রসায়নে তিন নোবেলজয়ী। ফ্রাঁসে এইচ আর্নল্ড (বাঁ দিক থেকে), জর্জ পি স্মিথ ও স্যর গ্রেগরি পি উইন্টার। ছবি- নোবেল কমিটির ওয়েবসাইটের সৌজন্যে।
প্রকৃতির কাছ থেকে বিবর্তনের পাঠ নিয়ে প্রকৃতিকেই নিয়ন্ত্রণ! যার নিয়ম প্রকৃতির আগে জানা ছিল না! আমাদেরও বিস্তর ঘাম ঝরিয়ে খুঁজে নিতে হল।
সেই ‘দাদাগিরি’র উপায় বাতলিয়েই এ বছর রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেলেন তিন জন। ফ্রাঁসে এইচ আর্নল্ড, জর্জ পি স্মিথ ও স্যর গ্রেগরি পি উইন্টার। প্রথম দু’জন মার্কিন, তৃতীয় জন ব্রিটিশ।
বুধবার ‘দ্য রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস’ ওই তিন বিজয়ীর নাম ঘোষণা করেছে। নোবেল পুরস্কারের ১১৭ বছরের ইতিহাসে ফ্রাঁসেই চতুর্থ মহিলা, যিনি রসায়নে তাঁর গবেষণার এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেন। এর আগে রসায়নে নোবেলজয়ী মহিলাদের অন্যতম মারি ক্যুরি (১৯১১), তাঁর মেয়ে আইরিন ক্যুরি (১৯৪৭) এবং ডরোথি ক্রাউফুট হজকিন (১৯৬৪)।
প্রাকৃতিক বিবর্তনের পাঠ নিয়েই তা দিয়ে আমাদের জীবনকে আরও সহজে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছেন নোবেলজয়ীরা। যেটা প্রকৃতি ও পরিবেশ বলে দেয়নি। যার ব্যবস্থা প্রকৃতি করে রাখেনি। এখানেই প্রকৃতির ওপর মাতব্বরি।
৩৭০ কোটি বছর আগে প্রথম প্রাণের জন্মের পর থেকে মাটি, মরভূমি আর সমুদ্রগর্ভে যাবতীয় জীবের জন্ম ও বিকাশের এক ও একমাত্র চালিকাশক্তির নাম- বিবর্তন। যার নিয়মকানুন প্রকৃতি ও পরিবেশই ঠিক করে দিয়েছে। সেই পথ কোথায় গিয়ে কতটা বাঁকবে, প্রকৃতি, পরিবেশই তা ঠিক করে রেখেছে। প্রাণকে টিঁকে থাকতে হলে প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে বাঁচতে হবে। সেই হাতিয়ারও জীবের শরীরে দিয়ে রেখেছে প্রকৃতি। যেন বলতে চেয়েছে, অস্ত্রটস্ত্র সবই থাকল হাতে। এ বার সেগুলিকে চালাতে শেখো। যুদ্ধ করতে শেখো। লড়। লড়াইয়ে জিতলে টিঁকে থাকবে। না পারলে হারিয়ে যাবে। এটাই বিবর্তনের মূল কথা। শুধু তাই নয় জীবনকে টিঁকে থাকতে আর এগিয়ে যেতে গেলে যে সব জটিল রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, তার কাজগুলিও সেরে রেখেছে প্রকৃতি। বাঁচার রসদ সব জীবই তার পরিবেশ থেকে পেয়ে যায়। তাকে শুধু বেছে নিতে হয়। মেরুর সাগরেও মাছ পাওয়া যায়। জমজমাট বরফের হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় প্রাণের টিঁকে থাকার কথা ছিল না। তার তো জমে যাওয়ারই কথা। কিন্তু মেরুর সাগরে মাছদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রকৃতিই তাদের শরীরে পুরে দিয়েছে বিশেষ এক ধরনের প্রোটিন। যাতে তারা বরফের রাজ্যে থাকলেও জমে হিম না হয়ে যায়!
আরও পড়ুন- অর্ধশতাব্দী পর পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল মহিলার, সঙ্গী আরও দুই
আরও পড়ুন- ক্যানসারে ‘ব্রেক’ কষে নোবেল জেমস অ্যালিসন এবং তাসুকু হঞ্জোর
নতুন প্রোটিন আসুক, আসুক নতুন ওষুধ
ফ্রাঁসে কাজ করেছেন এনজাইম বা উৎসেচকের ওপর। যা আদতে প্রোটিন। কোনও রাসায়নিক বিক্রিয়াকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে বা তার গতি শ্লথ করতে সাহায্য করে। এদের বলা হয় অণুঘটক (ক্যাটালিস্ট)। প্রোটিন তৈরি হয় মূলত ২১ রকমের অ্যামাইনো অ্যাসিড দিয়ে। এই অ্যামাইনো অ্যাসিডই প্রাণের বীজ। অ্যামাইনো অ্যাসিড মাত্র ২১ রকমের হলে কী হবে, তাদের একে অন্যের হাত ধরার কায়দা-কৌশলের জন্য প্রোটিন রয়েছে হাজারে হাজারে। যাদের হদিশ মিলেছে আপাতত।
ফ্রাঁসে ওই এনজাইমকে তাঁর ইচ্ছা মতো চালিয়েছেন। যাতে তারা কোনও রাসায়নিক বিক্রিয়া থেকে নতুন নতুন প্রোটিন তৈরি করতে পারে। যারা অণুঘটক হিসেবেই ওষুধ বানাতে ও অপ্রচলিত শক্তি উৎপাদনের সহায়ক হবে। ফলে, ওই কাজগুলি অনেক সহজ ও সস্তা হয়ে যাবে। উৎপাদন প্রক্রিয়া অনেক বেশি দ্রুত হবে। নোবেল পুরস্কারের মোট অর্থমূল্য ৯ সুইডিশ ক্রোনারের অর্ধেকটা দেওয়া হয়েছে ফ্রাঁসেকে।
নতুন প্রোটিন বানাতে পারে ভাইরাসও!
বাকিটা ভাগ করে দেওয়া হয়েছে যে দু’জনকে, সেই স্মিথ ও উইন্টার কাজ করেছেন ‘ব্যাকটেরিওফাজ’ নিয়ে। যা আদতে একটি ভাইরাস। আর তা ব্যাকটেরিয়ার শরীরে সংক্রমণ ঘটায়। তাঁদের উদ্ভাবিত পদ্ধতির নাম- ‘ফাজে ডিসপ্লে’। যার মাধ্যমে নতুন নতুন চমকদার ওষুধ বানাতে আমাদের শরীরের অ্যান্টিবডিগুলিকে নিজেদের ইচ্ছা মতো চালাতে পারব আমরা। রাসায়নিক বিক্রিয়ায় তাদের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। যেমনটা চাইছি, তাকে সেই ভাবেই কাজ করাতে পারব। তারাও হবে নতুন ন তুন প্রোটিন। যা জটিল ওষুধের চিকিৎসায় লাগবে। এই পদ্ধতিতে ইতিমধ্যেই জন্ম নিয়েছে একটি জৈব যৌগ। আদালিমুমাব। যা রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস ও সোরিয়াসিস সারাতে খুব কাজে লাগে। কাজে লাগে সংক্রামক বাওয়েল ডিজিজ সারাতেও। যা শরীরে বিষের পরিমাণ কমাতে সাহায্য করবে। হাতিয়ার হবে মেটাস্ট্যাটিক ক্যানসার চিকিৎসাতেও।
ছবি: নোবেল কমিটির ওয়েবসাইটের সৌজন্যে