” তাঁর সুরেই কথা বলেছেন ডিভিসি-র মেজিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ডেপুটি চিফ ইঞ্জিনিয়ার অশোককুমার ভার্মা। উল্টে অতিরিক্ত মাত্রায় পণ্য পরিবহণ যদি হয়েও থাকে তার জন্য তিনি দায়ী করছেন জেলা প্রশাসনকেই। তাঁর দাবি, “নিয়মের বেশি পরিমাণে মাল বহন করা তো হয় না। আর কতটা মাত্রায় পণ্য পরিবহণ করা উচিত, তা জেলা প্রশাসন আমাদের জানায়নি। এ ছাড়া এই সব রোখার দায়িত্বও আমাদের নয়। এটা পুরোপুরি জেলা প্রশাসনের কাজ।”

কতটা পণ্য পরিবহণ করা উচিত তা ডিভিসিকে জানান হয়নি বলে যে অভিযোগ উঠছে তার প্রেক্ষিতে জেলাশাসক বিজয় ভারতী বলেন, “কোন গাড়িতে কতটা পণ্য পরিবহণ করা হবে তা গাড়ির ব্লু-বুকেই সাফ লেখা থাকে। তার পরেও কেন আলাদা করে জানাতে হবে?” আরটিও দফতররের এক কর্মীর কথায়, প্রায় প্রতিমাসেই অতিমাত্রায় ছাই পরিবহণ করার দায়ে ছাই বহনকারী বেশ কয়েকটি গাড়ির জরিমানা করা হয়। তার পরেও তারা এ বিষয়ে সচেতন হচ্ছে না। জেলাশাসকের হুঁশিয়ারি, “অতিরিক্ত পণ্য পরিবহণ রুখতে এ বার আরও বেশি মাত্রায় ধরপাকড় শুরু করতে চলেছি আমরা।”

লাগাম পড়বে কি অতিরিক্ত পণ্যবহনে? উত্তর খুঁজছে বড়জোড়া ও গঙ্গাজলঘাটি শিল্পাঞ্চল।

(শেষ)

ছবি: অভিজিৎ সিংহ।

ডিভিসি-কে সতর্ক করলেন ডিএম

নিজস্ব সংবাদদাতা • বাঁকুড়া

ছাই পরিবহণ করা নিয়ে ডিভিসি-কে সতর্ক করল বাঁকুড়া জেলা প্রশাসন। শুক্রবারই জেলাশাসক বিজয় ভারতী ডিভিসি কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেন, “ছাই পরিবহণের ক্ষেত্রে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের যে নির্দেশ রয়েছে তা না মানা হলে এবং অতিরিক্ত পরিমাণে পণ্যবহন করা কোনও গাড়িকে জেলা প্রশাসন ধরলে সে ক্ষেত্রে আরও কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” ডিভিসি-র মেজিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ডেপুটি চিফ ইঞ্জিনিয়ার অশোককুমার ভার্মা বলেন, “জেলাশাসক চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে একটা চিঠি পাঠিয়েছেন শুনেছি। দূষণ নিয়ন্ত্রণ সব নিয়ম মেনেই আমরা ছাই পরিবহণ করি। জেলাশাসক ঠিক কি বলেছেন, তা পড়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement